'মাই ফেয়ার লেডি' থেকে 'ওগো বধূ সুন্দরী'

সাইপ্রাসের এক তরুণ ভাস্কর পিগম্যালিয়ন। তার বিশেষ খ্যাতি ছিল নারী মূর্তি তৈরির জন্য। তবে বাস্তবজীবনে নারীদের পছন্দ করতেন না তিনি। কারণ তার চোখে পড়তো নারীর হাজারো ত্রুটি। তিনি গজদন্ত দিয়ে এমন এক নারী মূর্তি নির্মাণ করেন যা ছিল নিখুঁত এবং অপূর্ব সুন্দর। নিজের এই সৃষ্টির প্রেমে পড়েন তিনি। অবশেষে প্রেমের দেবী ভেনাসের বরে প্রাণ পায় এই মূর্তি।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2015, 05:06 PM
Updated : 6 July 2015, 05:06 PM

ওভিদের মেটামরফোসিসে উল্লেখিত এই কাহিনিকে নতুন আঙ্গিকে, নতুন রূপে বলেন বার্নার্ড শ। ‘পিগম্যালিয়ন’ নাটকে তিনি লেখেন একজন ধ্বনি বিশেষজ্ঞের কাহিনি। লন্ডনের এক গরীব ফুল বিক্রেতা ককনি মেয়ে এলিজাবেথ ডুলিটলকে সমাজের এক সম্ভান্ত প্রমিত উচ্চারণে ইংরেজি বলা নারীতে পরিণত করেন ধ্বনিতত্ত্বের প্রফেসর হিগিন্স। সফল এই মঞ্চ নাটকটি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অভিনীত হয়ে বহুল প্রশংসা কুড়ায়। ব্রডওয়ের এই জনপ্রিয় মিউজিক্যালটি একাধিক বার রূপায়িত হয়েছে চলচ্চিত্রে। এর মধ্যে সবচেয়ে সফল চিত্ররূপ ১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মাই ফেয়ার লেডি’। জর্জ কুকার পরিচালিত এবং ওয়ার্নার ব্রাদার্স প্রযোজিত ছবিটিতে এলিজা ডুলিটলের ভূমিকায় অড্রে হেপবার্ন এবং প্রফেসর হিগিন্সের ভূমিকায় অভিনয় করেন রেক্স হ্যারিসন।প্রফেসর হিগিন্স যখন প্রথম এলিজাকে দেখেন তখন তাকে এক অদ্ভুত ‘জীব’ ছাড়া আর কিছুই ভাবেন না। এলিজা তার কাছে যেন গবেষণাগারের গিনিপিগ। অনেক হাস্যকর ঘটনার মধ্য দিয়ে এলিজার আচরণ, তার উচ্চারণ তার ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটান হিগিন্স। রাষ্ট্রদূতের অনুষ্ঠানে তাঁকে ডাচেস এলিজাবেথ বলে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এলিজার পরিশীলিত আচরণ, তার চমৎকার কথাবার্তা, তার চালচলনে মনে হয় সে সত্যিই উচ্চ অভিজাত সমাজের এক নারী। এলিজাবেথ হয়ে দাঁড়ায় এক প্রহেলিকা। তার পরিচয় জানতে সবাই উদগ্রিব। অনেক তরুণ তার প্রেমে পড়ে। এদিকে এলিজা মনে মনে ভালোবাসে হিগিন্সকেই। কিন্তু হিগিন্স তার বিষয়ে একান্তভাবেই উদাসীন থাকেন যেন গবেষণায় সাফল্য ছাড়া এলিজার অন্য কোনো গুরুত্ব নেই তার কাছে। এই উদাসীনতা আহত করে এলিজাকে। অভিমানে সে চলে যায় হিগিন্সকে ছেড়ে। কিন্তু পুরনো পেশায় ফিরে গিয়ে সে দেখে আর সেই  জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না সে। অন্যদিকে হিগিন্স ভাবে এলিজা অকৃতজ্ঞ। তবে নিশ্চয়ই ফিরে এসে তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে মেয়েটি অচিরেই। কিন্তু এলিজা ফেরে না। বরং অন্য এক তরুণকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। এলিজার এই সিদ্ধান্তে দারুণ রেগে যান হিগিন্স। এবং অবাক বিস্ময়ে তিনি নিজের মনের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করেন তার এই রাগ আসলে ঈর্ষা। কারণ এলিজাকে নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছেন তিনি। আর হিগিন্সের উপর অভিমান করলেও এলিজা বুঝতে পারে অন্য কোনো পুরুষকে ভালোবাসা বা বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ সে মনের গভীর থেকে একমাত্র হিগিনসের প্রতিই অনুরক্ত। অবশেষে হিগিন্সের কাছে ফিরে আসে এলিজা। ছবিটি তার গানের জন্য যেমন তেমনি রেক্স হ্যারিসন ও অড্রে হেপবার্নের অভিনয়ের জন্যও স্মরণীয় হয়ে আছে। রেক্স হ্যারিসন সম্ভবত তাঁর জীবনের সেরা অভিনয় করেছিলেন এ ছবিতে।

‘মাই ফেয়ার লেডি’ ৮টি অস্কার জিতেছিল। সেরা ছবি (জ্যাক ওয়ারনার), সেরা পরিচালনা (জর্জ কুকার), সেরা অভিনেতা (রেক্স হ্যারিসন), সেরা সিনেমাটোগ্রাফি, সেরা সাউন্ড, সেরা কস্টিউম, সেরা অরিজিনাল মিউজিক, এবং সেরা শিল্প নির্দেশনার জন্য অস্কার পায় ছবিটি। মনোনয়ন পায় আরও চারটি বিভাগে| সেরা ছবি, সেরা পরিচালনা ও সেরা অভিনেতার গোল্ডেন গ্লোব অর্জন করে এটি। সেরা ছবি হিসেবে বাফটা জয় করে।

‘মাই ফেয়ার লেডি’ অবলম্বনে বাংলা ভাষায় নির্মিত হয় ‘ওগো বধূ সুন্দরী’। কাহিনিতে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়। এ ছবিতে অভিনয় করেন উত্তম কুমার, মৌসুমী চ্যাটার্জি, সুমিত্রা মুখার্জি, সন্তোষ দত্ত ও রঞ্জিত মল্লিক।

বাংলা ছবিটিতে দেখা যায়, অধ্যাপক গগন সেন (উত্তম কুমার) ও চিত্রা (সুমিত্রা মুখার্জি) সুখী দম্পতি। গগন সেন একজন প্রথিতযশা ভাষাবিদ ও উচ্চারণ বিশেষজ্ঞ। তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সে অনুষ্ঠান থেকে ফিরতে দেরি হওয়ায় রাগ করেন স্ত্রী চিত্রা, কারণ সেদিনই একটি নিমন্ত্রণে যাবার কথা তাদের। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করতে গগনের একান্ত আপত্তি। চিত্রার সঙ্গে এই নিয়ে তর্ক হয় গগনের। নিমন্ত্রণে একাই চলে যান চিত্রা। আর গগন যায় বইমেলায়।

নিম্নবিত্ত এক অসহায় নারী সাবিত্রী (মৌসুমী চ্যাটার্জি) বিপদে পড়ে আশ্রয় নেয় গগনের বাড়িতে। চিত্রা বাইরে থেকে ফিরে এসে সাবিত্রীকে দেখে আরও রেগে যান এবং অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। গগনের বন্ধু অবলাকান্ত (সন্তোষ দত্ত) একজন চিরকুমার। গগন ও অবলাকান্ত মিলে সাবিত্রীকে উঁচু সমাজের উপযুক্ত ভাষা ও আচরণে তালিম দিতে থাকেন। চিত্রার ভাই সন্দীপ (রঞ্জিত মল্লিক) পরিচিত হন সাবিত্রীর সঙ্গে। সন্দীপ আর সাবিত্রী একে অপরের প্রেমে পড়েন। দুজনের বিয়ের আয়োজন করে গগন। এদিকে চিত্রা খবর পান, বাড়িতে বিয়ের আয়োজন চলছে। তিনি ধরে নেন গগন সাবিত্রীকে বিয়ে করছেন। ছুটে আসেন চিত্রা।

পুরো সিনেমাটি হাস্যকৌতুকে ভরপুর। বিশেষ করে উত্তম কুমারের কমেডি ছিল অনবদ্য। এই ছবিটির কাজ যখন শেষ পর্যায়ে তখন উত্তম কুমারের আকস্মিক মৃত্যু হয়। ছবিটির কয়েকটি দৃশ্যে উত্তমকুমারের ডামি ব্যবহার করা হয়েছে। ডাবিংয়ে কণ্ঠ দিয়েছেন উত্তমের ভাই তরুণ কুমার। উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর ১৯৮১ সালে ছবিটি মুক্তি পায় এবং বিপুল ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করে। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ পরিচালনা করেছিলেন সলিল দত্ত। প্রয়োজনায় ছিলেন আর ডি বনশল। সংগীত পরিচালনা করেছিলেন বাপ্পী লাহিড়ী।