সবগুলো অভ্যুত্থানেই একটা বিষয়ের অপরিহাযর্তা ছিল চোখে পড়ার মতো - গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট, আরব বসন্ত থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে বাংলাদেশের গণজাগরণ - সবক্ষেত্রেই গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ছিল অনেক বড় ভূমিকা।
‘দ্য হাঙ্গার গেইমস: মকিংজে পার্ট ওয়ান’- এ ডিস্টোপিয়ান সাই-ফাই থ্রিলারের মোড়কে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর আদি ও অকৃত্রিম চেতনার সঙ্গে 'বিপ্লব' পরিচালনার বদলে যাওয়া কৌশল আর একে সফল করার হাতিয়ার হিসেবে প্রচার মাধ্যমের অবস্থানকেই তুলে ধরে।
সিনেমাজুড়েই বিদ্রোহী ডিস্ট্রিক্ট থার্টিনের প্রেসিডেন্ট অ্যালমা কয়েন আর ক্যাপিটলের প্রেসিডেন্ট স্নো গণমাধ্যমের ওপর দখল ধরে রাখার লড়াইয়ে ব্যস্ত রইলেন। আর এ যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট স্নোয়ের তুরুপের তাস হাঙ্গার গেইমসের অন্যতম ‘ভিক্টর’ পিটা ম্যালার্ক। আর বিদ্রোহীদের মুখপাত্র ক্যাটনিস এভারডিন।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় বিদ্রোহ দমনের নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা চালান ক্ষমতাসীনেরা। গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে ঘরে ঘরে বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। 'মকিংজে - পার্ট ওয়ান' - এও এমনটাই করেন প্রেসিডেন্ট স্নো। কিন্তু বদলে যাওয়া সময়ে বিদ্রোহীরাও পিছিয়ে থাকবে কেন? কোমর বেঁধে প্রস্তুত তারাও। ডিস্টি্রক্ট টুয়েলভের ট্রিবিউটদের তত্ত্বাবধায়ক এফি ট্রিঙ্কেটও হাজির ক্যাটনিসের জন্য নতুন মকিংজে উর্দি নিয়ে তাকে "ইতিহাসের সবচেয়ে সুসজ্জিত বিপ্লবী" বানানোর জন্য। উর্দি পরা ক্যাটনিসকে দেখে ট্রিঙ্কেটের মন্তব্য, "তারা হয় তোমাকে খুন ধরতে চাইবে, তোমাকে চুমু খেতে চাইবে অথবা তুমি হতে চাইবে।" আর হয়ও তাই, বিপ্লবের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ মানুষেরা অকাতরে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতে থাকে।
কিন্তু বিপ্লবীদের এই প্রচারমুখিতায় দর্শকের মনে দ্বন্দ্ব জন্ম নেবেই। এই একই দ্বন্দ্ব টের পাওয়া যায় ক্যাটনিসের মধ্যেও, সতের বছর বয়সী যে মেয়েটির হাত ধরেই প্যান্যামে বিদ্রোহের স্ফূলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। অভিনেত্রী জেনিফার লরেন্সের শক্তিশালী অভিনয়ে ক্যাটনিস চরিত্রটির বিবর্তনের ধারাবাহিকতা দিয়েই আসলে সিরিজ হিসেবে ‘দ্য হাঙ্গার গেইমস’ - এর সাফল্য বিচার করা সম্ভব।
সুজ্যান কলিন্সের বেস্ট সেলিং উপন্যাসত্রয়ী থেকেই জন্ম ‘হাঙ্গার গেইমস’ মুভি সিরিজটির। প্রথম সিনেমা ‘দ্যা হাঙ্গার গেইমস’ মুক্তি পায় ২০১২ সালে। গ্যারি রসের পরিচালনায় সিনেমাটি বলে পোস্ট-অ্যাপোকালিপ্টিক এক দুনিয়ার কথা, যেখানে উত্তর আমেরিকার ধ্বংসাবশেষ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায় স্বৈরাচারী শাসনাধীন প্যান্যাম।
৭৪ তম হাঙ্গার গেইমসে অংশ নেওয়া থেকে নিজের ছোট বোনকে বাঁচাতে গিয়ে ডিস্ট্রিক্ট টুয়েলভ থেকে স্বেচ্ছায় এই মরণখেলায় জড়িয়ে যায় ক্যাটনিস। ছোট বেলায় খনি দুর্ঘটনায় বাবাকে হারানো ক্যাটনিস বেড়ে উঠেছে দারিদ্র্য, শোষণ আর বঞ্চনার বিরূদ্ধে লড়াই করেই। লড়াকু ক্যাটনিস, যে সবসময়ই নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে, প্রথমবারের মতো নিয়মের বেড়াজালে আটকে যায়। যদিও শেষ পর্যন্ত
হাঙ্গার গেইমের ছকই পাল্টে দেয় সে।
গেইম চলাকালীন আরেক প্রতিযোগী রু-এর মৃত্যু নিয়ে প্রথমবারের মতো বিদ্রোহ হয় ডিস্ট্রিক্ট ইলেভেনে। ক্যাটনিসই নিজের অজান্তে এই বিদ্রোহের সলতেতে আগুন দেয়।
২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া দ্বিতীয় পর্ব ‘ক্যাচিং ফায়ার’-এ দেখা যায় বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। ক্যাটনিসও প্রেসিডেন্ট স্নোয়ের ফাঁদে পাড়া না দিয়ে হাঙ্গার গেইমসকেই ধ্বংস করে দিতে। সিনেমার শেষে এসে জানা যায়, অনেক আগে থেকেই হাঙ্গার গেইমসের সাবেক বিজয়ীরা ছক কষছিলেন এক বিপ্লবের। ক্যাটনিসকে নিয়ে এবার শুরু হবে তাদের সত্যিকারের লড়াই।
সিরিজ হিসেবে ‘দ্য হাঙ্গার গেইমস’ পুরোপুরি সফল তিনটি কারণে। প্রথমত এই সিরিজের প্রতিটি পর্বেই পরের পর্বের জন্য দর্শকদের প্রস্তুত কর হয়। ‘মকিংজে পার্ট ওয়ান’ বাধ্য করে পরের পর্বে কী ঘটবে সেটা জানার জন্য দর্শকদের অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে।
দ্বিতীয়ত, এই সিরিজের মাধ্যমেই কোনো নারীচরিত্রকে এতো শক্তিশালীভাবে তুলে ধরা হলো। ‘হাঙ্গার গেইমস’ এককভাবেই জেনিফার লরেন্সের সিরিজ। অস্কারজয়ী এই অভিনেত্রীর সু-অভিনয় এই সিরিজটিকে গতি দিয়েছে।
তৃতীয়ত, সিরিজটির অনুপম নির্মাণশৈলী। পোস্ট অ্যাপোকালিপ্টিক ডিস্টোপিয়া নিয়ে সিনেমা তৈরি হয়েছে বিস্তর। কিন্তু সেটা দেখাতে গিয়ে নির্মাতারা অন্যদের মতো সিজিআই বা কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারির সাহায্য নেননি। বরং পরিত্যক্ত খামার, কারখানা, ধ্বংসস্তূপ ব্যবহারে সিনেমাটিকে বাস্তবধর্মী করে তুলেছেন। সেই সঙ্গে কলাকুশলীদের অনবদ্য অভিনয় এবং চমৎকার আবহ সংগীত কিছু কিছু দৃশ্যকে সত্যিউ হৃদয়স্পর্শী করে তুলেছে।
যেমন, পরিচালক ফ্রান্সিস লরেন্স ডিস্ট্রিক্ট ১২-এ ক্যাপিটলের গণহত্যার ভয়াবহতাকে তুলে ধরতে দেখালেন এক বিশাল গণকবর। দৃশ্যটি বাংলাদেশি দর্শকদের ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের নিমর্ম হত্যাযজ্ঞের প্রমাণবাহী গণকবরগুলোর কথা মনে করিয়ে দেবে। কিংবা হাসপাতালের কাতরাতে থাকা যুদ্ধাহতদের দৃশ্যটির কথাই ধরা যাক। যুদ্ধবিদ্ধস্ত ফিলিস্তিন কিংবা সিরিয়া চোখের সামনে ভেসে উঠবেই।
‘মকিংজে : পার্ট ওয়ান’-এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বাহুল্য বর্জন। গল্পের প্রয়োজনেই এ পর্বে বেশিরভাগ দৃশ্যই ঘরের ভেতরে। আগের দুই পর্বের তুলনায় অ্যাকশন দৃশ্য প্রায় নেই বললেই চলে। বিষয়টা অ্যাকশনপ্রেমীদের কিছুটা নিরাশ করলেও সিনেমার প্রয়োজনে তা ছিল একদম যথার্থ।
সেই সঙ্গে সিনেমায় জেনিফার লরেন্সের স্বকণ্ঠে গাওয়া ‘দ্য হ্যাংগিং ট্রি’ গানটি ছিল বাড়তি পাওনা।
সবমিলিয়ে ‘দ্য হাঙ্গার গেইমস: মকিংজে পার্ট ওয়ান’কে চলতি বছরের সেরা সিনেমাগুলোর একটি বলতে দ্বিধা নেই। এবার অপেক্ষা কেবল এই সিরিজের শেষ পর্বটির।