অকাল ঋতুতে চলে গেলেন ঋতুপর্ণ

এতো কিসের তাড়া! পঞ্চাশ পার না-হতেই চলে গেলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ! বিস্ময়করই তো বটে, এমন একটা মানুষের কর্মময় জীবনটা সেঞ্চুরির মুখ না-দেখা সত্যিই বেদনাময়।

মুম রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 May 2013, 01:50 AM
Updated : 1 June 2013, 00:05 AM

এতো কিসের তাড়া! পঞ্চাশ পার না-হতেই চলে গেলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ! বিস্ময়করই তো বটে, এমন একটা মানুষের কর্মময় জীবনটা সেঞ্চুরির মুখ না-দেখা সত্যিই বেদনাময়। আকস্মিক হৃদযন্ত্রটা বিগড়ে গেলো আর চলে গেলেন ঋতুপর্ণ (৩১ আগস্ট ১৯৬৩- ৩০ মে ২০১৩)। সুইডিশ মাস্টার পরিচালক ইঙ্গমার বার্গম্যান অনুপ্রাণিত যে বাঙালি পরিচালক সমকালীন বাংলা চলচ্চিত্রকে নতুন রূপ দিয়েছিলেন তার আকস্মিক চলে যাওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হয়।

৪৯ বছরের জীবনে ১৯টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। দুই দশকের কর্মকালে এই ১৯টি চলচ্চিত্রের জন্য অর্জন ১৭টি পুরস্কার বা সম্মাননা। ১৯৯৪ সালে হীরের আংটি নামের শিশুতোষ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু। ওই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের আগে তিনি একাধিক আলোচিত বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেছেন। এরপরই তৈরি করেন তিনি ঊনিশে এপ্রিল। গুরু বার্গম্যানের অটাম সোনাটা ছবির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। অপর্ণা সেন, দিপঙ্কর দে, দেবশ্রী রায় এবং প্রসেনজিৎ অভিনীত এই চলচ্চিত্র মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। দ্বিতীয় ছবিতেই ঋতুপর্ণ ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছিনিয়ে নেন। মা ও কন্যার অনুভূতিশীল সম্পর্ক আর ডিটেইলের ব্যবহার এই চলচ্চিত্রকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। মা-বাবা-মেয়ের পারিবারিক সম্পর্কের বিষয়টি তার একাধিক চলচ্চিত্রেই উঠে এসেছে। অসুখ (১৯৯৯) চলচ্চিত্রেও দেখা যায় অভিনেত্রীর কন্যা রোহিনি এবং তার মা-বাবার সম্পর্ক নিয়ে টানাপোড়েন হচ্ছে। আকস্মিক রোহিনির মায়ের অসুখকে কেন্দ্র পুরো পরিবারে সংকট তীব্রতর হয়ে ওঠে।

পারিবারিক সম্পর্কের সংকট ও অনুভব ঋতুপর্ণকে বরাবরই ভাবিয়েছে। তার তিতলি চলচ্চিত্রে অপর্ণা সেন ও কঙ্কনা সেন অভিনয় করেছেন মা-মেয়ের চরিত্রে যারা বাস্তব জীবনেও মা-মেয়ে। নির্জন এক পাহাড়ি এলাকায় মেয়ে তিতলির স্বপ্নের নায়ক রোহিত রায় এসে হাজির হয় শুটিং করতে। তিতলির ঘরে এই নায়কের ছবি, তার তরুণ মনে রোহিতকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। এমন সময়ই দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি পথে রোহিত রায়ের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে তিতলিদের গাড়িতে তিনি লিফট নেন। তিতলির মা উর্মিলা মেয়ের এই বাল্যখিল্যকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। এক পর্যায়ে উর্মিলা ও রোহিতের মধ্যে পাইন বনের ধারে কথা হয়। জানা যায়, রোহিত আর উর্মিলা ভালবেসেছিলো একে অপরকে। কিন্তু রোহিতের নায়ক হওয়ার অনিশ্চিত স্বপ্নের কারণেই তাদের বিয়েটা হয়নি। তাদের কথার আড়ালে তিতলি এসে সব শুনে ফেলে। এবার আর সে রোহিতকে সহ্য করতে পারে না। মা-মেয়ের একই স্বপ্নের নায়ক নিয়ে গুমোট এক পরিবেশ তৈরি হয়। ছবির শেষে দেখা যায় তীব্র বৃষ্টি হচ্ছে আর উর্মিলা কাঁদছে এবং ক্রন্দসী মায়ের পাশে মেয়ে তিতলিই স্বান্তনা বয়ে আনছে। শুধু গল্প নয়, পরিবেশ, বিষয়, এ ছবির লোকেশন, সংলাপ, কবিতার ব্যবহার, বিশেষ করে কালিদাসের মেঘদূতের উদ্ধৃতি এ চলচ্চিত্রকে অদ্ভুত সৌন্দর্য আর মাধুর্য এনে দিয়েছে। দার্জিলিংয়ে মনোরম লোকেশনে কয়েকজন মাত্র শিল্পী নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্র মুন্সিয়ানার দাবিদার।

রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি উপন্যাস অবলম্বনে ২০০৩ সালে তিনি তৈরি করেন চোখের বালি চলচ্চিত্র। ঐশ্বরিয়া রাই, প্রসেনজিৎ, রাইমা সেন অভিনীত এই চলচ্চিত্র পরবর্তীতে হিন্দিতে ডাব করে প্রচার করা হয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি অর্জন করে। দেশ-বিদেশের সমালোচকদের কাছে আলোচিত এই চলচ্চিত্র সুইজারল্যান্ডের লোকার্নো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লেপার্ড  সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতে। শিকাগো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ও টরেন্টো আন্তর্জাতিক চলচিচত্র উৎসবে এটি বিশেষ সম্মানের সাথে প্রদর্শিত হয়েছে। সদ্য বিধবা তরুণীর প্রেম-বেদনা-কামনার এক সাহসী চিত্রায়ণ ঘটেছে চোখের বালি চলচ্চিত্রে।

উনিশ শতকের জমিদারী প্রেক্ষাপটে নির্মিত অন্তরমহল চলচ্চিত্রেও ঋতুপর্ণ যথেষ্ট সাহসিকতা দেখিয়েছেন। রাজা ভুবনেশ্বর চৌধুরী ব্রিটিশ সরকারকে খুশি করতে গিয়ে দেবী দুর্গার প্রতিমাতে রাণী ভিক্টোরিয়ার আদল দিতে বলেন। অন্যদিকে তিনি নিঃসন্তান। একাধিক বিয়ে করলেও আসলে তিনি সন্তান জন্ম দিতে অপারগ। তার নতুন রাণী যশোমতী অবশেষে এক ভাস্করের সঙ্গে মিলিত হয়। জ্যাকিশ্রফ, অভিষেক বচ্চন, সোহা আলি খান, রূপা গাঙ্গুলির মতো শিল্পী নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্র বিষয় ও ভাবনার দিক থেকে পরিণত এবং প্রাপ্তবয়স্ক।

পরিণত বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করা তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই কারণে তার চলচ্চিত্রে প্রেম, অসম প্রেম, পরকীয়া, শারীরিক সম্পর্ক ইত্যাদি উঠে এসেছে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে নির্মিত দোসর ছবিতে দেখা যায় দাম্পত্য সম্পর্কের আড়ালে গড়ে ওঠা এক পরকীয়া প্রেমের ভয়ঙ্কর পরিণতি। কৌশিক আর কাবেরি আপাত সুখি দম্পতি। একটি একটি সড়ক দুর্ঘটনায় সব পাল্টে যায়। দুর্ঘটনার পর কৌশিক মারাত্মকভাবে আহত হয় আর জানা যায় তার পাশে ছিলো তার অফিসের সহকর্মী, প্রেমিকা মিতা। মিতা আর কৌশিক প্রায়ই অফিসের নাম করে নানা জায়গায় যেতো। এই দুর্ঘটনায় মিতার মৃত্যু আর কৌশিকের জীবন-মরণ লড়াই স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ককে নতুন করে ভাবতে শেখায়। ঋতুপর্ণ ঘোষের অনেক দিনের শখ ছিলো সাদা-কালোতে সাম্প্রতিক বিষয়ে একটি চলচ্চিত্র করবেন। তাই  ২০০৬ সালে নির্মিত দোসর ছবিটি তিনি চিত্রায়িত করেন সাদাকালোয়।

শুধু পরিচালনাই নয়, ঋতুপর্ণ একজন সফল লেখক ও সম্পাদকও ছিলেন। অন্যদিকে পরিচালনার পাশাপাশি তিনটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন স্বচ্ছন্দে।

হয়তো এই রকম আনেক অনেক ইচ্ছা আর শখ চলচ্চিত্র নিয়ে তার ছিলো। কিন্তু এই আকস্মিক প্রয়াণে সেগুলোতে ফুলস্টপ পড়ে গেলো। আর আমরাও ঋতুপর্ণের আরও নতুন নতুন সৃষ্টিকর্ম দেখার ইচ্ছা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলাম। এখন কেবল তার সৃষ্টিকর্মের আড়ালেই বার বার তাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা।

মুম রহমান, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র সমালোচক