গল্প উপন্যাসের জনপ্রিয় কোনো চরিত্রকে চলচ্চিত্রে রূপদান দারুণ চ্যালেঞ্জিং। কারণ পাঠকের কল্পনার সঙ্গে যদি না মেলে তাহলে ভরাডুবি হওয়ার সমূহ আশংকা। তাই সত্যজিৎ রায় যখন ‘সোনার কেল্লা’ ছবিটি তৈরি করেন তখন নিজের সঙ্গে নিজেই যেন প্রতিযোগিতায় নামেন। জয় কার হবে? লেখক সত্যজিতের না চলচ্চিত্রকার মানিকবাবুর?
১৯৭৪ সালে মুক্তি পেল ‘সোনার কেল্লা’। সেই প্রথম রূপালি পর্দায় এলেন ফেলুদা।
ফেলুদা চরিত্রে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তপেশ ছিলেন সিদ্ধার্থ চ্যাটার্জি এবং জটায়ু হয়েছিলেন সন্তোষ দত্ত।
ছবিটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, পেয়েছিল সমালোচকদের অনেক প্রশংসা ও পুরস্কার। কিন্তু রূপালি পর্দায় ফেলুদাকে দেখে সামান্য হতাশ হয়েছিল তার শিশু-কিশোর ভক্তরা, এই ফেলুদা একটু যেন রাশভারী, তারুণ্যের সজীবতায় বইয়ের ফেলুদার মতো নন।
১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ এর বেলাতে একই কথা বলা চলে যদিও চলচ্চিত্র হিসেবে সেটিও ছিল অনবদ্য।ফেলুদার গল্পগুলো চলচ্চিত্রের পর্দায় আনার প্রধান সমস্যা যে তার বিপুল জনপ্রিয়তা সেটি সত্যজিৎ রায় নিজেও উপলব্ধি করেছিলেন। তাই হয়তো ফেলুদার গল্প নিয়ে আর কোনো সিনেমা তৈরি হয়নি তার হাতে।
এরপর আবার বড় পর্দায় ফেলুদাকে নিয়ে এলেন সন্দীপ। ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’(২০০৩), ‘কৈলাসে কেলেংকারী’(২০০৭) ‘টিনটোরেটোর যীশু’(২০০৮), ‘গোরস্থানে সাবধান’(২০১০), ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’(২০১১)-প্রতিটি ছবিতেই সব্যসাচী ফেলুদার ভূমিকায় ছিলেন অনন্য।
সব্যসাচী অভিনয়ের দিক দিয়ে নিঁখুত হলেও বয়স তো বেড়ে যাচ্ছে। অথচ গল্পের ফেলুদা তো যুবক মানুষ। তাই ২০১৪ সালে সন্দীপ রায় যখন নতুনভাবে ফেলুদা সিরিজ শুরু করতে গিয়ে ‘বাদশাহী আংটি’কে রূপালি পর্দায় আনতে চাইলেন তখন বাধ্য হয়েই অন্য ফেলুদার খোঁজ করতে হয়। গল্পের সময়কালও পরিবর্তিত হয়েছে। সত্তরের দশকের কাহিনিকে একুশ শতকের ছাঁচে ঢালা হয়েছে। ফেলুদা সিরিজের প্রথম গল্প যদিও ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’কিন্তু উপন্যাস হিসেবে প্রথম হলো ‘বাদশাহী আংটি’। এই গল্পে জটায়ু নেই। ‘বাদশাহী আংটি’তেই পাঠক প্রথম ফেলুদার ক্ষুরধার বুদ্ধির সঙ্গে পরিচিত হয়। ফেলুদা তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে গোয়েন্দাগিরি শুরু করেননি। চাকরি করেন একটি ব্যাংকে। পুজোর ছুটিতে ফেলুদা , তোপসে এবং তার বাবা লাখনৌ শহরে যান। এখানে রহস্য ভেদে জড়িয়ে পড়েন তরুণ ফেলুদা। এই চরিত্রে সব্যসাচী বয়সের কারণে একবারেই মানানসই ছিলেন না। এবারে ফেলুদা হয়ে এলেন আবীর চট্টোপাধ্যায়।
জটায়ু চরিত্রে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে মানানসই ছিলেন সন্তোষ দত্ত। রবিঘোষও লালমোহন বাবুর চরিত্রে দারুণ ছিলেন। অনুপ কুমার চমৎকার ছিলেন এই চরিত্রে। অনুপ কুমারের মৃত্যুর পর জটায়ুর ভূমিকায় আসেন বিভু ভট্টাচার্য। তোপসে চরিত্রে শ্বাশত চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সাহেব ভট্টাচার্য প্রত্যেকেই ভালো অভিনয় করেছেন। ‘বাদশাহী আংটি’তে কিশোর তোপসের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সৌরভ দাস।
আবার ফিরে আসি ফেলুদার প্রসঙ্গে। আবীর চট্টোপাধ্যায় চেহারায় ফেলুদা এবং অভিনয়েও ভালো। কিন্তু সব্যসাচী যেমন অভিব্যক্তি, হাসি, চোখের চাউনি সবকিছুতেই ছিলেন দুর্দান্ত এবং আদর্শ ফেলুদা তেমন হয়ে উঠতে গেলে আবীর চট্টোপাধ্যায়কে যেতে হবে আরও অনেক দূর।