চারুকলায় ‘ঝরা পাতার গান’

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় চলছে চার দিনব্যাপী ‘জয়নুল স্মৃতিচারণ, বার্ষিক প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’। ২৬শে ডিসেম্বর ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রথম দিন।

শরীফুল হক আনন্দবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2014, 09:34 AM
Updated : 29 Dec 2014, 12:03 PM

অনুষ্ঠানে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল জলের গান।

বিকেল তখনও পুরোটা ফুরিয়ে যায়নি, বার্ষিক প্রদর্শনীর কারণে উৎসবমুখর পুরো চারুকলা অনুষদ। সন্ধ্যা রাঙাতে আসার কথা চারুকলা অনুষদের সাবেক শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা গানের দল জলের গানের।

বকুলতলায় তখন উৎসুক শ্রোতাদের অপেক্ষা জলের গানের জন্য। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সামনের সারিতে অপেক্ষারত শ্রোতাদের কোলাহল বেড়ে গেল হঠাৎ করেই। মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন গানের দলটির সদস্য রাহুল আনন্দ। একে একে উঠলেন বাকিরাও।

ঘড়ির কাঁটা ছয়টা ছুঁই ছুঁই। বিকেলের শেষ আলোও ম্লান হবার পথে। আবার রাহুল আনন্দের পদার্পণ। অনেকটা প্রার্থনার ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা জানালেন সবাইকে। একইভাবে কনক, জার্নাল, জেম, সঞ্জয়রাও চলে এলেন মঞ্চে। পাশেই রাখা ঘণ্টাং ঢং ধ্বণি তুলে জানান দিলেন নিজেদের আগমনের।

পরিবেশনার শুরুতেই রাহুল নিজের নয়নতারাটি নিচে নামিয়ে রেখে এগিয়ে এলেন মঞ্চের সামনের দিকটাতে। খালি গলায় গেয়ে উঠলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানটি। সঙ্গে শ্রোতারাও উঠে দাঁড়িয়ে গলা মেলালেন।

হিম হিম শীতের কাঁপনে বকুলতলা অনুভব করলো ‘বাউলা বাতাস’। গানটি শেষে মঞ্চে দেখা গেল রাহুলের ছেলে তোতাকে। প্রায় অনুষ্ঠানেই বাবার সঙ্গী হয় তোতা। আর কেউ না থাকুক রাহুল এবং তোতা জলের গানের অনুষ্ঠানে থাকবেই থাকবে।

রাহুলের নয়নতারার মতোই দেখতে কাঠের যন্ত্র নিয়ে তোতা এলো মঞ্চে। রসিকতার সুরে রাহুল বললেন, “আমারটা যেমন নয়নতারা, তোতারটা তাই তোতারা”।

গোড়াতে চারুকলাতেই নিজেদের গানগুলো গাইতেন দলের সদস্যরা। সেইসঙ্গে চর্চাটুকুও করে নিতেন এর আশপাশের এলাকাতেই। এখনও পালা-পার্বণে বকুল তলায় জলের গানের হাজিরা নিশ্চিত।

সেইসব পুরোনো দিনের কথা স্মরণ করলেন সদস্যরা। আর সেই স্মৃতির জানালা ‍খুলতেই ভেসে এল ‘বকুল ফুল’ গানটি। সে গানের রেশ না কাটতেই শোনা গেল জার্নালের ‘পাখির ডাক’। রাহুলও পাখি হবার প্রার্থনায় তারই সুরে সুরে গাইলেন ‘এমন যদি হতো’।

পুরো বকুলতলা চত্বর ছেঁয়ে গেছে মানুষে, মঞ্চ থেকে মূল ফটক পর্যন্ত - সব জায়গায় ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়েছে মানুষ।

এরইমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ইমদাদ হোসেন এবং ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনকে উৎসর্গ করে ‘পাখির গান’ শোনালো দলটি। আরও শোনালো দুই পাগলের হারিয়ে যাওয়ার গাঁথা ‘এই পাগল’, চারুকলার চারুশিল্পীদের উৎসর্গ করে গাওয়া ‘রঙের গান’।

গান দুটি শেষ হতে না হতেই পাল্টে গেল সুর, বেজে উঠল ‘বন্ধুর গান’। মঞ্চ থেকে রাহুল আনন্দ বলে উঠলেন, “সবাই তার পাশের মানুষটির হাত ধরুন, তবেই গান গাইবো”। সমবেত কণ্ঠে সবাই গাইল ‘তুমি আমার পাশে বন্ধু, বসিয়া থাকো। একটু বসিয়া থাকো’।

‘কাগজের নৌকা’ গানটি গাইবার পাশাপাশি তুলে ধরা হলো এর পেছনের কথা। দল হিসেবে জলের গানের প্রথম গান ছিল এটি, মাকে উদ্দেশ্য করে লেখা গান।

একে একে তারা আরও গাইলেন ‘পঙ্খীরাজ’, ‘একাকী আসর’, ‘ঝরা পাতার গান’, ‘আন্ধার রাইতে’।

অনুষ্ঠানেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জলের গানের জন্য আসা চিঠিগুলো রাহুল পড়ে শোনালেন।

গানের দল হিসেবে জলের গান নিজেদের স্বকীয়তা তুলে ধরতে পেরেছে অল্পদিনেই। ‘নয়নতারা’ ও ‘চন্দ্রবান’ নামে নিজেদের আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। সেইসঙ্গে তাদের কাহন, বেহালা, বাঁশি এবং পারকাশনের ব্যবহার অনন্য।

তবে প্রচলিত এবং অপ্রচলিত যন্ত্রের সমাহারেও সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় রাহুল আনন্দের বাঁশির সুর। সে অন্য মোহ, সকল যান্ত্রিক মায়া থেকে মুক্ত হওয়ার উপায়। সে সুর যেন হিম শীতল সন্ধ্যায় নির্বানলাভের একমাত্র পথ।

অনুষ্ঠানে অনেকক্ষণ ধরেই গান করে করে গলা বসে গেছে সবার। এক কাপ চায়ের আবেদন জানাতেই সবার জন্য এলো চায়ের কাপ। দর্শকরাও মজে গেল ‘এক কাপ চা’ এর সুরে।

অনুষ্ঠানের প্রায় শেষের দিকে এসে রাহুল বললেন, “পকেটে দুটো গান আছে, গীতল চিঠি আর উড়ছি কেন। কোনটা করবো আপনারাই বলেন।” সবার অনুরোধে দুটি গানই গাইলেন তারা।

এদিকে ‘পাতার গান’ দিয়েই অনুষ্ঠান শেষ করার জন্য দর্শক সারি থেকে বারবার অনুরোধ আসছে। সবাইকে নাচাতে তাই শোনা গেল ‘পাতার গান’।

শুরুটা হয়েছিল সমবেত কণ্ঠে ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গেয়ে, শেষটাও যেন তেমন করেই হয়। রাহুল আনন্দের এমন আবেদনে সবাই দুহাত উঁচু করে আবারও গাইলো দেশের জন্য ভালোবাসায় মাখা এ গানটি।

ছবি কৃতজ্ঞতা: বায়েজিদ বিন ওয়াহিদ।