আমেরিকান স্নাইপার: আরও একবার যুক্তরাষ্ট্রকে মহান করার চেষ্টা?

অস্কারে ছয়টি মনোনয়ন বাগানো আর বক্স-অফিসে দাপটের কারণে 'আমেরিকান স্নাইপার'কে ঘিরে আলোচনার শেষ নেই। তবে ক্লিন্ট ইস্টউডের নতুন এই সিনেমা সম্প্রতি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। ইরাক যুদ্ধে অংশ নেওয়া মার্কিন নৌবাহিনীর গুপ্ত বন্দুকধারী ক্রিস কাইলের বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্মীত সিনেমাটি সমালোচিত হচ্ছে সিনেমাটিতে ইরাকিদের ‘সন্ত্রাসী’ এবং ‘বর্বর’ হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2015, 06:52 AM
Updated : 24 Jan 2015, 07:15 AM

অনেকেই বলছেন ‘আমেরিকান স্নাইপার’- ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ভূমিকার ওপর মহত্ব আরোপের চেষ্টা করছে, ক্রিস কাইলের মতো গুপ্তঘাতককে নায়কের মর্যাদা দিয়ে।

২০১২ সালে নিজের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা নিয়ে ক্রিস কাইলের আত্মজীবনী ‘আমেরিকান স্নাইপার: দ্য অটোবায়োগ্রাফি অফ দ্য মোস্ট লিথাল স্নাইপার ইন ইউএস মিলিটারি হিস্টোরি’ অবলম্বনে সিনেমাটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রূপদান করেছেন ব্র্যাডলি কুপার। সিনেমাটি এবারের অস্কারে ‘সেরা সিনেমা’ এবং ‘সেরা অভিনেতা'সহ ছয়টি বিভাগে মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছে।

নিজের আত্মজীবনীতে ক্রিস কাইল বলেছিলেন, যুদ্ধে একজন শার্পশুটার হিসেবে যে হত্যাযজ্ঞ তিনি ঘটিয়েছিলেন, সে সব নিয়ে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই তার। ধারণা করা হয় যুদ্ধে তিনি একাই ২৫৫ জনের প্রাণ নিয়েছিলেন। পেন্টাগনের হিসাবে এই সংখ্যা ১৬৬। একারণে ক্রিস কাইলকে অভিহিত করা হয় মার্কিন সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক গুপ্ত বন্দুকধারী হিসেবে।

ইরাক যুদ্ধ নিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের সমালোচনা করে বানানো প্রামাণ্যচিত্র ‘ফারেনহাইট নাইন/ইলেভেন’-এর নির্মাতা মাইকেল মুর টুইটারে ‘আমেরিকান স্নাইপার’-এর নির্মাতাদের বিদ্রুপ করেছেন ‘কাপুরুষ’ বলে। তার মতে, গুপ্তবন্দুকধারীদের নায়কোচিত রূপায়নের কিছু নেই।

তিনি বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমার চাচা নিহত হয়েছিলেন গুপ্ত বন্দুকধারীর গুলিতে। আমাদের শেখানো হয়েছে, গুপ্ত বন্দুবধারীরা আসলে কাপুরুষ। তারা পেছন থেকে গুলি করে। গুপ্ত বন্দুকধারীরা কখনোই নায়ক নয়।”

পরবর্তীতে আরও কয়েকটি টুইটে সিনেমাটিতে নিয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুর।

“ওহ, পুরো সিনেমাজুড়েই ইরাকিদের ‘বর্বর’ হিসেবে উল্লেখ করা হল।”

“আরও একবার নির্মম সত্যটি উপস্থাপনের জন্য দুঃখিত। যে কোনো দেশ, যারা আমাদেরকে আক্রমণ করেনি, তাদের ওপর হামলা চালানো অনৈতিক এবং বেআইনি। ইতিহাস আমাদের নিষ্ঠুর হিসেবেই বিচার করবে।”

অভিনেতা এবং নির্মাতা সেথ রোগেন, উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি কিম জং-উনকে নিয়ে যার বিদ্রুপাত্মক সিনেমা ‘দ্য ইন্টারভিউ’ ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে সম্প্রতি, তিনি বলেন, সিনেমাটি তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে নাৎসি প্রোপাগান্ডা সিনেমাগুলোর কথা।

তার টুইট, “‘আমেরিকান স্নাইপার’ আমাকে মনে করিয়ে দিল কুয়েন্টিন টারান্টিনোর ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’-এর তৃতীয় অংকে দেখানো সিনেমাটির কথা।”

কুয়েন্টিন টারান্টিনোর ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’ সিনেমার যে দৃশ্যটির কথা বলেছেন রোগেন, সেখানে দেখানো হয়েছিল হলে বসে একটি একটি সিনেমা উপভোগ করছেন নাৎসি সেনা সদস্যরা, যেখানে মূলত যুদ্ধে এক নাৎসি গুপ্তঘাতকের জয়গান গাওয়া হচ্ছিল।

মাইকেল মুর এবং সেথ রোগেনের এই বক্তব্য বিতর্কের ঝড় তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রে। সারাহ পালিন, নিউট গ্রিনউইচের মতো অনেক রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ তাদেরকে অভিহিত করছেন ‘বামপন্থি’ হিসেবে।

সারাহ পালিন তার ফেইসবুক পেইজে  লিখেছেন, “আমাদের সৈন্যরা চিরজীবি হোক; বিশেষ করে আমাদের গুপ্ত বন্দুকধারীরা।”

“হলিউডের বামপন্থিরা, আপনাদের স্বাধীনতার জন্য যারা যুদ্ধ করছেন, তাদের কবরে থুতু ফেলার আগে জেনে রাখুন, ক্রিস কাইলের জুতা পালিশ করার যোগ্যও আপনারা নন।”

হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস-এ রিপাবলিকানদের সাবেক স্পিকার নিউট গ্রিনউইচ টুইট করেন, “মাইকেল মুরের উচিত আইসিস এবং বোকো হারেমের জিম্মায় কিছুদিন কাটিয়ে আসা। এরপরই কেবল তিনি ‘আমেরিকান স্নাইপার’-এর গুরুত্ব বুঝবেন।”

মুক্তির পরপরই বক্স-অফিসে ঝড় তোলা ‘আমেরিকান স্নাইপার’ আলাদাভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ইরাক যুদ্ধফেরত মার্কিন সৈন্যদের কাছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক জায়গায় সিনেমাটির বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যাবস্থাও করেছে তারা।

তবে এদের মধ্যে ব্যাতিক্রম আছেন কিছু। ত্রিশ বছর বয়সী কাপুটি, যিনি ২০০৪-২০০৫  সালের মধ্যে সাত মাস কাটিয়েছিলেন ইরাকের আনবার প্রদেশে, তিনি বলেন, সিনেমাটি তার কাছে ভাল লাগেনি।

“সিনেমাটিতে ইরাকে মার্কিন যুদ্ধকে অনেক পরিশীলিত রূপে দেখানো হয়েছে। ইরাকিদের প্রতিরোধের প্রকৃতিও এখানে ভালোভাবে তুলে ধরা হয়নি।”

কাপুটি আরও বলেন, সিনেমাটিতে ইরাকিদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়নি। নিজেদের মাটিতে আক্রমণকারী ভিনদেশি সৈন্যদের তারা কেন এতো ঘৃণার চোখে দেখতো, সেটারও কোন ব্যাখ্যা মেলেনি।

তিনি আরও বলেন, সিনেমাটিতে যুদ্ধে ইরাকি আর মার্কিন সৈন্যদের ভূমিকা যেভাবে ভালো আর খারাপের সরলীকৃত চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে, সত্যিকারের যুদ্ধে ব্যাপারটি মোটেও সেরকম ছিল না।

তিনি বলেন, “ইরাকে আমার অভিজ্ঞতার পর থেকে আমি ‘ভালো মানুষ’ আর ‘খারাপ মানুষ’-এ বিশ্বাস করা বন্ধ করে দিয়েছি।"

সিনেমাটির অভিনেতা ব্র্যাডলি কুপার অবশ্য দাবি করেছেন, ইরাক যুদ্ধ নিয়ে সিনেমাটি তৈরি হলেও, রাজনৈতিক কোন অভিসন্ধি তার কিংবা পরিচালকের ছিল না।

“আমার এবং ক্লিন্ট (ইস্টউড)-এর জন্য সিনেমাটি সবসময়ই ছিল একটি চারিত্রিক গবেষণা। যুদ্ধে এক সেনার দ্বন্দ্ব কিরকম হতে পারে, সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমরা।”