সুরের স্বজন বশির আহমেদ

সংগীতজ্ঞ ও লেখক ফজল-এ-খোদার ছেলে ওয়াসিফ-এ-খোদা। বাবার মতোই লেখালেখির সঙ্গে জড়িত তিনি।

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 April 2015, 08:16 AM
Updated : 6 April 2015, 08:16 AM

ছেলের লেখালেখি বিষয়ে জ্ঞান এবং নিজের লেখায় তার সহযোগিতার কথা বিভিন্ন সময়ে স্বীকার করেছেন ফজল-এ-খোদা। ফজল-এ-খোদার অত্যন্ত ঘনিষ্ট একজন সংগীতশিল্পী বশির আহমেদ। ব্যাক্তিগত পরিসরে বশির আহমেদকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে ওয়াসিফ-এ-খোদার। সেই অভিজ্ঞতা এই লেখায় তুলে ধরেছেন তিনি।

‘চিত্রালী’, ‘পূর্বাণী’ না ‘সিনেমা’ ঠিক মনে নেই- এর কোনো একটিতে একবার সুরকার ও গীতিকার জুটির তালিকা ছাপা হয়েছিল। সেখানে ছিল বশির আহমেদের সঙ্গে ফজল-এ-খোদার নামটি। ফজল-এ-খোদা আমার পিতা। আমাদের বাসায় নিয়মিত আসতেন বশির আহমেদ। শিল্পী বশির আহমেদের সঙ্গে আমার বাবার সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে, তিনি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিলেন। কবিতা মোক্ষম সুরের খেয়ায় শিল্পীর কণ্ঠ থেকে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিতে পারে। আর সেটা তখনই সম্ভব হয় যখন গানের বাণী রচয়িতার সঙ্গে সুরস্রষ্টার বোঝাপড়ার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। পরস্পরের প্রতি আস্থা তৈরি হয়। পারস্পরিক এই নির্ভরশীলতার গুণেই বশির আহমেদ ও ফজল-এ-খোদার জুটি বহু সফল গানের জন্ম দিতে পেরেছেন।

নিজ বাড়িতে, বসার ঘরে গানের সুর করছেন বশির আহমেদ। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

প্রথমেই বলতে হয় ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের কথা। সময় টেলিভিশনে এই গানের ওপর এক অনুষ্ঠানে ফজল-এ-খোদা বলেছিলেন, ‘আমি বশিরের জন্যই গানটি লিখেছিলাম।’ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘সংগীতভাবনা’ নামে প্রবন্ধের বইতে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ শিরোনামের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো যায় - এরকম একটি গানের কাঠামো এবং সুর নিয়ে বশির আহমেদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তিনি গানটি লেখার পর বশির আহমেদকে দিয়েছিলেন কিন্তু তখন তা রেকর্ড করেননি। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে মোহাম্মদ আবদুল জব্বার নিজের সুরে গানটি রেকর্ড করেন। তারপর অনেক দিন কেটে গেছে।

একদিন বশিরচাচার বাসায় গেছি। তিনি তাঁর একটি গানের খাতা থেকে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটির সম্পূর্ণ বাণী পড়ে শোনালেন এবং বললেন, ‘তোমার বাবা আমাকে গানটি দিয়েছিল। আমি সুর করে তখন কয়েকটি অনুষ্ঠানে গেয়েছিও।’

কন্যা হোমায়রা বশিরের সঙ্গে বশির আহমেদ। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

আশির দশকের শেষে অথবা নব্বই দশকে ১৬ ডিসেম্বর বা ২৬ মার্চের আগে ঠিক মনে নেই- একদিন রেডিওতে গেছি। বাবার কক্ষে বশির আহমেদ ছিলেন। আমাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হলেন - ‘গতকাল টেলিভিশন দেখেছো?’ আমি না-সূচক মাথা নাড়াতেই বললেন - ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ তো গেয়ে দিলাম।’ তখন টেলিভিশন বলতে বিটিভি আর বশির আহমদ গানটি গেয়েছিলেন আধুনিক গানের অনুষ্ঠান ‘মালঞ্চ’-এ। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানকে ঘিরে এই স্মৃতি খুব মনে পড়ে।

আশির দশকে রেডিওতে ফজল-এ-খোদার লেখা একটি দেশের গান বশির আহমদের সুরে ও কণ্ঠে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। গানটি সেইসময় রেডিওতে প্রতিদিন বাজতো। এ গানে সহকণ্ঠ দিয়েছিলেন কনকচাঁপা।

“একটি কণ্ঠে হাজার কণ্ঠে কণ্ঠে

দিকে দিকে তোলে ধ্বনি, লক্ষ প্রতিধ্বনি

-বাংলাদেশ!”--

গানটির কথা বশির আহমেদের খুব প্রিয় ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা অংশুমান রায়ের সুর ও কণ্ঠে--

“শোনো একটি মুজিবরের থেকে

লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি

আকাশে বাতাসে ওঠে রনি”--

আশি দশকের শেষে তোলা ছবিতে শিল্পী পরিবার। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

গানটির কথা উল্লেখ করে বশির চাচা আমাকে বলেছিলেন - ‘আমাদের এই গানের একটি কণ্ঠ সে তো বঙ্গবন্ধুরই।’ পরবর্তী সময়ে এই গানের ওপর ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রীদের চমৎকার কোরিওগ্রাফি চিত্রায়িত করেছিল বিটিভি।

বাংলাদেশ রেডিওর প্রভাতি ম্যাগাজিন ‘দর্পণ’-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমার বাবার লেখা আরেকটি দেশের গানের সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন বশির আহমেদ। সমবেত কণ্ঠে গাওয়া গানটি এখনো কানে লেগে আছে--

“অতীত বর্তমান ভালোবেসে

সমতট থেকে বাংলাদেশে

দেশের গান কত লেখা হলো

সুর হলো গাওয়া হলো শোনা হলো!

বন্ধু এবার এসো বলি

কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনি তুলি-

দেশ আমাদের দেশ

সোনার বাংলাদেশ

স্বাধীন বাংলাদেশ॥”

দেশের গানে যে আবেগ, বীররস সঞ্চারী সুরের যে আবেশ দরকার হয় তার সবই ছিল এতে।

স্ত্রী কণ্ঠশিল্পী মীনা বশিরের সঙ্গে বশির আহমেদ। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

বশির আহমেদের জন্ম কলকাতার খিদিরপুরে। সওদাগর পরিবারে। ১৯৩৯ সালে। উর্দু ছিল তাঁর পরিবারের ভাষা। গানের হাতেখড়ি ওস্তাদ বেলায়েত হোসেন খানের কাছে। গানের জন্য চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সে পাড়ি জমান বোম্বে (মুম্বাই)।

১৯৯৭ সালে লিয়াকত হোসেন খোকনকে এক সাক্ষাৎকারে বশির আহমেদ বলেন, “সে বয়সে গান ছাড়া আর কিছুই বুঝতাম না। গান আমাকে পেয়ে বসেছিল। রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল গান। বাবা-মাকে না বলেই এক অর্থে পালিয়ে চলে গেলাম। বোম্বে গিয়ে উঠলাম গীতিকার রাজা মেহেদীর বাসায়। তিনি আমাকে ছেলের মতো জানতেন। সুরকার নওশাদের সহকারী ছিলেন মোহাম্মদ শফি। তাঁর সঙ্গেও আমার পরিচয় ঘটল। তিনিই আমাকে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। বোম্বেতে থাকাকালীন সেই ১৯৫৪-৫৫ সালে গীতা দত্ত, আশা ভোঁসলের সঙ্গে ডুয়েট গান গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তালাত মাহমুদের সঙ্গে সে সময় আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।” মুম্বাইতে বড়ে গোলাম আলী খাঁর কাছেও তালিম নেওয়ার সুযোগ ঘটে তাঁর।

১৯৬০ সালে তালাত মাহমুদের সঙ্গে ঢাকা আসেন গান গাওয়ার জন্যে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা একসঙ্গে স্টেজে গান করেন। তারপর ফিরে গেলেও গানের টানেই কিছুদিন পরপর ঢাকা আসতেন বশির আহমেদ। এই আসা-যাওয়ার মধ্যে এখানে উর্দু চলচ্চিত্র ‘তালাশ’-এ (১৯৬৩) গান গাওয়ার সুযোগ পান।

এদেশে তৎকালীন সময়ে উর্দু চলচ্চিত্র নির্মিত হতো নিয়মিত। আর উর্দু ছবির গানের প্রয়োজনেই কদর বাড়তে শুরু করলো বশির আহমেদের। তাঁর কণ্ঠটিও ছিল উর্দু গানের। ‘তালাশ’ ছবিতে নায়ক রহমানের ঠোঁটের সবগুলো গান গেয়েছিলেন তিনি। একটি গান ছিল-‘কুছ আপনি কাহিয়ে, কুছ মেরি সুনিয়ে’। এরপর জহির রায়হানের উর্দু ছবি ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪)-এ গান করেন।

বশির আহমেদ উর্দুভাষার গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পীও। উর্দু চলচ্চিত্র ‘কারওয়াঁ’ (১৯৬৪)-তে তাঁর নিজের লেখা ও সুরে ‘যব তুম আকেলে হোগে হাম ইয়াদ আয়েঙ্গে’ জনপ্রিয় হয়। অন্য আরও উর্দু চলচ্চিত্রে কাজ করলেও ‘দরশন’ (১৯৬৭) তাঁকে নিয়ে যায় খ্যাতির শীর্ষে। এই চলচ্চিত্রের গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন তিনি। বাংলা চলচ্চিত্রেও সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তারপরেই।

‘ময়নামতি’ (১৯৬৯) চলচ্চিত্রে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘ডেকো না আমারে তুমি কাছে ডেকো না’, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’। ‘মধুমিলন’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে শহীদুল ইসলামের লেখা ও ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া ‘কথা বলো না বলো ওগো বন্ধু/ছায়া হয়ে তবু পাশে  রইব’- গানগুলো সুরস্রষ্টা বশির আহমদের উচ্চমানতার নিদর্শন।

ফজল-এ-খোদা ও বশির আহমেদ একসঙ্গে গান লিখেছেন ‘মনের মানুষ’, ‘অশান্ত প্রেম’, ‘স্বামীর সোহাগ’, ‘বধূবরণ’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে। ‘মনের মানুষ’-এর একটি গান তো খুব জনপ্রিয়-- ‘প্রেমের এক নাম জীবন (মানুষের গান আমি শুনিয়ে যাব)’। সত্তর দশকের শেষে উর্দু চলচ্চিত্র ‘দরশন’ বাংলায় রূপান্তরিত হয়। এর গানগুলো বাংলায় রূপান্তর করেন ফজল-এ-খোদা।

পুত্র রাজা বশির, কন্যা হোমায়রা বশির, জামাতা ও নাতির সঙ্গে শিল্পী দম্পতি। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

ষাটের দশকে রেডিওতে খান আতাউর রহমানের লেখা ও সুরে ‘যা রে যাবি যদি যা’ এবং ‘আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো’-- গান দুটি বশির আহমেদকে বাংলাগানে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। তাঁর আগেই আমাদের বাংলা গানে লায়লা আরজুমান্দ বানু, আনোয়ার উদ্দীন খান, ফেরদৌসী রহমান, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, ফরিদা ইয়াসমীন প্রমুখ ছিলেন প্রতিষ্ঠিত। তাদের পরে মাহমুদুন্নবী, সৈয়দ আবদুল হাদী, খুরশীদ আলম প্রমুখের পাশাপাশি সংগীতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসেবে আবির্ভূত হন বশির আহমদ।

মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের কণ্ঠে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফজল-এ-খোদা-বশির আহমদ জুটির একটি গান--

“ভাবনা আমার আহত পাখির মতো

পথের ধুলোয় লুটোবে

সাত রঙে রাঙা স্বপ্ন বিহঙ্গ

সহসা পাখনা গুটোবে

এমন তো কথা ছিল না॥”

কথা এবং সুরের অপূর্ব মেলবন্ধনের উদাহরণ এ গানটি। পুরো আশির দশক এবং তারপরেও একটা উন্মাতাল সময় গেছে এই জুটির। এমন কোনোদিন ছিল না তাঁরা গান নিয়ে একসঙ্গে বসেননি। কখনও সারাদিন-- অফিস সময়ে রেডিওতে, অফিসের পরে সন্ধ্যায় বশির আহমদের বাসায়। কখনো বশিরচাচা বাবার সঙ্গে অফিস শেষে আমাদের বাসায় চলে আসতেন। বশিরচাচা এলেই বাবার বিছানায় হারমনিয়াম বের করে দেওয়া হতো। বশির আহমদ হারমনিয়াম সামনে নিয়ে বসতেন আর বাবা তাঁর টেবিল থেকে খাতা-কলম নিয়ে পাশে বসে যেতেন। কতদিন যে তাঁদের এভাবে দেখেছি। বশির চাচা বলতেন-- ‘এভাবে না বসলে গান তৈরি হয় না।’

মনে আছে, একদিন বাবা বশির চাচার বাসায় গিয়ে অনেক রাত করে বাসায় ফিরেছিলেন। তখন  আমরা থাকতাম আগারগাঁওয়ে সরকারি বাসায় আর বশিরচাচার বাসা মোহাম্মদপুরে। গানের মধ্যে এতই বুঁদ হয়ে ছিলেন যে ঘড়ির কাঁটা কখন রাত বারোটা পার করে একটায় গিয়ে পৌঁছেছে বাবা সেটা খেয়ালই করেননি। বাবার কাছে শুনেছি, বশির আহমেদ গানের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। গানে সুর করার সময় তাঁর মনমতো না হলে কখনও একটি শব্দ বা পুরো লাইন কিংবা পুরো অন্তরা বদলে ফেলতে হতো। আর তাঁর গানের কথা হতে হবে সরলসোজা- যেন শোনামাত্রই শ্রোতা বুঝতে পারে। সহজ-সাধারণ কথার গানেও সুরের এমন একটা কারুকাজ সৃষ্টি করতে তিনি পারঙ্গম ছিলেন যে শুনে মনে হবে ইচ্ছে করলেই গাওয়া যাবে। কিন্তু শাস্ত্রীয়সংগীতে দখল না-থাকলে সে-গানের রস হজম করে পরিবেশন করা মোটেও সম্ভব নয়।

বশির আহমেদের কণ্ঠে একটা অন্যরকম মাধুর্য ছিল। তিনি তাঁর সুরের মায়াজালে সহজেই শ্রোতাকে আবিষ্ট করতে পারতেন। ফজল-এ-খোদার লেখা যেসব গান তিনি নিজের সুরে গেয়েছেন-- ‘বন্ধু সেই দেখা কেন শেষ দেখা হলো’, ‘ সেই যে কবে ঘর ছেড়েছি/আর তো ঘরে ফেরা হলো না’, ‘আমি বাউল মেঘমালা’, ‘চলো আমরা আবার আগের মতো’, ‘আমি বড়ো ধাঁধায় পড়েছি’, ‘সুখপাখিটা সুখের কথা কয় না’, ‘প্রেম সব কিছু নয়’, ‘ফুল ভালোবাসি/পাখি ভালোবাসি’, ‘চেনা মানুষ অচিন হলাম’। আরও গানের কথা বলা যায়, কলেবর বেড়ে যাওয়ার ভয়ে লোভ সংবরণ করতে হচ্ছে। বশির আহমদের সুরে, গায়কীতে এমন একটা নিজস্বতা আছে, যা তাঁকে অন্যদের চেয়ে বিশিষ্ট করেছে।

নিজের স্টুডিওতে কন্যা হোমায়রা বশিরের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠের গান রেকর্ড করছেন। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

ফজল-এ-খোদা-বশির আহমদ জুটি বিচিত্র ধরনের গান দিয়ে আমাদের সংগীতভুবনকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের গানে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও আছে। একটি গান চিঠির আঙ্গিকে তৈরি করেছিলেন তাঁরা। গানটি গদ্যে লেখা; প্রেমিক তার প্রেমিকাকে লিখছে-- ‘প্রিয়তমা, এই তো সেদিনের কথা! তবু মনে হয় কতোকাল দেখিনি তোমায়...’। গানটি রেডিওতে প্রায়ই শোনা যায়। এটি একটি ব্যতিক্রমী গানের উদাহরণ হতে পারে।

করেছেন বাউলঅঙ্গের গানও। রথীন্দ্রনাথ রায়ের গাওয়া ‘মন ভাব কি জমে ধর্মে কর্মে’ এবং কিরণচন্দ্র রায়ের ‘কী কালি লাগাইলি সংসারে’ গান দুটির কথা। বশির আহমেদ ও ফজল-এ-খোদা জুটির গানের ভুবন থেকে বাদ থাকেনি ইসলামি গানও। রমজানের ওপর লেখা একটি গান বশির আহমেদের কণ্ঠে রেডিওতে এখনও প্রচার হয় সেহরির অনুষ্ঠানে। অনেকেই শুনেছেন সে গান- ‘শোনাই শোনো গল্পে শোনা কাহিনি!’

বিটিভিতে ‘আমার যতো গান’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান শুরু হয় আশি দশকের মাঝামাঝি বা তারপরে। দর্শকদের উপস্থিতিতে একজন শিল্পীকে নিয়ে এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান। কবি আবু হেনা মোস্তফা কামালের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সেইসময়। অনুষ্ঠানটিতে আমন্ত্রিত শিল্পী প্রথমে নিজের পছন্দ মতো তিনটি গান শোনাতেন। তারপর সামনে বসা দর্শকদের অনুরোধের স্লিপ দেখে শিল্পী গাইতেন তাঁর বেছে নেওয়া গানগুলো। আর গানের মাঝে চলতো শিল্পীর সঙ্গে উপস্থাপকের আলাপচারিতা। এ অনুষ্ঠানে একবার এলেন বশির আহমেদ। তাঁর পছন্দের তিনটি গানের মধ্যে একটি ছিল নিজেকে নিয়ে, যেটি লিখিয়ে নিয়েছিলেন সৈয়দ শামসুল হককে দিয়ে, একটি আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা ও আবদুল আহাদের সুরে ‘তোমার কাজল বেশ ছড়াল বলে/এই রাত এমন মধুর’, অন্যটি ফজল-এ-খোদার লেখা ও নিজের সুরে ‘পারি না সহিতে পারি না কহিতে/কী জানি কী হয়ে গেলো আঁখিতে আঁখিতে’। কী অসাধারণ সুর ও গায়কী ছিল এ গানের- যাঁরা শুনেছেন তাঁরা বলবেন।

উচ্চাঙ্গসংগীত গাওয়ার মতো দক্ষ কণ্ঠ ছিল বশির আহমদের। রাগভিত্তিক গানগুলো কত সহজে ধারণ করত তাঁর কণ্ঠ। রাগাশ্রয়ী এধরনের আরও অনেক গান করেছেন ফজল-এ-খোদার। যেমন-- ‘ভালোবেসো না/আমাকে আর ভালোবেসো না’, ‘কী করে গাহিব/সুর যেন সেজেও সাজে না’, ‘সজনী রজনী যায় চলে যায়’,  ‘ওগো নন্দিনী আনন্দিনী/প্রেম বন্দিনী রজনীগন্ধা’, ‘জীবন শুধু প্রেমের বাঁধন আর কিছু নয়’ ইত্যাদি।

বশির আহমেদের সুরে গান করেছেন ফেরদৌসী রহমান, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন থেকে শুরু করে তরুণতর অনেক শিল্পী। একইভাবে আবদুল আহাদ, খান আতাউর রহমান, খন্দকার নুরুল আলম, সুবল দাস, রবীন ঘোষ, সত্য সাহা, আজাদ রহমান থেকে শুরু করে ইমন সাহার মতো তরুণ সুরকারের গানও করেছেন বশির আহমেদ। আজাদ রহমানের সুরে ফজল-এ-খোদার কথায় তাঁর গাওয়া রেডিওর একটি গান--

“হৃদয়ে এক পাথর আছে

লাগলে আঘাত আগুন জ্বলে

হৃদয়ে এক সেতার আছে

লাগলে ছোঁয়া কথা বলে

তুমি আগুন জ্বালাবে নাকি সুর বাজাবে

তুমিই জানো আমি জানি না॥”

বশির আহমদ কণ্ঠ দেবেন বলেই বাংলা খেয়াল বিশেষজ্ঞ আজাদ রহমান গানটিতে শাস্ত্রীয় সংগীতের আবহ সৃষ্টি করেন।

টেলিভিশন অনুষ্ঠানে গান গাইছেন বশির আহমদ। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

বশির আহমদের স্ত্রী মিনা বশির একজন কণ্ঠশিল্পী। তাঁদের এক মেয়ে এক ছেলে- হোমায়রা বশির ও রাজা বশির। তারাও গানের জগতের মানুষ। বাবার কাছেই তাদের হাতেখড়ি ও গান শেখা। অর্থাৎ বশির আহমদের পরিবার শিল্পী পরিবার। মিনা বশির নেপালি। তাঁর আরও একটি পরিচয় আছে। তিনি কলকাতার বাংলা সিনেমা ‘পৃথিবী আমারে চায়’-এর নায়িকা মালা সিনহার চাচাতো বোন। ১৯৬৮ সালে বিয়ের আগে তাঁর নাম ছিল লিলি সিনহা। তিনি ছিলেন রবীন্দ্র ভারতীর ছাত্রী। কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে বশির আহমদের গান শুনে মুগ্ধ হন। গানের পরে তাঁদের দেখা এবং পরিচয়। হোমায়রা ও রাজাকে তাদের বাবার সঙ্গে উর্দু এবং মায়ের সঙ্গে নেপালি ভাষায় কথা বলতে শুনেছি। আর বাংলা তো কমন।

হোমায়রা যখন ছোট তখন ওর জন্য আমার বাবা ফজল-এ-খোদা একটা ছড়াগান লিখে দিয়েছিলেন--

“আমি হোমা পাখি চাই

আমি প্রজাপতি চাই

আমি লাল ফুল চাই

আমি সোনার পুতুল চাই॥”

বাবার সুরে বাবার সঙ্গে একবার গানটি করেছিল বিটিভিতে।

একদিন সন্ধ্যের পর বশিরচাচা এসেছেন আমাদের বাসায়। যথারীতি বাক্স খুলে হারমনিয়াম বের করা হলো। বিছানায় বশির চাচাকে ঘিরে আমরা। বাবা চেয়ারে বসা। বাবার লেখা গান শুরু করলেন--

“মরমি যাই মরমে মরিয়া

তুমি এসে ফিরে গেছ

অভিমান করিয়া॥”

বশিরচাচা গানটি গাইছেন আর গানের মাঝখানে গান থামিয়ে আমার বাবাকে বলছেন-- ‘এই রকম গান তুমি আর লিখতে পারবে না।’ গানটির বৈশিষ্ট্য-- অন্তরাতে কোনো অন্ত্যমিল নেই এবং দুটি অন্তরাতেই দুটি ছবি আঁকা। গানটি বশির আহমেদের অসম্ভব প্রিয় একটি গান ছিল।

আমার অটোগ্রাফ খাতায় বশির চাচা ইংরেজিতে লিখেছিলেন, ‘মিউজিক ইজ মাই লাইফ’। স্বাক্ষর দিয়ে লেখাটা আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন - মিউজিক ইজ মাই ওয়াইফ। সংগীত ছিল তাঁর কাছে ধ্যান-জ্ঞান, ইবাদতের মতো। গানে ছিলেন সমর্পিত।

বশির আহমেদ গান গেয়েছেন, গান সুর করেছেন, গান লিখেছেন; শুধু তাই নয়-- তাঁর অগণিত ছাত্রছাত্রীকে তিনি গান শিখিয়েছেন। নিজের গান তাদের তুলে দিয়েছেন। পরিপূর্ণ সংগীত-ব্যক্তিত্ব বলতে যা বোঝায়, বশির আহমেদ ছিলেন তাই। ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি গান ছাড়া অন্য কিছু করেননি। গান ছিল তাঁর নির্ভর আশ্রয়।

বাংলাগানকে তিনি মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন। মাতৃভাষা উর্দু হলেও বাংলাতেও গান লিখেছেন ‘বি এ দ্বীপ’ নামে। তাঁর বাংলাগানের প্রতি ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ তাঁর গান গ্রহণ করে। আমৃত্যু তিনি আমাদের গানের ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর মেধা দিয়ে তাঁর প্রতিভা দিয়ে।

আমাদের দেশে শুধু সংগীতকে পেশা হিসেবে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। সেই কঠিন কাজটিকেই জীবনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বশির আহমেদ। শত প্রতিকূলতার মুখেও বিশুদ্ধ সংগীতকে কখনো বিসর্জন দেননি। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন যাপন করেছেন সংগীত শিল্পের সাধক হয়ে। তাঁর জীবন তাঁর সংগীত আমাদের উত্তর-প্রজন্মকে প্রেরণা জোগাবে, আলো দেখাবে।

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক।