'ভদ্রলোক' কাপুর

হিন্দি সিনেজগতে বরাবরই নিভৃতচারী এবং ‘ভদ্রলোক’ হিসেবে পরিচিত শশী কাপুর। এবার দাদা সাহেব ফালকের মতো মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা পেয়েও প্রতিক্রিয়ায় স্মিত হাসি ছাড়া কোনো উচ্ছাস দেখাননি তিনি।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 March 2015, 02:17 PM
Updated : 29 March 2015, 02:17 PM

অথচ কাপুর পরিবারের অন্যতম সেরা অভিনেতা শশী কাপুর হলিউডে খ্যাতি পাওয়া ভারতীয় অভিনেতাদের কাতারে ওপরের দিকে ছিলেন। বাণিজ্যিকভাবে সফল অসংখ্য ছবির নায়ক হিসেবে যেমন সাফল্য পেয়েছেন, তেমনি তার অভিনয় প্রশংসা কুড়িয়েছে বিদগ্ধ সমালোচকদেরও।

এই মার্চ মাসেই তিনি পা রেখেছেন ৭৭ বছরে। অভিনয় করেছেন অন্তত ১১৬টি চলচ্চিত্রে। এর মধ্যে একক নায়ক হিসেবে ৬১টি ছবিতে, পার্শ্ব-চরিত্রে ২১ ছবিতে এবং সহ-নায়ক হিসেবে তারকাবহুল ৫৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।

বাংলাদেশের দর্শকের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে মূলত দুটি ছবির সুবাদে। ভারত, কানাডা ও বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় ১৯৮৬ সালে মুক্তি পায় ‘দূরদেশ’( হিন্দি নাম ‘গেহরি চোট’)। এহতেশাম ও আমব্রিশ সানগাল পরিচালিত কানাডায় চিত্রায়িত ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন  শশী কাপুর, শর্মিলা ঠাকুর, রাজ বাব্বর, পারভিন ববি, বাংলাদেশের ববিতা এবং পাকিস্তানের শিল্পী নাদিম। ছবিটি বাংলাদেশে ব্যপক ব্যবসা করে এবং শশী কাপুর নায়ক হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়তা পান ঢাকার দর্শকদের মধ্যে।

আশির দশকেই ঢাকায় মুক্তি পায় ‘সিদ্ধার্থ’ ছবিটি। হারমান হেসের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭২ সালে নির্মিত এই ছবির পরিচালক ছিলেন কনরাড রুকস। মধ্যযুগে ভারতের এক তরুণ সন্ন্যাসীর ঈশ্বর অনুসন্ধান ও আত্মোপলব্ধির এ হলিউডি ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করে শুধু বাংলাদেশের নয় বিশ্বের অনেক দেশের দর্শকেরই মন জয় করে নিয়েছিলেন শশী কাপুর।

শশী কাপুরের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৮ মার্চ, কলকাতায়। পারিবারিকভাবে নাম রাখা হয়েছিল বলবীররাজ পৃথ্বি রাজ কাপুর। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সিংহ পুরুষ এবং কাপুর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা পৃত্থিরাজ কাপুরের ছোট ছেলে তিনি। বলিউডের ডাকসাইটে অভিনেতা রাজ কাপুর ও শাম্মি কাপুরের ছোট ভাই। চলচ্চিত্রের এই আবহে বেড়ে ওঠায় একেবারে অতি শৈশবেই মঞ্চে ও ক্যামেরার সামনে অভিনয়ে হাতেখড়ি হয় তার। পৃথ্বি থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পৃত্থিরাজ কাপুর। এই থিয়েটারের নাটকে অভিনয়ের সুবাদেই প্রথম মঞ্চে নামেন শশী কাপুর মাত্র চার বছর বয়সে। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে শিশুশিল্পী হিসেবে বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন। ‘আগ’(১৯৪৮) ও ‘আওয়ারা’(১৯৫১) ছবিতে বড়ভাই রাজকাপুরের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ‘সংগ্রাম’(১৯৫৪) ছবিতে অশোক কুমারের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করতে হয় তাকে। পঞ্চাশের দশকে তিনি কযেকটি ছবিতে সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।

নায়ক হিসেবে তার অভিষেক হয় ১৯৬১ সালে ‘ধর্মপুত্র’ ছবিতে। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছিল। এর পর ‘প্রেম পত্র’ ও ‘চারদিওয়ারি’, ‘মেহেন্দি লাগি মেরি হাত’ও বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার পাশাপাশি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। রোমান্টিক নায়ক হিসেবেই বলিউডে প্রতিষ্ঠা পান শশী কাপুর। প্রথমদিকে তার বিপরীতে নায়িকা ছিলেন মূলত নন্দা। লো প্রোফাইল তবে প্রতিভাবান অভিনেত্রী নন্দা সহশিল্পী হিসেবে ছিলেন দারুণ মানানসই। শশী কাপুর পরবর্তীতে শর্মিলা ঠাকুর, হেমা মালিনীর মতো নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করেছেন। তবে বরাবরই নন্দা ছিলেন তার সবচেয়ে পছন্দের নায়িকা। কারণ দুজনেই আন্ডারটোন অভিনয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। মঞ্চে অভিনয়ে পারদর্শী শশী কখনো উচ্চকিত অভিনয় পছন্দ করতেন না। নন্দার বিরীতে তার ‘মহব্বত ইসকো ক্যাহতে হ্যায়’, ‘জব জব ফুল খিলে’, ‘নিদ হামারি খাওয়াব তুমহারে’ ‘রাজা সাব’ ‘রুঠা না কারো’ রোমান্টিক-সামাজিক ছবি হিসেবে বক্স-অফিসে ভালো ব্যবসা করে।

সত্তরের দশকে রোমান্টিক ‘ভদ্রলোক’ নায়কের চরিত্রে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন শশী কাপুর। শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে শশী অভিনীত ‘আ গলে লাগ জা’ এখনও বলিউডের অন্যতম সেরা রোমান্টিক ছবি। রাখির বিপরীতে ‘শর্মিলি’, ‘তৃষ্ণা’, ‘দুসরা আদমি’, ‘বন্ধন কাচ্চে ধাগো কা’, ‘বান্ধে হাথ’, ‘পিঘালতা আসমান’ ‘জামিন আসমান’, ‘বাসেরা’, ‘জানোয়ার আউর ইনসান’, ব্যবসা সফল ও সমালোচকদের প্রশংসাধন্য। জিনাত আমানের বিপরীতে ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’, ‘চোরি মেরা কাম’, ‘দিওয়ানগি’, ‘রোটি কাপড়া আউর মাকান’,‘হিরালাল পান্নালাল’,‘পাখান্ডি’, ‘ভবানি জংশন’, শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে ‘ওয়াক্ত’, ‘আমনে সামনে’ , ‘সুহানা সফর’, ‘পতঙ্গ’, ‘বচন,পাপ আউর পুণ্য’, ‘স্বাতী’ ব্যবসাসফল ছবি। এই জুটির ‘নিউ দিল্লি টাইমস' সমালোচকদের প্রশংসায় সিক্ত। এই ছবির সুবাদে সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেন শশী কাপুর।

শশী কাপুর অভিনীত ব্যবসা সফল ছবির মধ্যে আরও রয়েছে ‘হাসিনা মান যায়েগি’, ‘এক শ্রীমান এক শ্রীমতি’,‘কন্যাদান’, ‘পেয়ার কা মওসাম’, ‘চোর মাচায়ে শোর’, ‘অভিনেত্রী’, ‘বেজুবান’, ‘চক্কর পে চক্কর’, ‘কালিঘাটা’, ‘কালযুগ’, ‘বিজেতা’, ‘পেয়ার কি জিত’, ‘বেপানাহ’, ‘দিল নে পুকারা’, ‘নয়না’, ‘শলাখে’, ‘ফাকিরা’, ‘জুনুন’ ইত্যাদি। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে অনেকগুলো ব্যবসা সফল ছবিতে অভিনয় করেন শশী কাপুর। এর মধ্যে ‘কাভি কাভি’, ‘সিলসিলা’, ‘দিওয়ার’, ‘দো আর দো পাঁচ’, ‘ইমান ধরম’, ‘ত্রিশূল’, ‘সুহাগ’,‘নামাক হালাল’, ‘কালা পাত্থর’, ‘আকেলা’ ইত্যাদি ছবি রয়েছে।

বেশ কয়েকটি ব্রিটিশ ও মার্কিন ছবিতে অভিনয় করে খ্যাতি পান শশীকাপুর। এর মধ্যে ‘দ্য হাউস হোল্ডার’, ‘শেকসপিয়ার ওয়ালা’, ‘বোম্বে টকি’, ‘হিট অ্যান্ড ডাস্ট’, ‘দ্য ডিসিভারস’,‘সাইড স্ট্রিটস’, ‘প্রিটি পলি’, ‘সিদ্ধার্থ’, ‘স্যামি অ্যান্ড রোজি গেট লেইড’, ‘মুহাফিজ’ উল্লেখযোগ্য।

শশী কাপুর যখন কলকাতায় থিয়েটারে অভিনয় করতেন সে সময় একই দলে ছিলেন ইংরেজ অভিনেত্রী জেনিফার কেন্ডাল। সে সময় থেকেই দুজনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শশীর বাবা পৃত্থিরাজ এবং জেনিফারের বাবা জিওফ্রি কেন্ডাল ছিলেন বন্ধু। ১৯৫৮ সালে বিয়ে করেন শশী ও জেনিফার। তারা ছিলেন সুখি দম্পতি। ১৯৮৪ সালে জেনিফারের মৃত্যু হয়। এই দম্পতির তিন সন্তান ‍কুনাল কাপুর, করন কাপুর ও সঞ্জনা কাপুর।

১৯৭৮ সালে শশী কাপুর নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ‘জুনুন’, ‘কালযুগ’, ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’, ‘বিজেতা’, ‘উৎসব’ - এর মতো শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র প্রযেজনা করেন তিনি।

চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ২০১১ সালে পেয়েছেন পদ্মভূষণ সম্মাননা। ২০১০ সালে ফিল্মফেয়ার আসরে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পান। ‘কালযুগ’ ও ‘জুনুন’ ছবির প্রযোজক হিসেবে সেরা ছবির পুরস্কার পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার আসরে। ‘দিওয়ার’ ছবিতে পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতেছিলেন। ‘নিউ দিল্লি টাইমস’-এর সুবাদে সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড পান ‘মুহাফিজ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য। ‘জুনুন’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছিল সেরা ছবি হিসেবে।

বিনয়ী ও নিভৃতচারী শশী কাপুর বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন।