'মৃত্তিকা মায়া'র পুনর্জাগরণ হয়েছে: গাজী রাকায়েত 

মুক্তির পর ‘মৃত্তিকা মায়া’ সিনেমাটি তেমন কোনো আলোড়ন তোলেনি। অথচ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সতেরটি শাখায় পুরস্কৃত হয়ে রেকর্ড গড়েছে গাজী রাকায়েত পরিচালিত সিনেমাটি। গ্লিটজের সঙ্গে সিনেমাটি নিয়ে নানা আলাপ করেছেন পরিচালক। 

গ্লিটজ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2015, 02:31 PM
Updated : 17 March 2015, 02:35 PM

গ্লিটজ: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ইতিহাসে রেকর্ড গড়লো ‘মৃত্তিকা মায়া’। সিনেমাটি নির্মাণের পর কি পুরস্কারের কথা ভেবেছিলেন?

রাকায়েত: মোটেও পুরস্কারের নেশায় সিনেমা বানাই নি। ব্যাপারটি একদমই মাথায় ছিল না। অনেকদিন ধরে একটি ফোকধর্মী গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনা করছিলাম। কুমারপাড়ার জীবনযাত্রার পাশাপাশি বাংলার আবহমান সংস্কৃতি ধারাকে চলচ্চিত্র্রপ্রেমীদের সামনে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম। ব্যস! আর কিছু না।

তবে হ্যাঁ, অবশ্যই ভালো লাগছে। চলচ্চিত্রটি প্রায় সব শাখাতেই পুরস্কার পেয়েছে। বিজ্ঞ জুরি বোর্ড বিচার-বিশ্লেষণে দেখেছে, অভিনয় ও কারিগরি দিকগুলোতে ‘মৃত্তিকা মায়া’ সেরা। তাদের এই মূল্যায়ন আমাদের চলচ্চিত্রটিকে নতুন জন্ম দিয়েছে। আমি বলবো, ‘মৃত্তিকা মায়া’-র পুনর্জাগরণ হয়েছে।

গ্লিটজ: অথচ সিনেমাটি যখন মুক্তি পেলো, তখন মাত্র একটি হলে প্রদর্শিত হয়েছে সিনেমাটি। দর্শকদের কাছেও তেমন সাড়া পায়নি। 

রাকায়েত: সত্যি কথা। সেভাবে বাণিজ্যিক উপকরণ না থাকায় সিনেমাটি মূলধারার দর্শকরা দেখতে চাইলো না। সিনেমা হলমালিকরাও সিনেমাটি পরিবেশন করতে নারাজ ছিল। যমুনা ব্লকবাস্টারসে দুই সপ্তাহ প্রদর্শনের পর আর কোনো হলে চললো না সিনেমাটি। অথচ দেখুন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার পর সিনেমাটিকে ঘিরে দর্শকের প্রত্যাশা বাড়ছে। যারা সিনেমাটি দেখেনি, তারা এখন সিনেমাটি দেখতে চাইছে। সিনেমাটি নিয়ে তারা জানতে চাইছে। পরিস্থিতি সত্যি বদলে গেছে।

গ্লিটজ: একটু পিছনে তাকাই। ‘মৃত্তিকা মায়া’র যাত্রার শুরুটি কেমন ছিলো?

রাকায়েত: মোটেই মসৃণ ছিল না। সরকারি অনুদান থেকে প্রাপ্ত ৩৫ লাখ টাকা ও বিএফডিসির ১০ লাখ টাকা সমমূল্যের কারিগরি সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল ছিল। অনুদান থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে সিনেমা নির্মাণ একেবারেই অসম্ভব ছিল। তারপর বিএফডিসির যন্ত্রপাতি বড্ড সেকেলে। কিছুদিন কাজ করার পরই বুঝতে পারলাম এসব যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করলে সিনেমার বারোটা বাজবে।

এরপর সহ-প্রযোজক খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠলাম। কিন্তু বাণিজ্যিক উপকরণ নেই এবং বাণিজ্যিক সফলতা পাবে না এমন আশঙ্কায় সিনেমাটিতে তারা লগ্নি করতে রাজি হননি।

তখন আমি বাধ্য হয়ে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের দ্বারস্থ হলে তারা সিনেমার প্রযোজনা করতে রাজি হয়ে যায়। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম সিনেমাটিতে ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে।

গ্লিটজ: এ চলচ্চিত্রের অভিনেতা ও কলাকুশলী সবাই মঞ্চের মানুষ। এর কারণ কি?

রাকায়েত: সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখি, তারা গান গাইছে কিন্তু ঠোঁট মিলছে না। আমি চেয়েছিলাম পরিপক্বদের নিয়েই কাজ করতে। তিতাস মঞ্চে দারুণ করছে, নতুন হিসেবে শর্মিও ভালো কাজ করছে। শর্মি ‘মনের মানুষ’-এ ছোট চরিত্রে ভালো কাজ করেছে। রাইসুল  ইসলাম আসাদ ও মামুনুর রশীদকে নিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। অপর্ণাও মঞ্চের মানুষ। কলাকুশলীদের অনেকেই মঞ্চনাটকে দীর্ঘদিন কাজ করা। আমার পরিচিত মানুষদের ওপরই আমার আস্থা রেখেছিলাম।

গ্লিটজ: ডিজিটালের যুগে আপনার সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে ৩৫ মিলিমিটার প্রযুক্তিতে। এর কারণ কি?

রাকায়েত: তখনও এফডিসিতে থার্টি ফাইভ প্রযুক্তির ক্যামেরা ছিল। এ প্রযুক্তি হারিয়ে যাওয়ার আগে আমি এ প্রযুক্তিতে একটি সিনেমা নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম। এছাড়া অন্য কারণ নেই।

গ্লিটজ: সিনেমার প্রদর্শনে প্রসঙ্গে আবারও কথা বলতে চাই। মাত্র একটি হলে প্রদর্শনের পর চ্যানেল আইতে ওয়ার্ল্ড টিভি প্রিমিয়ার। সিনেমাটির প্রযোজক ও নির্মাতা হিসেবে আপনার মন্তব্য কি?

রাকায়েত: সব ধরনের সিনেমাতেই বাণিজ্যিক সাফল্য আশা করা যায় না। ‘মৃত্তিকা মায়া’র মতো চলচ্চিত্রগুলো লোকে দেখতে চাইবে না, হলমালিকরা হলে চালাতে চাইবে না- এটাই স্বাভাবিক। আমার কাছে চলচ্চিত্র একটি শিল্পকর্ম। সব শিল্পকর্ম দিয়েই তো আর বাণিজ্য করা যায় না।

প্রযোজক হিসেবে আমি বলবো, আমার বেশ ক্ষতিই হয়েছে। গাঁটের পয়সা খরচ করে সিনেমাটি বানিয়েছিলাম। ভাগ্যিস, ইমপ্রেস পাশে দাঁড়িয়েছিল। নইলে তো সিনেমাটি নির্মাণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ত।

গ্লিটজ: কিন্তু ইমপ্রেস বলছে, এই সিনেমার পরিবেশনা নিয়ে তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। আগ্রহী দর্শকরা সিনেমাটি দেখবে কিভাবে?

রাকায়েত: সিনেমাটি নিয়ে ইমপ্রেস কি পরিকল্পনা করছে আমি জানি না। যদিও সিনেমাটির পরিবেশনার সর্বস্বত্ত্ব তাদের।

তবে আমি কিন্তু বসে থাকিনি। সিনেমাটি মুক্তির পরই চাড়ুনীড়ম তার নিজ উদ্যোগে দেশব্যাপী সিনেমাটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে। পঞ্চগড় ও সিলেটে আমরা একাধিক প্রদর্শনী করেছি। এরপর জাতীয় গণগ্রন্থাগারে (পাবলিক লাইব্রেরিতেও) দশটি প্রদর্শনী করেছি আমরা। দর্শকের অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। তারা সিনেমাটি নিয়ে নানা মন্তব্য করছে। আলোচনা-সমালোচনা দুই হয়েছে। আমি নিয়মিতভাবেই পাবলিক লাইব্রেরিতে প্রদর্শনী করে যাবো। এছাড়া শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় বিভিন্ন জেলায় সিনেমাটি প্রদর্শনের বন্দোবস্ত করার পরিকল্পনা করছি।

গ্লিটজ: মূল ধারার নির্মাতাদের সঙ্গে বিকল্প ধারার নির্মাতাদের একটি দুরত্ব কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। চলচ্চিত্র বিকাশের পথে এ ব্যাপারটি কতটা প্রভাব ফেলবে?

রাকায়েত: এটা সত্যি যে, মূল ধারার নির্মাতাদের সঙ্গে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ফারাক অনেক বেশি। মূল ধারার নির্মাতারা বিকল্প ধারাকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করছেন। এটা কাম্য নয়। দু ধরনের চলচ্চিত্রই দরকার। এক ধরনের চলচ্চিত্র দর্শকের বিনোদনের খোরাক জোগাবে। আরেক ধরনের চলচ্চিত্র বাস্তবের প্রেক্ষাপটকে নানাভাবে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করবে। এই ধরনের চলচ্চিত্রগুলোই মানুষের মনে গেঁথে থাকে। এ চলচ্চিত্রগুলো কখনো হারিয়ে যায় না।

তবে আমি বাণিজ্যিক ধারার সঙ্গে বিকল্প ধারার পার্থক্য মানতে নারাজ। চলচ্চিত্রের বিকাশের পথে দু ধরনের চলচ্চিত্রকেই গ্রহণ করতে হবে। দু ধারাকেই পাশাপাশি চলতে হবে। কোনো ধারাকে বাদ দেওয়া চলবে না।

গ্লিটজ: বিকল্পধারার চলচ্চিত্র দেখার জন্য সত্যিই কি আলাদা দর্শক তৈরি হচ্ছে ?

রাকায়েত: আমাদের চলচ্চিত্রের আলাদা দর্শক তৈরি হওয়া ভীষণ দরকার। এজন্য আলাদা কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করাও ভীষণ দরকার। দর্শকরা এখন হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে চাইছে না।বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা থেকে এরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এদের রুচির পরিবর্তন হওয়া ভীষণ দরকার। বাংলা সিনেমার বুদ্ধিদীপ্ত দর্শক তৈরি হওয়া দরকার। সরকারের আরও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।

গ্লিটজ: সরকারি অনুদান প্রসঙ্গে বাণিজ্যিক ধারার নির্মাতারা বলছেন, ব্যবসাসফল না হলেও বিকল্প ধারাকেই সরকার অনুদান দিচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?

রাকায়েত:আমার মনে হয়, যেসব সিনেমা হলে ব্যবসা করতে পারছে সেগুলোকে অনুদান দিয়ে কি হবে। তবে মুক্তিযুদ্ধ বা ফোকধর্মী গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমা, যেগুলো ব্যবসা করতে পারবে না সেগুলোকেই অনুদান দেওয়া যেতে পারে।

তবে আমি বলবো, সরকারি অনুদানের পরিমাণ বাড়লে তা নির্মাতার জন্য সত্যি স্বস্তির হবে। সরকারও নিশ্চয় চেষ্টা করছে।

গ্লিটজ: পরবর্তীতে আবারো চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি?

রাকায়েত: এখনও সেভাবে ভাবছি না। আমার এত কষ্টের ‘মৃত্তিকা মায়া’ই তো দর্শককে দেখাতে পারছি না। সারাদেশের মানুষ যদি নাই দেখলো আমার সিনেমা, তাহলে সিনেমা বানিয়ে লাভ কি? আমি আসলে সংখ্যাতত্ত্বে বিশ্বাসী নই।

গ্লিটজ: কদিন পরই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারটি হাতে পাবেন। পুরস্কারের অর্থমূল্য দিয়ে নতুন কিছু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে কি?

রাকায়েত : ‘মৃত্তিকা মায়া’ নির্মাণের পর আমার হাত একেবারেই শূন্য। আমি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। জাতীয় চলচ্চিত্রের পুরস্কার থেকে পাওয়া অর্থ আমার কোনো কাজেই আসবে না।

তবে আমি  দেশকে ভালোবাসি, মাটিকে ভালোবাসি। আমি যেকোনো উপায়ে এ দেশের প্রতি আমার ঋণ শোধ করতে চাই। দর্শককে ভালো কিছু উপহার দিতে চাই।