আবারও 'শেষের কবিতা': কবি অমিত রায়ের কথন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'শেষের কবিতা' উপন্যাসে অমিত রায়ের কবি পরিচয় নিয়ে তেমন গুরুত্ব আরোপ করেননি। নিবারণ চক্রবর্ত্তী ছদ্মনামে লেখা তার বেশ কয়েকটি কবিতা থাকলেও অমিতের পরিহাসপ্রিয়তারই আরেকটি প্রকাশ ছিল তার কবিতা। প্রেমে পড়ার পর কয়েকটি কবিতা লিখলেও শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথে বিলীন হয়ে যাওয়াই যেন ছিল তার নিয়তি। উপন্যাসের অমিত রায় যেন ছিল শুধু কথক, স্রষ্টা নয়, সে অন্য কবিদের কবিতা বলেই তৃপ্ত। কিন্তু ‘শেষের কবিতা’র নাট্যরূপে নাট্যকার প্রশান্ত হালদার অমিত রায়কে উদ্ভাসিত করেছেন নতুন অস্তিত্বের আলোয়। এখানে তার রবীন্দ্র-বিদ্রোহ যৌক্তিকতা পায় নিজের সৃষ্টির সমর্থনে।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 June 2015, 09:11 AM
Updated : 22 June 2015, 09:11 AM

রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে থিয়েটার আর্ট ইউনিটের প্রযোজনা ‘শেষের কবিতা’ আত্মপ্রকাশ করে। স্বাভাবিক ভাবেই দেশজুড়ে তখন রবীন্দ্র উদ্মাদনা ছিল এক ভিন্ন মাত্রায়। এখন, চার বছর পর, নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে এই প্রযোজনাটিকে।সম্প্রতি প্রযোজনাটি শিল্পকলার এক্সপেরিমেন্টাল হলে আবার মঞ্চস্থ হলো।

নাট্যদল থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ১৬তম প্রযোজনা ‘শেষের কবিতা’। এর নাট্যরূপ দিয়েছেন প্রশান্ত হালদার, নির্দেশনা মোহাম্মদ বারী।

লাবণ্য ও শোভনলালের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে নাটকের শুরু। শোভনলাল লাবণ্যর বাবার ছাত্র। সে ভালোবাসতো লাবণ্যকে। কিন্তু নিভৃতে।লাবণ্য তাকে অপমান করে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে। তারপরেই অমিত রায় ও তার বন্ধুদের গঙ্গার ধারে পিকনিকের দৃশ্য| সেখানে কেটি, নরেন, ডাব্লিউ, সিসি, লিলি, ডানেশ, মুজতবা, বিমি ও অন্য বন্ধুদেরে সংলাপের মধ্য দিযে অমিতের চরিত্রের বিভিন্ন দিক দর্শককে জানানো হয়। অমিত কবি, খেয়ালী, পরিহাসপ্রিয়, নারী সম্পর্কে উদাসীন নয় তবে নির্মোহ, যদিও নারীদের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। চরিত্রদের কয়েকজন মূল উপন্যাসে থাকলেও ডানেশ, মুজতবা, পরিমল নাট্যকারের সৃষ্টি। বিমি বোস ও মণিভূষণের সামান্য উল্লেখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর প্রশান্ত হালদার তাদের দিয়েছেন সংলাপ ও পৃথক ব্যক্তিত্ব।

বন্ধুরা সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গেলেও অমিত যায় শিলং পাহাড়ে। সেখানে লাবণ্যর সঙ্গে আকস্মিক আলাপ। রুচি ও মননে দারুণ মিল থাকায় তাদের পরিচয় দ্রুত রূপ নেয় প্রণয়ে। যদিও লাবণ্য ছিল দ্বিধান্বিত তবু অমিতের ঐকন্তিক আগ্রহে দুজনের বিয়ে স্থির হয়। এরই মধ্যে অমিতের খোঁজে শিলংয়ে আসে বোন সিসি, তার বান্ধবী কেটি ও বন্ধু নরেন। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় কেটি ছিল অমিতের প্রেমিকা। লাবণ্যকে অমিতের বাগদত্তারূপে দেখে তীব্র ভাষায় তিরষ্কার করে কেটি। এর জের ধরে লাবণ্য সরে আসে বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে। এহেন পরিস্থিতিতে শিলংয়ে আসে শোভনলাল। লাবণ্য উপলব্ধি করে শোভনের প্রতি তার প্রেমের গভীরতা।

শোভনলালের সঙ্গে লাবণ্যর এবং অমিতের সঙ্গে কেটির বিয়ের খবর দিয়ে নাটকের গ্রন্থিমোচন এবং শেষ দৃশ্যে কবিতা ও অমিত-লাবণ্য-শোভন এর ত্রিমুখী কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে নাটকের সমাপ্তি।‘শেষের কবিতা’র পাঠকের কাছে কিছুটা হতাশ লাগতে পারে অমিত-লাবণ্যর প্রেমের বিচ্ছেদে বেদনাবোধের একান্ত অভাবে।যেন বড্ড বেশি সুপারফিশিয়াল ছিল ওদের প্রেম। তাই শোভনের কাছে ফিরে যেতে পেরে লাবণ্য যেন ফিরে পেল তার প্রকৃত ভালোবাসা। আর ‘কেটি’কে ‘কেতকী’তে ফিরিয়ে এনেই তৃপ্ত অমিত।তবে উপন্যাস থেকে পৃথক করে শুধু নাটক হিসেবে দেখতে হলে কবি অমিত রায়ের দ্বন্দ্ব এবং প্রতিষ্ঠানরূপী রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করে নিজের কবিস্বত্তা আর টিকে থাকার সংগ্রাম চিত্রায়নে তা সার্থক। 

প্রশান্ত হালদার(অমিত), ফৌজিয়া করিম অনু(লাবণ্য), সাইফ সুমন(শোভনলাল), আনিকা মাহিন একা(কেটি), মেহমুদ সিদ্দিকী(নরেন), জলি আহমেদ(সিসি) তাদের ভূমিকায় ছিলেন যথাযথ।পোশাক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রযুগের পরিবর্তে বর্তমান কালকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কেটির পরনে তাই স্কার্ট ও টপস। শাহীনুর রহমান ও তার সহযোগী সাকিল সিদ্ধার্থর মঞ্চ পরিকল্পনা ছিল চমৎকার। বিশেষ করে শিলংয়ের পাহাড়ি দৃশ্যের মঞ্চরূপ ছিল সহজ ও সুন্দর। রিপন ও তার সহযোগী মেহমুদ সিদ্দিকীর কোরিওগ্রাফি ভালো লেগেছে। অমিত-লাবণ্যর ঘনিষ্ট দৃশ্যও ছিল চমৎকার।

তবে নাটকটির ঘটনা এত দ্রুত বেগে প্রবাহিত যে, অমিত-লাবণ্যর প্রেমের গভীরতা বোঝার আগেই যেন তা সমাপ্ত হয়ে গেল বলে মনে হয়।লাবণ্যর প্রেমে অমিত পড়েছিল মূলত তার মননের প্রশান্তি ও বুদ্ধির দীপ্তিতে আকৃষ্ট হয়ে। ওর নিজের ভিতরে যে অস্থিরতা ছিল তা লাবণ্যর কাছে প্রার্থনা করেছিল প্রশান্তি ও স্থিরতা। আর অমিত জাগিয়ে তুলেছিল লাবণ্যর অন্তর্গত নারীকে। যে লাবণ্য নিজের ভিতরে ভালোবাসার আবেগকে কখনও অনুভব করতে পারেনি, যে নিজেকে ভাবতো ‘নিতান্তই শুকনো, শুধু বই পড়বো আর পাশ করবো’। সে নিজের ভিতরে অনুভব করেছিল প্রবল আবেগের জোয়ার। অমিতের কাছ থেকেই লাবণ্য শিখেছিল ভালোবাসতে। ‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান, গ্রহণ করেছ যত ঋণী ততো করেছ আমায়’। আর তাদের যে বিচ্ছেদ তার অন্তর্নিহিত কারণ কেটি মিত্তির এবং তার সঙ্গে অমিতের পূর্ব-প্রেম নয় মোটেই। ভালোবাসাকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই অমিতকে বিয়ে না করে দূরে সরিয়ে দেয় লাবণ্য । অমিত নিজেও উপলব্ধি করেছিল যে বিয়ে এবং দাম্পত্য এত বেশি রূঢ় বাস্তব ও গদ্যময় যে তা ভালোবাসার কোমল রোমান্টিকতাকে ধূলিসাৎ করে দেয়।  তাই কষ্ট হলেও লাবণ্যর সিদ্ধান্তকে সঠিক বলেই মনে করেছিল অমিত। প্রেমিক-প্রেমিকার শারিরীক মৃত্যু না হলেও ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে তাদের বিচ্ছেদ প্রয়োজন। মানবমনের একাকীত্ব ও তার অনিবার্য ট্র্যাজেডির এক নূতন রূপ উদ্ভাসিত হয়েছিল ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে। মূল উপন্যাসে অমিত-লাবণ্যর প্রেমের এই ট্র্যাজেডি নাটকে অনুপস্থিত বলে মনে হয়েছে। নাটকটির ব্যপ্তিকাল আরেকটু বাড়লে হয়তো এই অভাববোধটিকে অতিক্রম করা যেত।

তবে নাটকটির সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক নিঃসন্দেহে কবি অমিত রায়ের উদ্ভাসন। ত্রিশের দশকে বাংলা কবিতার আকাশ যখন রবীন্দ্রদীপ্তিতে আচ্ছন্ন সে সময় এক তরুণ কবি আপন কবি সত্তার প্রকাশে ব্যাকুল। এই ব্যাকুলতাই অমিত চরিত্রের অস্তিরতার মূল কারণ। নাটকে শেষ পর্যায়ে নরেনের সঙ্গে অমিতের সংলাপে বোঝা যায় কবি হিসেবে অনর্থক রবীন্দ্র বিরোধিতা না করেও সে খুঁজে নিতে পেরেছে নিজের গন্তব্য। অমিত চরিত্রের পরিণতি তাই রবীন্দ্রপ্রভায় বিলীন হয়ে যাওয়া নয় বরং নিজস্ব স্বকীয়তায় স্নিগ্ধ আলোর বিকীরণে। এই নিজস্ব ভাষ্যেই প্রশান্ত হালদারের নাট্যরূপ সার্থক ।এখানেই থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ‘শেষের কবিতা প্রযোজনার কৃতিত্ব।