'সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যেতে দেবো না'

পহেলা বৈশাখে নারীদের উপর সংঘবদ্ধ যৌন সন্ত্রাসের প্রতিবাদ জানানো হলো উৎসব, গান আর নাটকে। শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা ছিল সাংস্কৃতিক কর্মী, নাট্যব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদদের পাশাপাশি জনসাধারণের পদচারণায় মুখর।

গ্লিটজ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2015, 12:13 PM
Updated : 25 April 2015, 01:44 PM

কেউ আবার বৈশাখ বরণকে আর কেউ গান, আবৃত্তি, নাটককে প্রতিবাদের হাতিয়ার করেছেন। তবে কণ্ঠে ছিল একই সুর - আর 'তামাশা' দেখলে চলবে না।   

ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ‘পাল্টা আঘাত: প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ’, ১২টিরও বেশি নাট্য সংগঠনের আয়োজনে ‘ক্ষুব্ধ নাট্যকর্মীদের নাট্য সমাবেশ’ আর অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৃষিয়া নাশতারানের আহ্ববানে ‘আরেক বৈশাখ: এবার উৎসবে হোক প্রতিবাদ’- এই তিন আয়োজন ছিল শুক্রবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

বিকেল তিনটা থেকেই টিএসসি সড়কদ্বীপে বৈশাখি সাজে নারীদের সমাগম ঘটতে শুরু করে। তারা সবাই এসেছিলেন উৎসবের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখের যৌন নিপীড়ণের ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে।ওদিকে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশের প্রস্তুতি। আরেকদিকে টিএসসি প্রাঙ্গনে চলছে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরির কাজ। এখানেই পথনাটকের মাধ্যমে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন প্রাচ্যনাট, আরণ্যক, প্রাঙ্গনে মোর, বটতলা, থিয়েটার আর্ট ইউনিট, তীরন্দাজ, নাট্যধারা, বুয়েট ড্রামা সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফর্ম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ ও বাতিঘরের নাট্যকর্মীরা।

বিকেল চারটার পরপরই 'আরেক বৈশাখ'-এ অংশ নিতে আসারা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই হাত ধরে দাঁড়ালেন। কর্মসূচির শুরু হল জাতীয় সংগীত দিয়ে। রাজু ভাস্কযর্ের পাদদেশ থেকে ভেসে আসা 'আমার সোনার বাংলা'র সঙ্গে দাঁড়িয়ে গলা মেলালেন উপস্থিত সবাই। সাধারণ মানূষদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মামুনুর রশীদ, মেহের আফরোজ শাওন, ইরেশ জাকেরদের মতো তারকারা।

নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ণের প্রতিবাদে নিজের অবস্থান নিয়ে অভিনেত্রী শাওন বললেন, “আমি এখানে শিল্পী হিসেবে আসিনি, নারী হিসেবেও আসিনি। এসেছি একজন মানুষ হিসেবে। সত্যিকারের মানুষ হিসেবে প্রতিবাদ করতে এসেছি। আগে আমরা সবাই ভয় পেতাম প্রতিবাদ করতে। এখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা সবাই পথে নেমেছি, প্রতিবাদ করছি একসঙ্গে। এটাই আমার সবচেয়ে ভাল লাগছে।”

নারী কিংবা পুরুষ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই সকল নির্যাতনের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিৎ বলে মনে করেন ব্যান্ডদল জলের গানের শিল্পী ও নাট্যকর্মী রাহুল আনন্দও।

গ্লিটজকে তিনি বলেন, “প্রতিবাদ আসলে নারী কিংবা পুরুষের, কারো একার ব্যাপার নয়...আমরা মানুষ হিসেবেই সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদ করতে এসেছি, আমাদের মনুষত্ববোধের জায়গা থেকে। মনুষত্ববোধের একটা সার্বজনীন সৌন্দযর্ আছে। আমরা সেই সৌন্দযর্ের পক্ষে। এবং সবধরণের নোংরামির বিপক্ষে। আমার বিশ্বাস, কেবল শিল্পী, সংস্কৃতি কর্মী কিংবা ছাত্রসংগঠন হিসেবে নয়, সবাই যদি মানুষ হিসেবে এগিয়ে আসি, তাহলেই সমাজের অশুভ সব কিছু অনেক দূরে চলে যাবে।”

ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদ সমাবেশে ততক্ষণে প্রতিবাদী গান পরিবেশন করছেন সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের সদস্যরা। ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম নেত্রী লাকি আক্তারের সঞ্চালনায় মঞ্চে উঠে একে একে বক্তব্য দেন লিটন নন্দী, সাহিত্যিক জাকির তালুকদার, অধ্যাপক এ এম রাশেদা। নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, অভিনেতা ইরেশ জাকের, অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন, জ্যোতিকা জ্যোতি, ব্যান্ডদল শহরতলীর কণ্ঠশিল্পী জিল্লুর রহমান সোহাগ, ব্যান্ডদল শিরোনামহীনের কণ্ঠশিল্পী তানজির চৌধুরী তুহিনও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। জলের গান পরিবেশন করে তাদের গান, ‘জাগো বাহে কুন্ঠে সবাই’।

পহেলা বৈশাখে নারীদের ওপর নিপীড়নের ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী লাঞ্ছিতাদের বাঁচাতে গিয়ে আহত হওয়া ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দী বলেন, “আজ সকলেই এসেছেন প্রতিবাদ জানাতে, সেদিন কিন্তু একই অবস্থা ছিল না। ভীড়ের মধ্যে নারীদের ওপর হামলাকারীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই, নাকি বহিরাগত- সেটা আমরা বলতে পারছি না। কিন্তু যারা সেদিন উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিল তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন বাঙালির সংস্কৃতি এবং সচেতনার কেন্দ্র হিসেবে উদযাপিত হয়। সেই প্রাঙ্গনের ঐতিহ্য সংকীর্ণমনাদের কারণে আমরা নষ্ট হতে দেব না।”

তিনি আরও বলেন, “হুমায়ূন আজাদ স্যার তার কবিতায় বলেছিলেন, 'সবকিছু চলে যাবে নষ্টদের দখলে'। তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই আমরা বলতে চাই, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যেতে দেব না।”

নাট্যব্যাক্তিত্ব মামুনুর রশীদ লিটন নন্দীর বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেন, “আমি আগেও এ ধরনের প্রতিবাদে সামিল হয়েছি, কিন্তু কাজ হয়নি। এর কারণ আমরা সবাই শেষ পর্যন্ত তামাশা দেখি। জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় লজ্জা- আমরা কেবল তামাশা দেখি। লিটন নন্দীর মতো প্রতিটি লোক যদি সেদিন প্রতিবাদ করতো, এসব দুষ্কৃতিকারীরা বানের জলের মতো ভেসে যেত।”

“আমরা যেন আর তামাশা না দেখি। অন্যায়কে রূখে দাঁড়াই। তাহলেই আমাদের প্রতিবাদ সফল হবে।”

মামুনুর রশীদের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে শহরতলীর কণ্ঠশিল্পী জিল্লুর রহমান সোহাগ বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ভবিষ্যত গড়ে তোলে। টিএসসিতে দেশের সব সংস্কৃতি, সচেতনতার চর্চা হয়। অথচ কি লজ্জা - এই টিএসসিতেই দুটি ঘটনা ঘটলো। অভিজিৎ খুন হলেন আর পহেলা বৈশাখে আমাদের নারীরা লাঞ্ছিত হলেন। আর আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখি?”

শিরোনামহীণের কণ্ঠশিল্পী তানজির সি তুহিন প্রশাসনের নিশ্চুপ থাকার বিষয়ে আঙুল তুলে বললেন, “আমার শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছিল এই ঘটনার খবর পাওয়ার পর। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবখানে আজ রাজনীতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি, বুয়েটে রাজনীতি। এত রাজনীতি কেন? আর রাজনীতি যদি করতেই হয়, তাহলে সেটা ভাল কিছুর জন্য নয় কেন? আর যারা এসব ঘটনা দেখেও চোখ বন্ধ করে রেখেছেন, তাদের চোখ গরম পারদ ঢেলে অন্ধ করে দিতে হবে। এরকম অন্ধ প্রশাসন আমাদের দরকার নাই।”

অভিনেতা ইরেশ জাকের মনে করেন, সম্মিলিত প্রতিবাদের মাধ্যমেই এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব। 

“অনেকেই বলছেন, আমাদের দিয়ে কিছু হবে না। আমাদের লজ্জা হওয়া উচিৎ। আমি মনে করি, আমাদের দিয়েই হবে।”

“একজন যখন খারাপ কিছু বলবে- দশজনে তার প্রতিবাদ করতে হবে। পাগলের চিৎকার দশজন মিলেই প্রতিহত করা সম্ভব। আজ যেভাবে আমরা দেশের সবখানে একসঙ্গে প্রতিবাদ করছি- এতেই নারীদের অসম্মানকারীদের কণ্ঠরোধ হবে।”

অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি বলেন, যৌন সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে রূখে দাঁড়াতে হবে নারীকেই। হানতে হবে পাল্টা আঘাত।

“নারীদের কাছে অনুরোধ, যেখানেই এরকম ঘটনা ঘটবে, পাল্টা আঘাত করুন। আর কতদিন চুপ করে থাকবেন? আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।”

উৎসবের আবহে আরেকবার বৈশাখকে বরণ করে নেওয়ার আয়োজনের আহ্বায়ক তৃষিয়া নাশতারান গ্লিটজকে বলেন, “পহেলা বৈশাখের যৌন নিপীড়ণের ঘটনার পর ফেইসবুকে অনেকেই আমাদের বুদ্ধি দিতে এসেছেন যে, সামনের বছর থেকে যেন আমরা টিএসসি বর্জন করি। এটা কিন্তু পক্ষান্তরে বর্ষবরণের দৃশ্যপট থেকে নারীকে সরিয়ে দেওয়ার আরেকটি প্রয়াসমাত্র। আমরা বলছি, আসছে বৈশাখে আমরা দ্বিগুণ উৎসাহে এই টিএসসিতে এসেই নববর্ষ পালন করবো। তখন আমরা ভাবলাম, সামনের বছর আসতে তো অনেক দেরি। এখনই কেন আমরা বৈশাখকে পালন করছি না?আমরা তাই এখনই সমবেত হয়েছি। আমরা আজ আনন্দ দিয়েই প্রতিবাদ করবো। গান, আবৃত্তি, উৎসব দিয়েই প্রতিবাদ করবো।”