‘দেশা: দ্য লিডার’ - আর নয় হিন্দি সিনেমা

নতুন প্রজন্ম বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে কোনটি বেছে নেবে - হিন্দি সিনেমা নাকি বাংলা সিনেমা? উত্তরে বেশিরভাগই হয়তো বলবেন হিন্দি সিনেমার কথা।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Jan 2015, 10:07 AM
Updated : 11 Oct 2020, 10:28 AM

শাহরুখ- সালমান, ক্যাটরিনা-দিপিকাদের নাচে-গানে-অ্যাকশনে ভরপুর সিনেমা তাদের বিনোদিত করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সেই তুলনায় বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমা পিছিয়ে আছে বহু দিক থেকেই।

তবে, জাজ মাল্টিমিডিয়ার নতুন ছবি ‘দেশা: দ্য লিডার’ দেখার পর বলতেই হচ্ছে, হিন্দি সিনেমার সঙ্গে সমানতালে টক্কর দেওয়ার দিন বেশি দূরে নয়। অনেক দিন পর বাণিজ্যিক সিনেমার নিখাঁদ বিনোদনের খোঁজ পাওয়া গেল এই সিনেমায়।

সিনেমার মূল তিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন তারিক আনাম খান, মাহিয়া মাহি এবং নবাগত অভিনেতা শিপন। চরিত্রের সফল রূপায়নে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন তারিক আনাম খান। গ্ল্যামারাস উপস্থিতিতে মাহিয়া মাহি, ক্যাটরিনা কাইফদের টক্কর দেওয়ার মতো সম্ভাবনা দেখিয়েছেন। নায়ক শিপনের এটাই প্রথম সিনেমা; সংলাপ বলার সময় জড়তা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অতি-অভিনয় প্রমাণ করে তাকে যেতে হবে বহুদূর।

সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে চরিত্রটি সবচেয়ে সফল, সেটি তারিক আনাম খান অভিনীত রাজনীতিবিদ হাসান হায়দারের। ‘দেশা:দ্য লিডার’- এর মতো রাজনৈতিক থ্রিলারকে সফল করার জন্য হাসান হায়দারের মতো শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক চরিত্রেরই দরকার ছিল। চরিত্রটির উত্থান, বিকাশ, পরিবর্তন এবং পরিণতির সফল চিত্রায়নে সিনেমাটিকে স্বার্থক করে তুলেছেন তারিক আনাম খান।

সিনেমার প্রথমার্ধে হাসান হায়দারকে দেখানো হয় এক জনদরদী সৎ রাজনীতিবিদ হিসেবে। রাজধানীতে সব সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থেকেও মাটির সঙ্গে যার সংযোগ সবসময়ই অটুট। সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধে সেই হাসান হায়দারই আসল চেহারা দেখান।

হাসান হায়দার চরিত্রটিই যে আসলে গল্পের মূল খলনায়ক- সিনেমার প্রথমার্ধ পেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ঘূনাক্ষরেও তা টের পাবে না দর্শক। এই অংশে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নাটাই নিজের হাতে রাখতে বদ্ধপরিকর এক গডফাদারের ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হন তিনি। বাংলা সিনেমায় সাধারণত এই ধরনের চরিত্র অতি নাটকীয়তাদুষ্ট হয়ে পড়ে। তারিক আনাম খান সেই দোষ থেকে মুক্ত ছিলেন।

সিনেমার নায়িকার চরিত্রটি সাংবাদিক সৃষ্টির। চ্যানেল নাইন্টিনাইনের এই সুন্দরী প্রতিবেদক আবার রিয়ালিটি শো ‘হুজ আওয়ার নেক্সট লিডার’-এর উপস্থাপিকাও। অত্যন্ত সাহসী এবং ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার এই তরুণী নিজের ক্যারিয়ার নিয়েও উচ্চাভিলাষী। সিনেমার প্রযোজনেই তার চরিত্রটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে গ্ল্যামারাস হিসেবে।

সৃষ্টির চরিত্রের সফল রূপায়ণে যা যা দরকার ছিল- তার সবই করতে পেরেছেন মাহি। বাংলা সিনেমার গ্ল্যামারাস নায়িকা হিসেবে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে এসেছেন। এই সিনেমায় প্রমাণ করল অভিনয়ের দিক থেকেও কম যান না তিনি। অতি নাটকীয়তা মাঝেমধ্যে এসেছে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ছেদ ঘটায়নি তার সাবলীল উপস্থিতিতে।

রোমান্টিক, আবেগঘণ দৃশ্য থেকে টানটান উত্তেজনার মুহূর্তেও মাহির বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় প্রশংসার দাবীদার।         

তবে সিনেমার নায়ক শিপন কিছুটা হতাশই করলেন। নামভূমিকায় অভিনয় করলেও চরিত্রটির প্রতি সুবিচার করতে পারেননি নবাগত এই নায়ক।

সিনেমার প্রথমার্ধে আয়নাপুর গ্রামের সাধারণ যুবক সেলিম ভাগ্যজোরে পেয়ে যায় রাজনীতিবিদ হাসান হায়দারকে নিজের বাড়িতে আতিথ্য দেওয়ার সুযোগ। সেখানেই এক সন্ত্রাসী হামলায় সেলিমের বীরত্বকে পুরস্কৃত করতে হাসান হায়দার তাকেই বানিয়ে দেন নিজ দলের মুখপাত্র। নতুন প্রজন্মের রাজনীতিবিদ ‘দেশা’র খেতাব পাওয়া সেলিম রাতারাতি পেয়ে যায় তারকাখ্যাতি।

সিনেমার এই অংশে তার অভিনয়ে গ্রাম্য যুবকসুলভ জড়তা ছিল যুৎসই। কিন্তু যে বিষয়টি মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে, তা হলো গ্রামের ছেলে হয়েও পুরো সিনেমায় সেলিমের শহুরে বাচনভঙ্গিতে কথা বলা। তার ওপর সিনেমার শেষ দিকে সেলিম হাসান হায়দারের মুখোশ খুলে দিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার দৃশ্যে তার অতি-অভিনয় বাড়িয়েছে বিরক্তি। সংলাপ বলার ক্ষেত্রে দৃঢ়তা ও সাবলীলতার অভাবে চরিত্রটি গুরুত্ব হারিয়েছে অনেকখানি। তবে অ্যাকশনে দুর্দান্ত শিপন, ভাল নাচিয়েও বটে।

অন্যরকম গল্প, থ্রিলারের মূল উপাদান হিসেবে মোড়ে মোগে চমক, দৃশ্যায়নে বুদ্ধির পরিচয়, চিত্রায়ণে অভিনবত্ব- সবদিক থেকেই প্রশংসার দাবী রাখেন সিনেমার পরিচালক সৈকত নাসির। তবে ‘শেষ ভাল যার সব ভাল তার’- এই তত্ত্বে যারা বিশ্বাসী, তাদের সিনেমাটিকে পুরোপুরি সফল বলতে একটু বাঁধবেই। শেষ দশ মিনিটে সিনেমাটি থেকে প্রতাশিত নাটকীয়তার অভাব চোখে লেগেছে খুব। সিনেমাজুড়ে ঘটন-অঘটের সমাবেশে উত্তেজনার পারদ যেভাবে চড়িয়ে দিলেন নির্মাতা, সেখানে শেষটায় এসে এমন চুপসে যাওয়া পরিণতি মেনে নিতে কষ্টই হয়েছে।

সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় এখনকার দুনিয়ায় অনেক বড় ভূমিকা পালন করে গণমাধ্যম। সিনেমায় দেখানো চ্যানেল নাইন্টিনাইনের টিআরপি বাড়ানোর খেলা, রাজনৈতিক কুটচালে ক্ষমতার শীর্ষে থাকার অভিপ্রায়- তুলে এনেছে সেই বাস্তবতাকেই। সিনেমার অনেকগুলো দৃশ্য ভিডিও ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানোটা সে কারণেই ছিল অত্যন্ত আধুনিক এবং বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়াস। বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রেও এটি অভিনব এক কৌশলই বলা যায়। চিত্রনাট্যের দিক থেকেও বেশ পরিচ্ছন্ন গল্পকথন পাওয়া গেছে । কুশলতার পরিচয় পাওয়া গেছে শক্তিশালী বক্তব্যনির্ভর সংলাপগুলো থেকেও।

সিনেমাটি নির্মাণগত দিক থেকেও উচ্চমানের হতো, যদি পরিচালক এড়িয়ে যেতেন কিছু অপ্রযোজনীয় দৃশ্য আর অসঙ্গতিকে। দরকার ছিল না গতানুগতিক বাংলা সিনেমার প্রচলিত কিছু হাস্যরসের দৃশ্যও। আর আশুলিয়ায় দেখা করার দৃশ্য ধানমন্ডি লেকে কেন চিত্রায়িত হল- প্রশ্ন আছে সেটি নিয়েও। কিংবা সিনেমার ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সিআইডি গোয়েন্দাকেও শেষে এসে কেন খুঁজে পাওয়া গেল না, ব্যাখ্যা মিলল না তারও।  

তবে সিনেমাটির সংগীতায়োজন যুৎসই এবং উপভোগ্য। এই সিনেমার মাধ্যমেই অনেকদিন পর ঢাকাই সিনেমার প্লেব্যাকে ফিরলেন জেমস।  তার গাওয়া ‘আসছে দেশা আসছে’- গানটি সংগীতায়োজন, কন্ঠশৈলী, কথা, দৃশ্যায়ণ- সবদিক থেকেই ছিল অসাধারণ। দুটি রোমান্টিক গান ‘কতো রঙের হাতছানি’ এবং ‘একি মায়া’ও ছিল শ্রুতি মধুর। কিশোর এবং কনার গায়কিতে ‘কতো রঙের হাতছানি’ এই বছরের সেরা রোমান্টিক গান হওয়ার দাবি রাখে। এ আই রাজুর ‘একি মায়া’ও সিনেমায় সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছে।

সবদিক থেকে বিচার করলে, ‘দেশা: দ্য লিডার’ হাজির মনোরঞ্জনের সমস্ত উপকরণ নিয়েই। বাংলা সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া দর্শকরাও যে সিনেমাটি উপভোগ করছেন ব্যাপকভাবে, সিনেমাটির হাউজফুল প্রদর্শনী প্রমাণ করে সেটাই।

‘দেশা: দ্য লিডার’ ঢাকাই সিনেমা নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কথা বলে। আধুনিকতার মোড়কে এরকম সুস্থ ও জমজমাট বিনোদনই বাংলা চলচ্চিত্রের সুদিন ফেরাবে- এমন স্বপ্নই নির্ভয়েই দেখা যায় এখন।