ক্যামেরায় যখন নারীর চোখ

রাজস্থানের এক সামন্তপ্রভুর মৃত্যু হচ্ছে। তার মৃত্যুতে ঘটা করে শোক প্রকাশের জন্য ভাড়া করে আনা হয়েছে এক নারীকে।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2015, 06:17 AM
Updated : 8 March 2015, 06:51 AM

কান্নার জন্য ভাড়া করা এমন নারীদের সাধারণ নাম ‘রুদালি’। কল্পনা লাজমি পরিচালিত ও ডিম্পল কাবাডিয়া অভিনীত ‘রুদালি’ একটি অসাধারণসিনেমা। রাজস্থানের পটভূমিতে গড়ে উঠেছে ‘রুদালি’র কাহিনি। এই ছবির একটি অসামান্য দিক হল, শত বঞ্চনা ও যন্ত্রণা সত্ত্বেও প্রান্তিক অবস্থানের নারীসঞ্চারির (ডিম্পল) চোখে কোনো অশ্রু নেই। রাজস্থানের মরুভূমির মতোই এই নারীর জীবনে কোথাও কোনো আশার কোমলতা নেই। নারীর জীবনের বঞ্চনার এই গভীরতা একমাত্র তখনই সার্থকভাবে চিত্রায়িত হতে পারে পর্দায় যখন ক্যামেরার পেছনে থাকেন কোনো সৃষ্টিশীল নারী।

হলিউড, বলিউড কিংবা বাংলা চলচ্চিত্রে অসংখ্য অভিনেত্রী কাজ করলেও, পরিচালনায় এসেছেন খুব কম নারীই। তারপরও বলা যায় ক্যামেরারপেছনে যখন থাকেন একজন নারী, তখন নারীর জীবন একটু অন্যভাবেই উঠে আসে পর্দায়। যেমন অপর্ণা সেন, দীপা মেহতা বা কল্পনা লাজমির চলচ্চিত্রে উঠেআসা নারীর জীবন।

দীপা মেহতা পরিচালিত চলচ্চিত্রে নারীর জীবনযন্ত্রণার ইতিবৃত্ত উঠে আসে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে। তার ট্রিলজি ‘আর্থ’ (পৃথিবী), ‘ওয়াটার’ (পানি) এবং‘ফায়ার’ (আগুন) তিনটি চলচ্চিত্রই নারীর অন্তর্জীবনকেন্দ্রিক। পর্দায় সমকামিতা দেখানোর জন্য ‘ফায়ার’ ব্যাপক সমালোচিত হয়।  ‘ওয়াটার’ সিনেমায়উঠে এসেছে কাশির আশ্রমে নির্বাসিত বিধবা নারীর অমানবিক জীবন। আঠার ও উনবিংশ শতাব্দীতে বিধবা নারীকে পাঠিয়ে দেওয়া হতো পরিবার থেকে দূরেকাশিতে। সেখানে আশ্রমে ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যেত অসংখ্য নারীর জীবনের আশা, আকাঙ্ক্ষাম কামনা, বাসনা সবকিছুই। বাল্যবিধবা নারীর ওপর চলতোনিপীড়ন - শারীরিক ও মানসিক।

‘আর্থ' সিনেমার প্রেক্ষাপট দেশভাগ। সেখানে পোলিও আক্রান্ত এক কিশোরীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয় সমাজ ও নারীর সম্পর্কের সমীকরণকে।

একজন সুন্দরী সুখী গৃহবধূ। সংসারে নিবেদিত, শাশুড়ির সেবায় নিরত, সন্তানদের স্নেহময়ী মা, আত্মীয় স্বজন সকলের প্রতি কর্তব্য পরায়ণ, স্বামীরশয্যাসঙ্গিনী, তার বিশ্বস্ত সেবিকা, সাজানো সংসারে সাজানো পুতুলের মতো শোভা বর্ধনকারী|। কিন্তু যখনই তিনি নিজের সত্তার সন্ধান করেন, খুঁজে নিতেচান নিজস্ব সুখ, সম্মান, স্বাধীনতা - সেই মুহূর্তে যেন মিথ্যে হয়ে যায় সব। শাশুড়ি ভুলে যান তার এতদিনের সেবা, সন্তানরা অস্বীকার করে স্নেহ, স্বামীর কাছেমূল্যহীন হয়ে যায় তার প্রেম, আত্মীয়স্বজনরাও বিস্মৃত হয় তার সৌজন্য। যতক্ষণ নারী অছে সমাজ কর্তৃক বেঁধে দেওয়া ছকের ভেতর, ততক্ষণই তার মূল্য।একটু অন্য পথে চললেই সে পরিত্যাজ্য। তার নিজের আপন সত্তা বলতে কি তাহলে কিছু নেই? এই প্রশ্নই করে ‘পরমা’। অপর্ণা সেন পরিচালিত ও নামভূমিকায় রাখী অভিনীত এক অসাধারণ সৃষ্টি। অপর্ণা সেনের ‘মি. অ্যান্ড মিসেস আয়ার’, ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’, ‘ইতি মৃণালিনী’, ‘দ্য জাপানিজ ওয়াইফ’ সুনির্মিত এবং প্রশংসিত।

বলিউডের প্রতিভাময়ী পরিচালক মিরা নায়ার। তার ‘সালাম বোম্বে’ অস্কার মনোনয়ন পাওয়া চলচ্চিত্র। ‘মনসুন ওয়েডিং’, ‘মিসিসিপি মাসালা’ ‘দ্য নেইমসেক’, ‘অ্যামেলিয়া’- মিরা নায়ারের প্রতিটি ছবিই স্বকীয়তায় ভাস্বর।

বলিউডে বাণিজ্যিক ধারার সফল পরিচালকদের অন্যতম ফারাহ খান। ‘ম্যায় হু না’, ‘ওম শান্তি ওম’, ‘তিসমার খান’, ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ - এর মতো সফল বাণিজ্যিক ছবির নির্মাতা তিনি। ফারাহ খানের ছবি মানেই তারকাবহুল, নাচে-গানে ভরপুর পয়সা উশুল বিনোদন।

বাণিজ্যিক ধারার নির্মাতা হলেও যোয়া আখতারের ছবিতে আবার চিন্তারও খোরাক থাকে।‘লাক বাই চান্স’ এবং ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’ দুটি ছবিতে তার প্রমাণ মিলেছে। ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’ ছিল ২০১১ সালের সবচেয়ে বড় হিট। আরেক নারী পরিচালক রিমা কাগতির সঙ্গে যৌথভাবে যোয়া লিখেছেন ‘তালাশ’ ছবির গল্প।

রিমা কাগতি ‘তালাশ’ এবং ‘হানিমুন ট্রাভেলস’-এর পরিচালক হিসেবে খ্যাত।‘তালাশে’র অভিনেতা আমির খানের স্ত্রী কিরণ রাও পরিচালনায় মেধার সাক্ষর রেখেছেন। তার ‘ধোবি ঘাট’ সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে।

বাণিজ্যিক ধারার নির্মাতা হলেও একটু অন্য স্বাদের গল্প বলতে ভালোবাসেন রাজশ্রী ওঝা। তার ‘আয়শা’ এবং ‘চৌরাহেন’ দুটি ছবি বাণিজ্যিক ঘরানার হয়েও আলাদা মেজাজের। আনুশা রিজভির ‘পিপলি লাইভ’ ছবিটিও ভিন্নতার দাবীদার।

লিনা ইয়াদভের ‘শব্দ’ এবং ‘তিন পাত্তি’ ছবিদুটিও পরিচালকের মুন্সিয়ানার ছাপ বহন করে নিঃসন্দেহে।

২০০২ সালে গুরিন্দর চাড্ঢা পরিচালিত ব্রিটিশ-জার্মান কমেডি ফিল্ম ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহাম’কে ঠিক নারীবাদী সিনেমা না বলা গেলেও এটি নিঃসন্দেহেনারীর কিছু অধিকারকে তুলে ধরেছে। লন্ডনে বসবাসরত একটি শিখ পরিবারের মেয়ে ফুটবলার হতে চাইলে সৃষ্টি হয় নানা জটিলতা। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি তারপরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হয়। সে ফুটবলার হওয়ার পথে পা বাড়ায়। নারীর নিজস্ব অভিরুচি অনুযায়ী যে কোনো পেশা বেছে নেওয়ার অধিকার প্রতিফলিতহয়েছে এতে।

বলিউডের মতো হলিউডেও পুরুষের প্রাধান্য রয়েছে বলাই বাহুল্য। এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে হলিউডি মুভিতে পুরুষ চরিত্রকে যতক্ষণ পর্দায়দেখা যায় নারীকে ততক্ষণ নয়। নির্মাতা হিসেবেও এখানে পুরুষেরই একচেটিয়া দাপট।তবে কয়েকজন নারী নির্মাতা সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন। নারীপরিচালকের অ্যানিমেটেড ফিল্ম ‘ফ্রোজেন’ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বক্স-অফিসে এবং অস্কারও পেয়েছে। হলিউডে রয়েছেন ক্যাথেরিন বিগেলোর মতো পরিচালক যিনি জয় করেছেন বাফটা ও ডিজিএ-র মতো পুরস্কার। রয়েছেন বারবারা স্ট্রেইস্যান্ডের মতো নারী নির্মাতাও। ডেবরা গ্রানিকের ‘উইন্টারস বোন’, লিসা কলোডেনকোর ‘দ্য কিডস আর অলরাইট’ - সমালোচকদের প্রশংসায় সিক্ত হয়েছে। নারী নির্মাতারা শুধু গুরুগম্ভীর ছবি তৈরি করেন না, তারা কমেডি বা হররের মতো বাণিজ্যিক ধারার ছবিতেও সফল। মার্থা কুলিজের ‘রিয়েল জিনিয়াস’, পেনেলোপি স্ফিরির ‘ওয়েনিস ওয়ার্ল্ড’ , পেনি মারশালের ‘বিগ’ দমফাটানো হাসির ছবি।‘পেট সেমেটরি’র মতো হরর এবং ‘শ্রেক’ এর মতো অ্যানিমেশনও তো জন্ম দিয়েছেন নারী পরিচালকরাই।

১৯৭০ সাল থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একজন, দুজন করে নারী পরিচালক এসেছেন। রেবেকা, রোজী (সামাদ) আফসারী, সুচন্দা, নার্গিস আক্তার,সামিয়া জামান, জাহানারা নূরী, ক্যাথরিন মাসুদ,শামীম আখতারসহ বেশ কয়েকজন নারী বাংলাদেশে চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন বা করছেন।

'মেঘলা আকাশ', 'মেঘের কোলে রোদ', 'চার সতীনের ঘর','অবুঝ বউ', 'পৌষ মাসের পিরিত' এবং 'পুত্র এখন পয়সাওয়ালা'র মতো সফল বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণ করেছেন নার্গিস আক্তার।

‘রানী কুঠির বাকি ইতিহাস’ এবং ‘আকাশ কত দূরে’ সামিয়া জামানের চলচ্চিত্র।

জহির রায়হানের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে ‘হাজার বছর ধরে’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করে ২০০৫ সালে সেরা পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান সুচন্দা। জাহানারা নূরী, শামীম আখতার, আরিফা পারভীন মৌসুমী এবং ক্যাথরিন মাসুদ ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে প্রশংসিত হয়েছেন। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের যৌথভাবে নির্মিত ‘মুক্তির গান’, তারেক মাসুদ ও শামীম আখতারের ‘সে’, শামীম আখতারের ‘শিলালিপি’, ইয়াসমিন কবিরের ‘স্বাধীনতা’, ফৌজিয়া খানের ‘সে কথা বলে যাই’, তাসমিয়া আ|ফরিন মৌ এর ‘রূপান্তরের কথা’ শিল্পধারার চলচ্চিত্র হিসেবে প্রশংসিত। শাহনেওয়াজ কাকলীর ‘উত্তরের সুর’ ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে।

নারী পরিচালকের চলচ্চিত্র মানেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সনাতন পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণার বিপরীতে নারীকে ভিন্নমাত্রায়, স্বকীয় দীপ্তিতে উজ্জ্বল করে চিত্রায়নের প্রচেষ্টা।