অস্কারে শীর্ষ দশ উপেক্ষা

এবারের অস্কার মনোনয়ন বোদ্ধা, দর্শক - দুই মহলকেই চমকে দিয়েছে। 'সেলমা'র অভিনেতা ডেভিড ওয়েলো কিংবা 'বিগ আইজ' - এর অভিনেত্রী এমি অ্যাডামসের মনোনয়নই না পাওয়া অবাক করার পাশাপাশি হতাশও করেছে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের। অস্কারের মঞ্চে সারা জাগানো সিনেমা কিংবা অভিনয়নৈপুণ্য উপেক্ষিত থাকার ইতিহাস নতুন নয়।

শরীফুল হক আনন্দবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2015, 02:08 PM
Updated : 19 Jan 2015, 02:34 PM

এবার জেনে নেওয়া যাক এমন অস্কার আসরে এমন দশটি উপেক্ষার ঘটনার কথা।

১. সিটি লাইটস (১৯৩১) এবং মডার্ন টাইমস (১৯৩৬)


কিংবদন্তী অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন অস্কার মঞ্চে সর্বাধিক উপেক্ষিত নামগুলোর মধ্যে অন্যতম। সম্মানসূচক অস্কার পেলেও তাঁর কোনো সিনেমা কিংবা অভিনয় তাঁকে এনে দিতে পারেনি অস্কার। চ্যাপলিনের ‘সিটি লাইটস’ এবং ‘মডার্ন টাইমস’ চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম সেরা দুটি সিনেমার স্বীকৃতি পেলেও সে সময়ে সমালোচকদের কাছে উপেক্ষিতই থেকেছে, পায়নি কোনো অস্কার মনোনয়ন। ‘দ্য ফ্রন্ট পেইজ’, ‘ইস্ট লিন’, ‘স্কিপি’, ‘ট্রেডার হর্ন’ এবং ১৯৩১ - এ সেরা সিনেমার অস্কার জেতা ‘সিমারন’ এর মত সিনেমাগুলোর সঙ্গে লড়তে পারে নি ‘সিটি লাইটস’। অপরদিকে ১৯৩৬ এ ‘দ্য গ্রেইট জিগফিল্ড’, ‘স্যান ফ্র্যান্সিসকো’ এবং ‘দ্য স্টোরি অফ লুই পাস্তুর’ সিনেমাগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপেক্ষিত ছিল ‘মডার্ন টাইমস’।

২. বেটি ডেভিস, অফ হিউম্যান বন্ডেজ (১৯৩৪)
‘অফ হিউম্যান বন্ডেজ’ সিনেমাতে ঘৃণিত এক পরিচারিকার ভূমিকায় দূর্দান্ত অভিনয়ের পরও অস্কারে কোনো মনোনয়ন পান নি ‘অল অ্যাবাউট ইভ’ খ্যাত তারকা বেটি ডেভিস। সেস ময়ে কাগজে কলমে ভোটের ব্যবস্থা থাকায় কোনো একটা কারণে তার নামে আশ্চর্যজনকভাবে কম ভোট পড়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যান অ্যাকাডেমি বোর্ডের সদস্যরা। এমনকি নিষিদ্ধ করা হয় কাগজে ভোটদানের এই ব্যবস্থাটি। শেষ পর্যন্ত তার ভক্তরা অস্কার মনোনয়নের জন্য শুরু করেন বিরাট প্রচার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে হার মানতে হয় অভিনেত্রী ক্লদেট কোলবার্টের কাছে। তবে পরের বছরই ‘ডেঞ্জারাস’ সিনেমায় অভিনয় তাকে এনে দেয় সেরা অভিনেত্রীর অস্কার।
৩. অরসন ওয়েলেস, দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট অ্যাম্বারসন্স (১৯৪২)
‘সিটিজেন কেইন’ এর মতো সিনেমা বানিয়েই ক্ষান্ত হননি কিংবদন্তী পরিচালক অরসন ওয়েলেস। পরের বছরই নিয়ে আসেন ‘দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট অ্যাম্বারসন্স’। উইলিয়াম র‍্যানডল্ফ হার্টজকে সেলুলয়েডে নিয়ে আসায় কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি হলেও অসাধারণ চিত্রনাট্য এবং সিনেমাটোগ্রাফির জন্য সমালোচক মহলে দারূনভাবে প্রশংসিত হয় সিনেমাটি। অস্কার আসরে ‘দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট অ্যাম্বারসন্স’ চারটি মনোনয়ন পেলেও ওয়েলেসের ভাগ্যে জোটেনি সেরা পরিচালকের মনোনয়ন। অ্যাকাডেমির সদস্যরা ওয়েলসকে উপেক্ষা করে বেছে নেন ‘দ্য ওয়েক আইল্যান্ড’ এর পরিচালক জন ফ্যারো এবং ‘কিংস রো’র পরিচালক স্যাম রোকে।
৪. অ্যালফ্রেড হিচকক, ভার্টিগো (১৯৫৮)
২০১২ সালে সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের করা একটি তালিকায় শতাধিক সমালোচকদের ভোটে ‘ভার্টিগো’ সিনেমাটি পায় সর্বকালের সেরা সিনেমার খেতাব। তবে মুক্তির সময় আলফ্রেড হিচকক এবং ‘ভার্টিগো’কে পাত্তাই দেননি কোনো সমালোচক। এমনকি অস্কার আসরে একটি মনোনয়ন জিততেও ব্যর্থ হয় সিনেমাটি। ‘সেপারেট টেবলস’, ‘আন্টি ম্যামে’, ‘দ্য ডিফায়েন্ট ওয়ানস’, ‘ক্যাট অন আ হট টিন রুফ’ এবং সেবার অস্কার জেতা ‘জিগি’র কাছে একেবারেই পাত্তা পায় নি ‘ভার্টিগো’। হিচককের কপালটাও ভারী মন্দ। অসাধারণ কিছু সিনেমা উপহার দেওয়ার পরও তার ভাগ্যে সম্মানসূচক অস্কার ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।

৫. অ্যান্থনি পারকিন্স, সাইকো (১৯৬০)
‘ভার্টিগো’ মুক্তির দুই বছর পর হিচকক নিয়ে আসেন তার আরেকটি অনবদ্য সৃষ্টি, যাকে বলা চলে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সিনেমা। কিন্তু অস্কার আসরে উপেক্ষার শিকার হয় এই সিনেমাটিও। 'সাইকো' নামের সেই সিনেমায় অ্যান্থনি পারকিন্স নরম্যান বেইটস নামের সেই ঐতিহাসিক চরিত্রের সফল রূপায়ন ঘটালেও সেরা অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পাননি। ধ্রুপদী মনস্তাত্বিক ভৌতিক সিনেমার কপালে চারটি অস্কার মনোনয়ন ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।
৬. এনিও মোরিকোনি, ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট (১৯৬৯)
সার্জিও লিওনি পরিচালিত অনবদ্য ওয়েস্টার্ন সিনেমা ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট’ এর সেই হাড়ে কাঁপন তোলা সুর সিনেমায় টান টান উত্তেজনার আবহ সৃষ্টি করেছিল সাফল্যের সঙ্গেই। কেবল ওয়েস্টার্নপ্রেমী নয় প্রায় সিনেমাপ্রিয় দর্শকের কাছে এই সুর চেনা। কিন্তু এত কিছুর পরও অ্যাকাডেমি বোর্ডের সদস্যরা সেবার মনোনীত করেন ‘দ্য সিক্রেট অফ সান্টা ভিটোরিয়া’ সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর করা সুরকার আর্নেস্ট গোল্ডকে।

৭. ডেনিস হপার, ব্লু ভেলভেট (১৯৮৬
)
ডেভিড লিঞ্চের ‘ব্লু ভেলভেট’ সিনেমায় ফ্র্যাঙ্ক বুথের চরিত্রে অভিনেতা ডেনিস হপারের অভিনয় আজও প্রশংসিত। সাইকোপ্যাথ হিসেবে তিনি চরিত্রের এতটাই গভীরে যান যে ডেনিস হপার এবং ফ্র্যাঙ্ক বুথকে আলাদা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। তবে অস্কার বোর্ড এত নিষ্ঠুর এক চরিত্রকে সম্মানিত করতে চায়নি। বরং আরেকটি সিনেমায় একজন বাস্কেট বল প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করে অস্কারের মনোনয়ন পান হপার।


৮. স্ট্যানলি কুবরিক, দ্য শাইনিং (১৯৮০)
‘সাইকো’কে উপেক্ষা করার বিশ বছর পর আরও এক বার বিতর্কের জন্ম ঘটে অস্কারে। ‘দ্য শাইনিং’ এর মতো সিনেমাকে উপেক্ষা করে বসে অ্যাকাডেমি। কিংবদন্তী পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিক ‘ড: স্ট্রেঞ্জলাভ’ থেকে শুরু করে ‘দ্য শাইনিং’ বের হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটি সিনেমার জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু ভৌতিক ঘরানার সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়া সিনেমা ‘দ্য শাইনিং’ এর জন্য পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয় তাকে। শুধু তিনিই নন, সিনেমায় দুর্দান্ত অভিনয় করেও স্বীকৃতি পাননি জ্যাক নিকলসন।

৯. ডু দ্য রাইট থিং (১৯৮৯)

যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণপ্রথা এবং তার প্রভাব নিয়ে নির্মিত স্পাইক লির ‘ডু দ্য রাইট থিং’ সিনেমাটি নিঃসন্দেহেই মার্কিন ইতিহাসে এক যুগান্তকারী সিনেমা। সে সময়ের বর্ণবাদের প্রেক্ষাপটকে হাস্যরসাত্মক কিন্তু অপরাধনির্ভর নাটকীয়তার মাধ্যমে উপস্থাপনের বিষয়টি ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে, অধিকাংশ সমালোচকদের মতে, সিনেমায় লি অনেকটা বর্ণ সংঘাতেরই ইঙ্গিত দিয়েছেন। আর সে কারণেই হয়তো সিনেমাটি অস্কার মঞ্চে থাকে পুরোপুরি উপেক্ষিত। অন্যদিকে, মার্কিন সমালোচক জিন সিসকেল এবং রজার এবার্টের করা একটি তালিকায় আশির দশকে হলিউডের সেরা দশটি সিনেমার তালিকায় স্থান পেয়েছিল ‘ডু দ্য রাইট থিং’।

১০. রবার্ট রেডফোর্ট, অল ইজ লস্ট (২০১৩)
পরিচালক হিসেবে রবার্ট রেডফোর্ট এর আগে জন্ম দিয়েছেন বহু বিতর্কের। এমনকি ১৯৮০ সালে মার্টিন স্করসেজির ‘রেজিং বুল’ সিনেমাটিকে হারিয়ে সেরা পরিচালক হিসেবে অস্কার জেতেন ‘অর্ডিনারি পিপল’ সিনেমাটির জন্য। আর সে বছরই ‘দ্য শাইনিং’ও অস্কারে পাত্তা পায়নি। তবে ত্রিশ বছর পর এসে নিজেই হলেন উপেক্ষার শিকার। ‘অল ইজ লস্ট’ সিনেমায় সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া এক নাবিকের ভূমিকায় অভিনয় তাকে এনে দেয় ভূয়সী প্রশংসা। কিন্তু অস্কার মঞ্চে সাফল্যের মুকুটটা পড়তে পারেনিন তিনি। তার জায়গায় মনোনয়ন পান ‘নেব্রাস্কা’ সিনেমায় অভিনয় করা ব্রুস ডার্ন এবং ‘আমেরিকান হাসল’- এ অনবদ্য অভিনয় করা জনপ্রিয় অভিনেতা ক্রিশ্চিয়ান বেল।