ওয়ারফেইজ: তিন দশকের ‘পথচলা’

ত্রিশ বছরের পথ চলায় চড়াই, উৎড়াই পেরোতে হয়েছে অনেক, তবু থামেনি ছুটে চলা। বাংলাদেশের রক সংগীতের জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করা ব্যান্ডটির নাম ‘ওয়ারফেইজ’।

চিন্তামন তুষারচিন্তামন তুষারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Feb 2015, 11:51 AM
Updated : 3 Feb 2015, 09:18 AM

বন্ধু আর ভক্তদের সঙ্গে রাজত্বের ত্রিশ বছর পূর্তি উদযাপন করলো ওয়ারফেইজ। বসুন্ধরা কনভেনশন সিটি সেন্টারে আয়োজিত লেগেসি কনসার্টে যোগ দিয়েছিলেন কয়েক প্রজন্মের শ্রোতা-ভক্তরা। ব্যান্ডের বর্তমান সদস্যদের সঙ্গে ছিলেন সাবেক সদস্যরা।

ওয়ারফেইজ ব্যান্ডের পথচলার শুরু ১৯৮৪ সালের ৫ই জুন। ব্যান্ডটির বেড়ে ওঠা আড্ডার গণ্ডিতে। কনসার্টে সে কথা স্মরণ করলেন ব্যান্ডটির দীর্ঘ দিনের কান্ডারি এবং ড্রামার শেখ মনিরুল আলম টিপু।

“কলাবাগানে রাসেল-রোমেলদের বাসার ছাদে আমরা প্র্যাকটিস করতাম। ছাদে একটা রুম ছিল, সেই রুমেই চলত আমাদের আড্ডা।”

ওয়ারফেইজ প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্তি উদযাপনের কনসার্টে কমল, মিজানদের সঙ্গে অতিথি গিটারিস্ট সামির হাফিজ। ছবি: চিন্তামন তুষার/বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।

ওয়ারফেইজ প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্তি উদযাপনের কনসার্টে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইব্রাহিম আহমেদ কমল। ছবি: চিন্তামন তুষার/বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।

রোমেল তার সঙ্গে যোগ করেন, “রুমটির ঠিক নিচেই ছিল মায়ের ঘর। তাকে অনেক অত্যাচার করেছি আমরা। কিন্তু তিনি সবসময় আমাদের পাশে থেকেছেন। আমাদের শত অত্যাচারে এতটুকু বিরক্ত না হয়ে উৎসাহ দিয়েছেন।”

শুরুতে ব্যান্ডটি কাভার করেছে হোয়াইটস্নেক, ডোকেন, আয়রন মেইডেনের মতো হেভি মেটাল ব্যান্ডের গান। তাদের সমসাময়িকদের মধ্যে ফিডব্যাক, রেঁনেসা, সোলস, আজম খানের উচ্চারণ এবং ঝিঙ্গা - ব্যান্ডগুলো তখন মেলোরক, সফট রক, জ্যাজ-ব্লুজ প্যাটার্ন, কিংবা রক এন রোল নিয়ে ব্যস্ত - আর তারা সবাই গাইছেন বাংলা গান।

টিপুর জবানিতে সেই স্মৃতিও উঠে এলো, “আমরা শুরুতে হেভি মেটাল ব্যান্ডগুলো কাভার করেছি। স্বাভাবিকভাবে সবই ইংরেজি ভাষার গান।”

ইংরেজি বাদ দিয়ে বাংলায় গান করার প্রেরণা দিয়েছিলেন সেই সময়ের ফিডব্যাক ব্যান্ডের মাকসুদুল হক।

ওয়ারফেইজ প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্তি উদযাপনের কনসার্টে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শেখ মনিরুল আলম টিপু। ড্রামসের পাশাপাশি ব্যান্ডটির দীর্ঘদিনের কান্ডারি তিনি। ছবি: চিন্তামন তুষার/বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।

ওয়ারফেইজ প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্তি উদযাপনের কনসার্টে ‘অবাক ভালোবাসা’ গানটির পরিবেশনায় কিবোর্ডিস্ট রোমেল আলী। ছবি: চিন্তামন তুষার/বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।

“মাকসুদ ভাই আমাদের বোঝালেন, বাংলায় গান করতে হবে। ‘নিজেদের ভাষায় কেন গান করবে না তোমরা?’ তারপর আমরা নিজেদের গান বাধতে শুরু করি”- বললেন টিপু।

তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘ওয়ারফেইজ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। মেলোডিনির্ভর গানে অভ্যস্ত শ্রোতাদের কাছে আদপে যা ছিল ‘ভীষণ’ এবং ‘বিকট’ আবার একইসঙ্গে সুরেলা।

কিন্তু অ্যালবামের সাফল্য এসেছে অনেক পরে। তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘অবাক ভালোবাসা’ প্রকাশিত হয় তিন বছর পর ১৯৯৪ সালে। অ্যালবামের বেশ কয়েকটি গান অল্প দিনেই শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে। এ গানগুলোর মধ্যে ছিল, ‘অবাক ভালোবাসা’, ‘যখন’, ‘অন্য ভূবন’। প্রথম অ্যালবামের গানগুলো আলোচনায় চলে আসে এরপরই। ‘অবাক ভালোবাসা’, ‘নির্বাসন’, ‘পথচলা’, ‘একটি ছেলে’, ‘বসে আছি একা’, ‘কৈশোর’, ‘বৃষ্টি নেমেছে’ গানগুলো আজও নতুন শ্রোতা তৈরি করে চলেছে।

 কনসার্টে ঘুরেফিরে সেই গানগুলো গাওয়ার জোর আবেদন শোনা যাচ্ছিল শ্রোতাদের সারি থেকে। তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে বাবনা করিম, সঞ্জয়, মিজান নিজেদের যেন উজাড় করে দিলেন।

ব্যান্ডটির প্রথম লাইনআপে বেইজ বাজাতেন ইব্রাহিম আহমেদ কমল, তার সঙ্গে ছিলেন হেলাল, মীর, নাঈমুল ও বাপ্পী। সেই লাইনআপ বেশিদিন টেকেনি। এরপর কমল হাতে নিলেন গিটার, ড্রামসে এলেন টিপু, বেইজে বাবনা এবং ভোকালে রাশেদ। রাশেদ চলে গেলে আরও এলেন সঞ্জয়।

‘জীবনধারা’ (১৯৯৭), ‘অসামাজিক’ (১৯৯৮) অ্যালবামসহ প্রথম দুটিতে গান গেয়েছেন সঞ্জয়।

ওয়ারফেইজ প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্তি উদযাপনের কনসার্টে ‘অবাক ভালোবাসা’ গানটির পরিবেশনায় কিবোর্ডিস্ট শামস মনসুর। ছবি: চিন্তামন তুষার/বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।

ওয়ারফেইজ প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্তি উদযাপনের কনসার্টে ব্যান্ডের অতিথি গিটারিস্ট সামিরসহ এক সময়ের ভোকালিস্ট সঞ্জয়, গিটারিস্ট কমল এবং বেইজিস্ট বাবনা। ছবি: ইশতিয়াক সোবহান/বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।

এসময়ের লাইনআপে- সঞ্জয়, বাবনা, টিপু, কমলদের সঙ্গে ব্যান্ডটির ধরন তৈরিতে আরও একজন অবদান রেখেছেন। তিনি হলেন রাসেল আলী। প্রথম দুই স্টুডিও অ্যালবামে যিনি গিটার, কিবোর্ড বাজানোর পাশাপাশি বেশ কিছু কালজয়ী গানের সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন। তার অবদানের কথা স্মরণ করে ব্যান্ডটি পরিবেশন করে ‘আশা’ গানটি।

শুরু থেকেই ভাঙ্গাগড়া ব্যান্ডটির নিত্যসঙ্গী। কমলকে চলে যেতে হয় বিদেশে। ফিরেও এসেছেন তিনি। এভাবে আরও কয়েকবার আসা-যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে ব্যান্ডের প্রতি তার সমর্থন ছিল অক্ষুন্ন। এমনকি টিপু যখন স্থবির ব্যান্ডের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে একেবারে নতুন সদস্যদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন, তখনও বিদেশ থেকে কমল তাকে সমর্থন দিয়ে গেছেন।

টিপু এবং কমল জুটিকেই তাই মঞ্চের আলোয় আসতে হয়েছে বারবার। তবে সঞ্জয়, বাবনাদের ঘিরেও ছিল ভক্তদের উন্মাদনা।

ব্যান্ড সংগীতের ক্ষেত্রেও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন ব্যান্ডের কন্ঠশিল্পীরা। প্রথম চার অ্যালবামের কণ্ঠশিল্পী সঞ্জয় এদিক থেকে কী কিছুটা অবহেলিত? নাকি মঞ্চ দাপিয়ে গাওয়া এবং অতিদ্রুত লয়ে ও হাই পিচে কণ্ঠ মেলে ধরার ক্ষমতা ভুলে গেছেন ভক্তরা? প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই না। কিছুই ভোলেনি কেউ।

ছোটখাটো গড়নের সঞ্জয় ‘তুমি কি দেখেছ’, ‘মনে পড়ে’, ‘বসে আছি’, ‘তুমি আমি যেন ছিলাম’ এবং গানস অ্যান্ড রোজেসের ‘ডোন্ট ইউ ক্রাই’ গানগুলো গেয়ে অস্তিত্বের জানান দিলেন জোরেসোরেই।

‘অসামাজিক’ অ্যালবামের পর থেকে সঞ্জয় ব্যান্ডে অনুপস্থিত। তার যোগ্য উত্তরসুরী মিজান রহমান; একইসঙ্গে দলে প্রবেশ শামস মনসুর গণির। তাদের অবদানে, টিপু- কমলের হাত ধরে ব্যান্ডটি গত ১৫টি বছর তাদের গতিপথ সাজিয়েছে। আর শ্রোতারা পেয়েছে ‘আলো’, ‘মহারাজ’, ‘সত্য’ অ্যালবাম তিনটি। সেই সঙ্গে সংকলিত অ্যালবাম ‘পথচলা’।

ওয়ারফেইজ প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্তি উদযাপনের কনসার্টে ব্যান্ডের এক সময়ের বেইজিস্ট বাবনা করিম। ছবি: চিন্তামন তুষার/বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।

ওয়ারফেইজ প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্তি উদযাপনের কনসার্টে নাঈম হক রজার। ছবি: চিন্তামন তুষার/বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।

‘হতাশা’, ‘বেওয়ারিশ’, ‘সময়’, ‘মৃত্যু এলিজি’, ‘যতো দূরেই থাকো’, ‘আলো’, ‘মহারাজ’, ‘বাঙালিরা আর কতো দেখবে’, ‘অতীত’, ‘সাইক্লোন’, ‘আগামী’, ‘না’, ‘রূপকথা’, ‘পূর্ণতা’ গানগুলো এসেছে অ্যালবাম তিনটি থেকে। ভক্তদের আশা মেটাতে কনসার্টে গানগুলো শোনাতে হয়েছে ব্যান্ডটিকে।

শ্রোতাদের অন্যতম দাবি ছিল ‘অবাক ভালোবাসা’ গানটি শোনার। সেই দাবি পূরণের পর শামস এবং রোমেল আলী ‘যেদিন’ গানের সুরটিও ধরলেন এক ফাকে।

মঞ্চ তখন পালা পরিবর্তনের বিরতিতে ফাঁকা। রোমেল এসে তার দুই কিবোর্ডের টুলে আসীন হলেন। সলো বাজানোর দাবি ছিল ভক্তদের। খানিকটা শুনিয়ে দিলেন। একটু পরেই শামস এলেন মঞ্চে, শুরুটা করলেন তিনিই। ধুন উঠতেই নোট বাজানো শুরু করলেন রোমেল। পেছনে পেছনে শামসের কর্ড বাজনায় স্পষ্ট হয়ে উঠল ‘যেদিন’।

এরপর বালামকে নিয়ে মিজান গাইলেন ‘মহারাজ’। টিপু জানালেন, বালাম মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকে ব্যান্ডটির সুরস্রষ্টাদের একজন। ‘কৈশোর’ গানটি লিখেছিলেন এবং সুর দিয়েছিলেন বালাম।

ওয়ারফেইজ প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্তি উদযাপনের কনসার্টে ব্যান্ডটির কিবোর্ডিস্ট শামস ও অতিথি গিটারিস্ট সামির হাফিজ। ছবি: চিন্তামন তুষার/বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।

ওয়ারফেইজ প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্তি উদযাপনের কনসার্টে বেইজিস্ট, কম্পোজার বাবনা। ছবি: চিন্তামন তুষার/বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।

আরও স্মরণ করা হলো সাবেক সদস্য ফুয়াদ ইবনে রাব্বি, আসিফ ইকবাল জুয়েল, সাইদুস সালেহিন সুমন, সেজান, সাজ্জাদ আরেফিন, বিজুদের কথা।

২৫ বছর পূর্তির কনসার্টে রাসেল ফাঁকি না দিলেও এবার ঠিকই ভক্তদের হতাশায় ডুবিয়েছেন। আরেক সদস্য তরুণ গিটারিস্ট অনি হাসানও ছিলেন অনুপস্থিত। পড়াশোনার উদ্দেশ্যে বিলাত গিয়েছেন কিছুদিন হলো। তার পরিবর্তে ছিলেন পাওয়াসার্জ ব্যান্ডের সামির হাফিজ।

ব্যান্ডের বর্তমান আরও এক সদস্য নাঈম হক রজার। বেইজিস্ট হিসেবে একদশকেরও বেশী সময় ধরে ব্যান্ডটিতে আছেন তিনি।

কনসার্টের অন্তে এসে নিজে থেকেই টিপু বললেন, এত ভাঙ্গা-গড়ার পরও ওয়ারফেইজকে কীভাবে এগিয়ে নিয়েছেন তারা।

“ব্যান্ডের শুরু থেকে একটা বিষয়ে একমত ছিলাম। আমরা হেভি মেটাল, হার্ডরক ধাঁচের গান করব। সেই পথে চলতে গিয়ে অনেকেই এসেছেন ব্যান্ডে। তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন মেধাবী এবং প্রতিভাবান। প্রত্যেকেই নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখার পাশাপাশি ব্যান্ডে অবদান রাখার ক্ষেত্রে ছিলেন অনন্য। তাদের নিজস্বতা, অনন্যতা নিয়ে ওয়ারফেইজ হয়েছে সমৃদ্ধ।”

ওয়ারফেইজ আরও সমৃদ্ধ হোক, আরও নতুন নতুন গান উপহার দিক এমন প্রত্যাশা জানালেন কনসার্টে আগত ভক্তরা।

আইটি প্রকৌশলী ইমতিয়াজ হক বললেন, “২৫ বছর পূর্তির কনসার্টে দেখেছিলাম কলেজ-ইউনিভার্সিটি পড়ুয়াদের ঢল। এবারে লক্ষ্য করলাম মাঝবয়সী ভক্তদের বিপুল উপস্থিতি। সঙ্গে হয়তো তাদেরই কিশোর বয়সী উত্তরসুরী।”

“খুব ভালো লেগেছে, আমার পরবর্তী প্রজন্ম যারা হয়তো মাত্র ‘এ’ লেভেল, ‘ও’ লেভেল শেষ করেছে। তারা অনেক পুরোনো গান, যে গানগুলো আমরাও খুব কম শুনেছি। সেই গানগুলো সঞ্জয়ের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছে।”

কনসার্টের শেষ গানটি ছিল ‘একটি ছেলে’।