আবারও ‘সিন্ডারেলা’: রূপকথা পুরোনো হয় না

অনেক অনেকদিন আগের কথা। গ্রিম ভায়েরা তাদের জাদুকরী লেখনিতে তুলে এনেছিলেন সৎ মায়ের হাতে নিগৃহিত অনাথ এক তরুণীর গল্প, কাঁচের তৈরি এক জোড়া জুতোর বদৌলতে রাতারাতি বদলে যায় যার ভাগ্য।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2015, 12:29 PM
Updated : 16 March 2015, 12:29 PM

অর্ধ সহস্রাব্দ আগের সেই রূপকথা ফিরে ফিরে এসেছে বার বার। তবে সিন্ডারেলা নামের সেই তরুণী বিশ্বজুড়ে সব বয়সী মানুষের কাছে সমাদর পেয়েছে আধুনিক যুগের আরেক গল্পবুড়ো ওয়াল্ট ডিজনির হাত ধরেই।

১৯৫০ সাল। ডিজনি স্টুডিও তাদের নজড়কাড়া দ্বিমাত্রিক অ্যানিমেশনে নতুন করে বলেছিল সিন্ডারেলার গল্প। সেই ক্লাসিক অ্যানিমেশনের পর থেকে আরও বেশ কবার নানা রূপে, নানা মাধ্যমে সিন্ডারেলাকে দর্শকদের সামনে হাজির করেছে ডিজনি। গল্পের বইয়ের পাতা আর কার্টুন থেকে বেরিয়ে ‘এভার আফটার: আ সিন্ডোরেলা স্টোরি’, ‘আ সিন্ডারেলা স্টোরি’র মতো সিনেমার মাধ্যমে রক্তমাংসের সিন্ডারেলাকে দেখার সুযোগ হয়েছে দর্শকের।

ডিজনির সেই প্রয়াসেই সর্বশেষ সংযোজন কিছুদিন আগে মুক্তি পাওয়া লাইভ অ্যাকশন সিনেমা ‘সিন্ডারেলা’। কেনেথ ব্র্যানাহর নির্দেশনায় এবারের সিন্ডারেলা ব্রিটিশ রুপসী লিলি জেইমস।

লাইভ অ্যাকশন অর্থাৎ অ্যানিমেশনের কল্পনা থেকে বাস্তবের জগতে সত্যিকারের অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে রূপকথাকে তুলে আনার প্রয়াস অবশ্য ডিজনির এটাই প্রথম নয়। টিম বার্টনের হাত ধরে ২০১০ সালেই কিছুটা উদ্ভট, কিন্তু দারুণ দৃঢ়চেতা আর কৌতুহলী অ্যালিসকে নতুন করে তুলে এনেছিলেন মিয়া ওয়াসিকোয়স্কা, ‘অ্যালিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড' সিনেমায়। আর গত বছরই স্লিপিং বিউটির ভয়ঙ্কর ডাইনি ম্যালেফিসেন্টকে একেবারে ভিন্নরূপে তুলে আনলেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। রবার্ট স্টর্মবার্গের ‘ম্যালেফিসেন্ট’ দিয়ে চিরাচরিত এই খলনায়িকাকে নতুন করে চিনিয়েছেন জোলি।

সেদিক থেকে চিন্তা করলে, এবারের ‘সিন্ডারেলা’য় নতুন কি দেখিয়েছে ডিজনি? সাদা চোখে দেখলে, সে রকম কোনো চমক খুঁজে পেতে কষ্টই হবে দর্শকের। চিত্রনাট্যকার ক্রিস ওয়েটজ যে এই সিনেমার গল্পকথনের বেলায় হেঁটেছেন রূপকথায় দেখানো সেই চেনা পথেই।

তারপরও ১১২ মিনিটের এই সিনেমা হতাশ করবে না। কারণ, চরিত্রায়ন, অভিনয়নৈপূণ্য আর কাহিনিবিন্যাসে অ্যানিমেশন সিনেমাটিকে সহজেই ছাড়িয়ে গেছে এবারের ‘সিন্ডারেলা’।

লাইভ অ্যাকশন সিনেমার ক্ষেত্রে মূল অ্যানিমেশন সিনেমার সঙ্গে তুলনাটা চলেই আসে। ১৯৫০ সালের ‘সিন্ডারেলা’ ছিল মূলত একটি মিউজিকাল রোমান্টিক কমেডি। এবারের ‘সিন্ডারেলা’তে হাস্যরসের উপাদান আছে বটে, কিন্তু নাটকীয়তায় মোড়া এই ফ্যান্টাসি মুভিটিকে অনায়সেই ফেলা যায় রোমান্টিক-ড্রামার ঘরানায়।

অ্যানিমেটেড ‘সিন্ডারেলা’র বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে কাজ করেছিল অনেকগুলি প্রভাবক। প্রথমত, এটি মিউজিকাল। তার ওপর সিনেমায় সিন্ডারেলার পাশাপাশি, তার পোষা ইঁদুর, পাখি, কুকুর, ঘোড়া- এদেরও ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সিনেমার পর্দায় কথাবলা ইঁদুর আর পশুপাখিদের দল ছোটদের কাছে সহজেই প্রিয় হয়ে উঠেছিল।

এবারের ‘সিন্ডারেলা’র শুরু আর শেষে এক ঘুমপাড়ানি গানই সবেধন নীলমণি। তাই বলে ধরে নেবেন না, সিনেমায় সংগীতের ব্যবহারই নেই! আবহ সংগীতের ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন প্যাট্রিক ডয়েল।

তবে নতুন ‘সিন্ডারেলা’র সবচেয়ে বড় শক্তি এর কেন্দ্রীয় চরিত্রটিই। কেনেথ ব্র্যানাহ ছোটবেলা থেকে তারূণ্য পর্যন্ত সিন্ডারেলার চরিত্রটিকে পরিপূর্ণভাবে বেড়ে উঠতে দিয়েছেন। সেইসঙ্গে অভিনয়নৈপূণ্যে চরিত্রটিকে হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন লিলি জেইমস। আর তাই কেবল রূপের জৌলুসেই নয়, চরিত্রের দৃঢ়তা আর হৃদয়ের কোমলতায়ও মন কেড়েছে সিন্ডারেলা।

অভিনয়ের প্রসঙ্গ আসলে, আরেকজনের কথা বিশেষভাবে বলতেই হয়। তিনি হলেন সিন্ডারেলার সৎ মা, লেডি ট্রিমেইনের চরিত্রের রূপদানকারী কেইট ব্লানচেট। বিশেষ করে সিন্ডারেলাকে চিলেকোঠার ঘরে বন্দি করে রাখার দৃশ্যে অস্কারজয়ী এই অভিনেত্রীর কাজ অনেকদিন মনে রাখার মতো।

কাহিনিবিন্যাসের দিক থেকে মূল অ্যানিমেশনের চাইতে এবারের ‘সিন্ডারেলা'কে অনেক বেশি সঙ্গতিপূর্ণ মনে হবে ড্রিউ ব্যারিমোর অভিনীত ১৯৯৮ সালের ‘এভার আফটার: আ সিন্ডারেলা স্টোরি’র সঙ্গে।

জাদুর বিস্তারের চাইতে পরিচালক যেন এই সিনেমায় বেশি মনোযোগ দিযেছেন বাস্তবের কাঠিন্যের ওপরেই। সিনেমার নায়ক প্রিন্স ‘কিট’ চার্মিং (গেইম অফ থ্রোন্স খ্যাত রিচার্ড ম্যাডেন) তাই তার শয্যাশায়ী বাবা আর ধূর্ত মন্ত্রীর রাজনৈতিক কূটচালে অনেকটাই বাধ্য হয়ে রাজি হয় স্পেনের রাজকন্যাকে বিয়ে করতে।

রূপকথার দুনিয়া থেকে বাস্তবের জগতের সঙ্গে ‘সিন্ডারেলা’র সাযুজ্য আরও ফুটে উঠে একটি দৃশ্যের মধ্য দিয়ে যেখানে ধুলোকালি মাখা সিন্ডারেলা রাজপুত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, “আমি কোনো রাজকন্যা নই। কোনো চাকচিক্যপূর্ণ অভিজাত রুপসীও নই। আমি খুবই সাধারণ এক মেয়ে। আমাকে সবাই সিন্ডারেলা বলে বলে ডাকে। এই অতিসাধারণ মেয়েটিকে কি আপনি বিয়ে করতে রাজি হবেন?”

কেনেথ ব্রানাহর ‘সিন্ডারেলা’র স্বার্থকতা এখানেই। সেই চির চেনা অসহায় কুমারীর ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে সিন্ডারেলার আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী এক নারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে এই সিনেমায়। ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’, ‘ব্রেইভ’, ‘ফ্রোজেন’, ‘মালেফিসেন্ট’-এর মতো নারীবাদী ডিজনি চলচ্চিত্রের কাতারে এখন তাই ফেলা যাবে নতুন ‘সিন্ডারেলা’কেও।

রূপকথাকে বাস্তবতায় নামিয়ে আনলেও জাদুর ব্যবহার যে একেবারেই করেননি কেনেথ ব্র্যানাহ, তা না। সিন্ডারেলাকে তাই আমরা দেখি ফেইরি গডমাদারের জাদুর ছোঁয়ায় রাজকীয় নাচের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। হেলেনা বোনহ্যাম কার্টারের অভিনয়ে কুমড়ার ঘোড়ার গাড়িতে পরিণত হওয়া, রাজহাঁসের কোচোয়ানে বদলে যাওয়া, গিরগিটির পেয়াদায় রূপ নেওয়া, ইঁদুরদের ঘোড়ায় পরিণত হওয়া, আর সবশেষে নীল সান্ধ্যপোশাক আর কাঁচের জুতোয় সিন্ডারেলার সুসজ্জিতা হয়ে ওঠার দৃশ্যটি তাই ছিল দারুণ উপভোগ্য।

কস্টিউম ডিজাইন আর লোকেশন সিলেকশনে কুশলতার কারণে উনবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে দারুনভাবে সিনেমাটিকে সাজিয়েছেন পরিচালক। আর সিনেমাটোগ্রাফির কথা বলতে হচ্ছে আলাদা করেই। সময় এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় চমৎকার সব ওয়াইড অ্যাঙ্গেল, প্যানারমিক এবং ক্ষেত্র বিশেষে কৌণিক শটগুলো দারুণ কাজে লেগেছে সিনেমাটিতে পুরোনো দিনের স্বাদ নিয়ে আসার জন্য।

সবমিলিয়ে বলতে গেলে, নাতিদীর্ঘ এই সিনেমা নতুন পথে না হাঁটলেও পুরোনো দিনের কথাই মনে করিয়ে দেয় নতুন করে।