'আমাদেরকে বাঁচান'

নরেন্দ্র মোদি - ভারতের বর্তমান প্রধান মন্ত্রী। অমিতাভ বচ্চন- ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী অভিনেতা। শাহরুখ, সালমান এবং আমির খান- হিন্দি সিনে জগতের জনপ্রিয়তম তিন তারকা। শচিন টেন্ডুলকার- ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। অনিল আম্বানি- দেশটির শীর্ষ শিল্পপতিদের একজন। এদের সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষমতাবান পুরুষ। ভারতে যৌন সহিংসতার হাত থেকে নারীদের সুরক্ষা চেয়ে তাই এদের কাছেই একটি খোলা চিঠি লিখেছেন এমটিভির এক সময়ের উপস্থাপিকা এবং অভিনেত্রী শেনাজ ট্রেজারিওয়ালা।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Dec 2014, 11:21 AM
Updated : 12 Dec 2014, 11:21 AM

চলতি সপ্তাহেই নয়া দিল্লিতে এক ট্যাক্সি চালকের হাতে ধর্ষিত হয়েছেন ২৫ বছর বয়সী এক তরুণী। ‘ইন্ডিসিনডটকম’ নামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খোলা চিঠিতে শেনাজ দাবি করেছেন ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি। চিঠিতে তিনি আরও জানিয়েছেন ১৩ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার কথা। চিঠিটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই অনলাইনে ভাইরাল হয়ে যায়।

“প্রিয় নরেন্দ্র মোদি, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, সালমান খান, আমির খান, শচিন টেন্ডুলকার এবং অনিল আম্বানি, আমি নির্দিষ্টভাবে আপনাদেরকেই চিঠিটি লিখছি, কারণ আপনারাই হলেন আমাদের দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান এবং প্রভাবশালী পুরুষ। আমি আপনাদেরকে এই চিঠি লিখছি একজন নারী হিসেবে, যে মুম্বাইয়ের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠেছে। আমি আপনাদের এই চিঠি লিখছি সাহায্য চেয়ে।

আমার বাবা-মা আমার এই কথাগুলো বলাটা পছন্দ করবেন না। তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, যদি তারা এটি পড়ে থাকেন। কিন্তু আমি এর জন্য লজ্জিত নই। এটা তাদের লজ্জা। বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে আমার প্রথম অভিজ্ঞতাটি ছিল ১৩ বছর বয়সে, যখন মায়ের সঙ্গে সব্জি বাজারে হাঁটার সময় কেউ একজন পেছন থেকে আমার গায়ে হাত দিয়েছিল।

আমার যখন ১৫ বছর বয়স, আমি বাস এবং ট্রেনে করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে যাতায়াত শুরু করলাম। সব খানেই পুরুষরা আমার গায়ে হাত দিত এবং অশালীনভাবে আমার শরীর ছোঁয়ার চেষ্টা করতো। এর মধ্য দিয়ে আমি বেড়ে উঠছিলাম। আমি একা না, ভারতের অধিকাংশ নারীকেই এসবের মুখোমুখি হতে হয়েছে, যাদের নিজেদের গাড়ি কিংবা ড্রাইভার রাখার মতো বিলাসিতা নেই।

একটা টিনএইজ মেয়ে হিসেবে আমি তখন (এবং এখনও) মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতাম যারা আমার গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের সবাইকে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে মারার।

ধীরে ধীরে আমি নিজেই নিজেকে রক্ষা করার উপায় খুঁজে বের করলাম। প্রথমদিকে আমি আমার শরীরের সামনে ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখতাম। আমার দুই হাত শরীরের দুপাশে রক্ষণাত্মকভাবে রাখতাম। ২০ সেকেন্ড পরপরই ঘুরে দেখার চেষ্টা করতাম, আমার আশপাশে কারা আছে।

পরে যারা আমার গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করতো, ঘুরে তাদেরকে চড় মেরে দিতাম। মাঝে মাঝে উল্টো আমাকেও চড় খেতে হয়েছে তাদের কাছ থেকে। ক্ষেত্রবিশেষে আশপাশের লোকজন আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু অধিকাংশ সময় তারা থাকতো নিষ্ক্রিয়।

আমার মা এসব ঘটনা নিয়ে ভয় পেতেন। তার ভয় হতো, এভাবে প্রতিবাদের কারণে কবে কেউ আমার ওপর অ্যাসিড ছুঁড়ে মারবে অথবা আরও খারাপভাবে আঘাত করবে। সে এখনও ভয় পায় এবং আজকে আমাকে বললো, কাল থেকে ট্যাক্সিতে যাতায়াত না করতে। যেন, ট্যাক্সি চড়া বন্ধ হয়ে গেলেই সব সমস্যার সমাধান!

আমার কলেজের এক বান্ধবী ট্রেনে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে বেলা সাড়ে এগারটায় ট্রেনে উঠেছিল বাসায় যাওয়ার জন্য। সেখানেই তাকে ধর্ষণ করে, তারই চুল বাধার ফিতা দিয়ে নিজেকে পরিস্কার করে লাফিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যায় ধর্ষক। আমার বান্ধবীর বয়স ছিল ১৬। সে একা একা রক্তাক্ত অবস্থায় বাসায় ফিরে যায়।"

শেনাজ এই পযর্ায়ে মোদিকে উদ্দেশ্য করে লেখেন, “নামো, (নরেন্দ্র মোদির সংক্ষেপ) যুক্তরাষ্ট্র, জাপান কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় আপনার বড় বড় ভাষণের তাহলে কী অর্থ থাকে, যখন আমাদের দেশের রাজধানীতে প্রকাশ্য দিবালোকে কোনো নারী স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন না? এটা কি লজ্জার বিষয় না? ধিক, স্যার আপনাকে।”

এরপর অন্যদের উদ্দেশ্যে শেনাজ লেখেন, “আমি নিজে যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত। তবে শচিন টেন্ডুলকার, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, সালমান খান, আমির খান, অনিল আম্বানি, আমি আপনাদের মতো বড় তারকা নই। পুরুষ হিসেবে আপনাদের উচিৎ এই বিষয়ে মুখ খোলা। আমাদেরকে বাঁচান। দয়া করে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দাবি করুন।”

তিনি আরও  বলেন, “ভাবুন একবার, অমিতাভ বচ্চন স্যার, আমির খান, সালমান খান, শচিন টেন্ডুলকার, অনিল আম্বানি- আপনারা সবাই যদি এই বিষয়টিকে আপনাদের একমাত্র দাবি করে দিল্লিতে রাষ্ট্রপতির কাছে যান, অথবা অনশনে বসেন, তাহলে কতবড় একটা পরিবর্তন এটা আনবে?!”

“আপনাদের কাছে আমার আর্জি, এটি নিয়ে আপনারা প্রতিবাদ করুন, অনশনে বসুন অথবা এমন কিছু একটা করুন, যাতে করে মানুষ এটা নিয়ে সচেতন হয়। সরকারের ঘুম ভাঙ্গে এবং প্রশাসন আইনে এমন পরিবর্তন আনে যাতে করে পুরুষেরা আমাদেরকে ছুঁতেও ভয় পায়।”

ভারতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই দেশটিতে নারীদের নিরাপত্তা ইস্যুতে বার বার প্রশ্ন তুলছেন। ২০১৩ সালেই এক মেডিকেল ছাত্রীর চলন্ত বাসে গণধর্ষণ এবং এক নারী সাংবাদিকের মুম্বাইয়ে গণ-ধর্ষণের শিকার হওয়া নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে ব্যাপক হারে।

নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে ‘এমটিভিজ মোস্ট ওয়ান্টেড’ অনুষ্ঠান দিয়ে পরিচিতি পান শেনাজ। পরবর্তীতে হিন্দি সিনেমায় তার অভিষেক হয় ‘ইশক ভিশক’ সিনেমার মাধ্যমে। এরপর ‘হাম তুম’, ‘দিল্লি বেলি'র মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। টিভি অভিনেতা বারুন সোব্তির বিপরীতে তার নতুন সিনেমা ‘ম্যায় আউর মিস্টার রাইট’ মুক্তি পাবে শিগগিরই।