ঢাকাই সিনেমার বর্তমান বাজারে হিন্দি, তামিল কিংবা ওপার বাংলার সিনেমার ‘অনুকরণে’ সিনেমা তৈরির প্রয়াসই বেশি চোখে পড়ে। এর মধ্যে আবার ঢাকার সিনেমা হলগুলোতে আামদানি করা হিন্দি ছবি প্রদর্শনও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যেই ছোট পর্দার নির্মাতা শিহাব শাহিন একটি মৌলিক গল্প থেকে ভালো চিত্রনাট্যের পরিচ্ছন্ন সিনেমা তৈরির সাহস দেখালেন। সেই সঙ্গে পরোক্ষভাবে হলেও যোগ করলেন অনেক দিনের ভুলে যাওয়া আপ্ত বাক্যটি - সংঘাত আর ঘৃণার আগ্রাসনকে সংস্কৃতি আর প্রেম দিয়ে জয় করতে হয়।
ছোট্ট এক মফস্বল শহর হৃদয়পুর। অনেক বছর আগে তৈরি এক কারখানাকে ঘিরে গড়ে ওঠা শহরটিতে ক্ষমতাশালী এক পরিবারের মেয়ে নীলা। তার প্রভাবশালী বাবা এবং চাচার কারণেই ছোটবেলার বন্ধু আবীরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। আবীরদের পরিবারের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। যার ফলে একটা সময় আবীরের পরিবারকেই হৃদয়পুর ছেড়ে চলে আসতে হয় ঢাকায়। অনেক বছর পর ভাগ্যের কারসাজিতেই আবীর ফিরে আসে হৃদয়পুরে। সেখানে আরও একবার শুরু হয় নীলার সঙ্গে তার প্রেম কাহিনি। কিন্তু বহু বছর আগেকার সেই সংঘাত কি পিছু ছাড়বে এই প্রেমিকজুটির? সেখান থেকেই শুরু হয় সিনেমার আসল গল্প।
সিনেমার খলনায়ক, নীলার চাচাতো ভাই এবং একই সঙ্গে হৃদয়পুরের প্রভাবশালী ছাত্রনেতা ও নীলার পাণিপ্রার্থী ড্যানির চরিত্রে ইরেশ জাকেরের অভিনয় ছিল অনবদ্য। ড্যানির চরিত্রের দুটি দিক দেখানো হয়েছে সিনেমায়। একদিকে সে নীলার প্রেম প্রত্যাশী, নীলার মন জয় করার জন্য প্রেমের ক্ষেত্রে কিছুটা বোকাসোকা ড্যানি যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত।আরেকদিকে সে শহরের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ছাত্রনেতা। প্রয়োজনে নিষ্ঠুর হতেও দ্বিধা নেই তার। বিপরীতধর্মী এই দুই রূপেই ইরেশ জাকের ছিলেন দুর্দান্ত। নতুন দিনের বাংলা সিনেমায় আরও অনেক খলচরিত্রে তাকে দেখার অপেক্ষা রইলো।
সিনেমার ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন মিশা সওদাগর। বরবরই ঢাকাই সিনেমায় এই অভিনেতাকে খলচরিত্রে দেখা গেলেও এবারে তার চরিত্রটি ছিল ইতিবাচক। আবীরের স্নেহপূর্ণ দুলাভাইয়ের চরিত্রে মিশা সওদাগর দিয়েছেন তার পুরোটুকুই। তবে একটি মারামারির দৃশ্যে ইরেশ জাকেরের মুখোমুখি হওয়ার সময় মনে করিয়ে দিয়েছেন খলচরিত্রে অভিনয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা। ঢাকাই সিনেমার সাবেক আর বর্তমান খলনায়কের সম্মুখ যুদ্ধের দৃশ্যটি ছিল খুবই উপভোগ্য।
সিনেমাটির অন্যতম সম্পদ এর গান এবং দৃশ্যায়ণ। হাবিব ওয়াহিদ আর সাজিদ সরকারের সংগীত পরিচালনায় সিনেমার টাইটেল ট্র্যাক ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ অনেকদিন মনে রাখার মতো একটা গান। তাহসানের কথায় এবং কণ্ঠে গানটি পেয়েছে এক অনন্য মাত্রা। এর সঙ্গে সিলেট এবং বান্দরবনের নয়নাভিরাম লোকেশনে গানটির দৃশায়ণও ছিল চমৎকার। বিশেষ করে গানের একটি অংশে পাহাড়ের চূড়ায় মম-শুভর দাঁড়িয়ে থাকার পটভূমিতে মেঘ চিরে সূর্যের আলো এসে পড়ার দৃশ্যটিও ছিল খুবই সুন্দর।
ক্যামেরার কাজ সিনেমাজুড়ে অনেকবারই চমকে দিয়েছে। হৃদয়পুর শহরটিকে সিলেটের জালালাবাদের কাছে দেখানোয় সুন্দর লোকেশনে নানা নান্দনিক দৃশ্যের কমতি ছিলনা। তবে কয়েকটি দৃশ্যে ক্যামেরার ফোকাস নিয়ে গড়বড় হওয়াটাও চোখে লেগেছে বেশ। আর ছোটখাট কিছু গোঁজামিল, যেমন, মারামারির পরের দৃশ্যেই নায়কের চোটহীন সজীব চেহারা, কিংবা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পরই শুকনো পোশাকে নায়ক-নায়িকার ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে দৌড়ানো- সিনেমার ধারাবাহিকতা নষ্ট করেছে।
রোমান্টিক সিনেমা হলেও ‘ছুঁয়ে দিলে মন’-এ পরোক্ষভাবে হলেও উঠে এসেছে দেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা। সিনেমায় নায়ক নোয়াখালির উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে গিয়ে হরতালের ফেরে পড়ে পৌছে যায় হৃদয়পুরে। সেখানে গিয়ে আবার দেখা যায় একই এলাকার বাসিন্দা হলেও মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। আবিরের বন্ধু যখন এর কারণ জানতে প্রশ্ন করে, “কোন দুই দল?”, তখন খলচরিত্র ড্যানির সাগরেদের উত্তরও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সেটা হলো, “ আপনি কি এই দেশে থাকেন না? আপনি জানেন না কোন দুই দল?”
মজার ব্যাপার হল, এই দুই পক্ষের মানুষকে সম্প্রীতির বাঁধনে বাঁধতে এগিয়ে আসতে হয় আবীরকেই। আর এ জন্য সে গড়ে তোলে এলাকার শিশু-কিশোরদের নিয়ে একটি নাচ এবং গানের দল। এরা সবাই মিলে যখন একই মঞ্চে “কারার ওই লৌহ কপাট”, “তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর”-এর মতো প্রতিবাদী পরিবেশনা দেখায়, তখনই পারস্পরিক ঘৃণা আর চরমপন্থা ভুলে এক হয়ে যায় দুই পক্ষের মানুষ। রাজনৈতিক সংঘাত আর মৌলবাদী চিন্তায় বিভক্ত জাতিকে সংস্কৃতির বাঁধনেই মেলানো সম্ভব - এই ভাবনা দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াসটি ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়।
সব মিলিয়ে পরিচ্ছন্ন একটি সিনেমার মাধ্যমে ভালোবাসা, ক্ষমতার লড়াইয়ের মতো বাণিজ্যিক বিষয়ের উপস্থাপনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বক্তব্যও তুলে ধরা ‘ছুঁয়ে দিলে মন’কে সফল সিনেমাই বলতে হবে। নির্মাতা শিহাব শাহিন তার প্রথম সিনেমাতেই চিনিয়ে দিয়েছেন তার জাত। তার কাছ থেকে আরও ভালো কিছুর প্রত্যাশা এখন থেকে করা যেতেই পারে।