হিন্দি সিনেমার প্রথম সুপারস্টার 

নব্বই দশক। দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। চারিদিকে সাজ সাজ রব।

শান্তা মারিয়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2014, 06:02 AM
Updated : 29 Dec 2014, 06:02 AM

নয়া দিল্লির আসনের সংসদ সদস্য আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। তরুণ-তরুণীরা সবকিছু ভুলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার জন্য। না, শুধু একজন সংসদ সদস্যের জন্য তাদের এ উত্তেজনা এবং অপেক্ষা নয়। যিনি আসছেন তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ভারতের প্রথম সুপারস্টার। তিনি রাজেশ খান্না।

 হ্যাঁ, এমনই জনপ্রিয় ছিলেন রাজেশ খান্না। হিন্দি সিনেমায় তার সমকক্ষ এমনকি তার চেয়ে বড় অভিনেতাও হয়তো ছিলেন। কিন্তু খুব কম নায়কই পেয়েছিলেন তার মতো সর্বব্যাপী জনপ্রিয়তা। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।এমনকি এখনও বলিউডের সর্বকালের অন্যতম সেরা রোমান্টিক নায়ক হিসেবে দর্শক-হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন অধিকার করে আছেন।

১৯৪২ সালের ২৯শে ডিসেম্বর পাঞ্জাবের অমৃতসরে রাজেশ খান্নার জন্ম। স্থানটি বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত। তার পারিবারিক নাম ছিল যতীন খান্না। ডাকনাম কাকা। তার বাবা ও মায়ের নাম লালা হিরানান্দ ও চন্দ্রাণী খান্না। লালা হিরানান্দ পাকিস্তানের পাঞ্জাবের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। রাজেশ খান্নাকে দত্তক নিয়েছিলেন চুনীলাল খান্না এবং লীলাবতী খান্না।পালক বাবা মায়ের সঙ্গে তিনি মুম্বাইয়ে বড় হন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন। রাজেশ খান্না এবং রবি কাপুর যিনি জিতেন্দ্র নামে খ্যাতি লাভ করেন, ছিলেন বন্ধু। দুজনেই স্কুলের বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করতেন। স্কুল ও কলেজে মঞ্চে অভিনয় করে প্রশংসা ও পুরস্কার পান রাজেশ।

১৯৬৬ সালে ‘আখেরি খত’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রের ভুবনে পা রাখেন তিনি। এরপর ‘রাজ’, ‘বাহারোঁ কি সপনে’, ‘ইত্তেফাক’ ও ‘আরাধনা’ ছবির মাধ্যমে তিনি তুমুল জনপ্রিয়তা পান। ‘আরাধনা’ ছবিটি বাংলা ও হিন্দি দুভাষাতেই মুক্তি পায়। এতে তার বিপরীতে ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। আরাধনার সাফল্যের পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি রাজেশকে। একের পর এক মুক্তি পায় তাঁর সুপার হিট ছবি ‘কাটি পতং’,  ‘আপ কি কসম’, ‘রোটি’, ‘প্রেম কাহানি’, ‘আলাগ আলাগ’, ‘মেহবুবা’, ‘রাজা রানী’, ‘সফর’ ইত্যাদি ছবি। ‘আপ কি কসম’ ও ‘রোটি’ ছবিতে রাজেশ-মুমতাজ জুটি দারুণ জনপ্রিয় হয়। ‘বাবুর্চি’, ‘খামোশি’(দীপ জ্বেলে যাই) ও ‘অমর প্রেম’(নিশিপদ্ম)-এর মতো অনেক সুপারহিট বাংলা ছবির হিন্দি রিমেইকে তিনি অভিনয় করেছেন।

রাজেশ খান্না ১৮০টির মতো ছবিতে অভিনয় করেন। ১৬৩টি ছবিতে তিনি নায়ক এবং ১০৬টি ছবিতে একক নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এসব ছবির অধিকাংশই ব্যবসা সফল হয়েছিল। তার নামের সঙ্গে রোমান্টিক নায়কের তকমাযুক্ত হলেও বিভিন্ন ধরনের চরিত্রেই দেখা গেছে তাকে। ‘আজ কা এমএল এ রাম অবতার’-এ রাজনীতির জটিল আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া সরল এক ব্যক্তির চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন রাজেশ। ‘বাবুর্চি’ ছবিতে রাজেশ খান্না তার অসাধারণ অভিব্যক্তিতে ফুটিয়ে তোলেন সমাজের অসংগতি এবং পারিবারিক বন্ধনের চিরায়ত সৌন্দর্যকে।‘মেহবুবা’ ছবিটি পুনর্জন্ম ও প্রেম নিয়ে জনপ্রিয় একটি ছবি। দুর্বল চিত্রনাট্য সত্ত্বেও ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সাফল্য পায় শুধু রাজেশ খান্না ও হেমা মালিনির সু-অভিনয়ের সুবাদে।
আশা পারেখ, মুমতাজ, শর্মিলা ঠাকুর, ওয়াহিদা রেহমান ও হেমা মালিনির সঙ্গে তাঁর জুটি ছিল দারুণ জনপ্রিয়। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে অভিনীত তাঁর ‘আনন্দ’ ও ‘নিমক হারাম’ ছবি দুটি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। রাজেশ খান্না তিন বার সেরা অভিনেতার ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান। বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে হিন্দি চলচ্চিত্রের ক্যাটাগরিতে চার বার সেরা অভিনেতার পুরস্কারে ভূষিত করে। তিনি মনোনয়ন পেয়েছিলেন ২৫ বার। ২০০৫ সালে তিনি  ফিল্ম ফেয়ারের লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পান।  ‘সফর’, ‘শেহজাদা’, ‘অমর প্রেম’, ‘আজনবি’, ‘দাগ’ ‘বাঁহারো কি সপনে’, ‘রাজারানি’ ছবিতে তিনি প্লেব্যাকও করেন তিনি। কিশোর কুমার এবং রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গে তার জুটি ছিল দারুণ সফল। রাজেশের ঠোঁটে কিশোর কুমারের কণ্ঠ এবং রাহুলদেবের সুর দর্শককে মোহাবিষ্ট করতো।

সিনেমাতে রাজেশ খান্নার অভিনয় ছিল কিছুটা লাউড বা উচ্চকিত।ব্যক্তিজীবনেও তিনি নাটকীয়তা ভালোবাসতেন। মূলত তিন নারীর সঙ্গে তার গভীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল, কিন্তু প্রেমে এবং বিবাহিত জীবনে সাফল্য পাননি।

চলচ্চিত্রভুবনে প্রবেশের পরপরই তিনি ফ্যাশন ডিজাইনার অঞ্জু মহেন্দ্রর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। দীর্ঘ সাত বছর প্রেম চলে এই জুটির। সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর এই দুজন পরষ্পরের সঙ্গে কথা বন্ধ করেন এবং ১৭ বছর তারা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেননি। ১৯৭৩ সালে রাজেশ খান্না আকস্মিকভাবে বিয়ে করেন ডিম্পল কাপাডিয়াকে। ধনকুবের বাবার সতেরো-আঠারো বছর বয়সী মেয়ে ডিম্পল তখন ‘ববি’ ছবিতে অভিনয় করছেন। ‘ববি’ সুপার হিট হয়। কিন্তু সংসারের জন্য অভিনয় ছেড়ে দেন ডিম্পল। এক দশকের অসুখী দাম্পত্যজীবন আলাদা থাকায় পরিণতি পায়। ডিম্পল আবার অভিনয়ে ফিরে আসেন ‘ববি’র দশ বছর পর ‘সাগর’ ছবির মাধ্যমে। রাজেশের সে সময় প্রেম চলছে বলিউডের হার্টথ্রব নায়িকা টিনা মুনিমের সঙ্গে। রাজেশ খান্না টিনা মুনিমের বিপরীতে ১১টি ছবিতে অভিনয় করেন। ডিম্পলের সঙ্গে দুই সন্তানের কারণে তখনও বিচ্ছেদ হয়নি তাদের। আর সে কারণেই টিনা মুনিমকে বিয়ে করতে পারেননি রাজেশ।পরবর্তীতে টিনা মুনিম বিয়ে করেন। ডিম্পলের সঙ্গেও সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হযে আসে তার। রাজেশ যখন রাজনীতিতে আসেন তখন তার নির্বাচনী প্রচারণায় ডিম্পল পাশে ছিলেন।বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও একসঙ্গে দেখা যেত তাদের। এই দম্পতির দুই মেয়ে টুইঙ্কেল ও রিঙ্কেল খান্না। দুজনেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে টুইংকেল খান্না ‘বাদশাহ’সহ বেশ কয়েকটি সুপারহিট ছবিতে অভিনয় করেছেন। অভিনেতা  আক্শায় কুমারকে বিয়ে করে অভিনয় ছেড়ে দেন টুইঙ্কেল।
রাজেশ খান্না নব্বইয়ের দশকে কংগ্রেসের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেন। ভারতের অন্যান্য জনপ্রিয় তারকার মতো তিনিও রাজনীতিতে সাফল্যের মুখ দেখেন। ছবি প্রযোজনা এবং অন্যান্য ব্যবসাতেও সফল হন তিনি।

ক্যান্সারে আক্রান্ত রাজেশ খান্না ২০১২ সালের ১৮ জুলাই মুম্বাইতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মরণোত্তর পেয়েছেন পদ্মভূষণ এবং দাদা সাহেক ফালকে সম্মাননা।

তার শবযাত্রায় প্রচণ্ড ভিড় হয়। মুম্বাইয়ের জনতাতো বটেই, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে আসেন তার অসংখ্য ভক্ত। বস্তুত তার শবযাত্রার দিন সারা মুম্বাই অচল হয়ে পড়ে। এই বিপুল জনসমাগমই প্রমাণ করে সত্যিই তিনি ছিলেন সুপারস্টার। রাজেশ খান্না মৃত্যুর আগে শেষ যে বাক্যটি উচ্চারণ করেন সেটি হলো ‘প্যাক আপ’। তার জীবনটাই যেন ছিল এক চলচ্চিত্র। আর এই চলচ্চিত্রে মহাতারকা ছিলেন রাজেশ খান্না।