দিলীপ কুমার: বিষাদের মহানায়ক

হিন্দি সিনেমার বিষাদের মহানায়ক তিনি। তবে সেখানেই তার অর্জনের শেষ নয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা অভিনেতাদের সারিতে একবারে সামনের দিকেই আছেন। তার চেহারা, ব্যক্তিত্ব, কণ্ঠস্বর- সব কিছুতেই ঠিকরে পড়ে এক বিশেষ আভিজাত্য। এই মহান অভিনেতার নাম দিলীপ কুমার। ১১ ডিসেম্বর ৯২ বছর পূর্ণ করে পা দিলেন ৯৩তে।

শান্তা মারিয়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Dec 2014, 01:44 PM
Updated : 11 Dec 2014, 01:44 PM

দিলীপ কুমারের জন্ম ১৯২২ সালে অবিভক্ত ভারতের পেশোয়ারে। বর্তমানে স্থানটি পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনওয়ালার অন্তর্ভুক্ত। তার প্রকৃত নাম ইউসুফ খান। তার মাতৃভাষা হিন্দকো। পাঠানদের অন্যতম গোত্র আওয়ান পরিবারের সন্তান তিনি। তারা ছিলেন ১২ ভাইবোন। বাবার নাম লালা গুলাম সরোয়ার। বাবা ছিলেন বিশাল ধনী। ফলের জমজমাট ব্যবসা। পেশোয়ার এবং মহারাষ্ট্রের দেওলালিতে ছিল নিজস্ব বাগান। দিলীপ কুমার লেখাপড়া করেন দেওলালির বিখ্যাত বার্নস স্কুলে। ত্রিশ দশকের শেষ দিকে ইউসুফ খানের পরিবার বোম্বেতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। চল্লিশের দশকের শুরুতে দিলীপ কুমার পুনেতে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন। তিনি একটি ক্যান্টিন চালাতেন এবং স্থানীয় বাজারে শুকনো ফল সরবরাহ করতেন।

১৯৪৩ সালে আওধ মিলিটারি ক্যান্টিনে তার পরিচয় হয় সে সময়ের প্রখ্যাত নায়িকা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবিকা রানির সঙ্গে। এই পরিচয় তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। দেবিকা রানির ভীষণ ভালো লেগে যায় এই সুদর্শন তরুণকে। তিনি ছিলেন বোম্বে টকিজের এক মালিক। বোম্বে টকিজের পরবর্তী সিনেমা ‘জোয়ার ভাটা’ মুক্তি পেল ১৯৪৪ সালে। আর এই ছবির মাধ্যমেই রুপালি পর্দায় আবির্ভাব ঘটে দিলীপ কুমারের।

কেন ইউসুফ খান পর্দায় হয়ে উঠলেন দিলীপ কুমার তার পিছনে রয়েছে এক গল্প। রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান তিনি। বাবাকে যমের মতো ভয় পেতেন। ছেলে সিনেমায় নেমেছে জানতে পারলে বাবা আস্ত রাখবেন না। ইউসুফ চাচ্ছিলেন আগে চলচ্চিত্রে শক্ত অবস্থান গড়ে তারপর সাহস করে বাবাকে কথাটি জানাবেন। তাই এই নাম বদল। তার এই নাম দেন হিন্দিভাষী লেখক ভগবতীচরণ ভার্মা। দেবিকা রানির বিপরীতে ‘জোয়ার ভাটা’ কিন্তু তেমন নাম করেনি। বক্স-অফিসে প্রথম সাফল্য পায় তার অভিনীত ‘জুগনু’। ১৯৪৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন বিখ্যাত নায়িকা ও গায়িকা নূরজাহান। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পরের বছর ১৯৪৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘শহীদ’ সিনেমাটিও ব্যাপক সাফল্য পায়। ১৯৪৯ সালে মুক্তি পেল ‘আন্দাজ’। রাজকাপুর, নার্গিস, দিলীপ কুমার অভিনীত ত্রিভুজ প্রেমের এই ছবিটি সুপারহিট হয়। আর এ ছবি থেকেই ট্র্যাজেডি কিংয়ের তকমা তার গায়ে আঁটে।
ট্র্যাজেডি কিংয়ের পরিচয় আরও দৃঢ় হয় পঞ্চাশের দশকে। একের পর এক মুক্তি পায় ‘জোগান’(১৯৫০), ‘দাগ’(১৯৫২), ‘দেবদাস’(১৯৫৫), ‘ইয়াহুদি’(১৯৫৮), ‘মধুমতি’(১৯৫৮)। সুপার ডুপার হিট এসব ছবি। বিশেষ করে দেবদাসের ভূমিকায় তিনি ছিলেন অনবদ্য। তার বিপরীতে পার্বতী ছিলেন সুচিত্রা সেন এবং চন্দ্রমুখী হন বৈজয়ন্তি মালা। হিন্দিতে বহুবার দেবদাসের রিমেক হয়েছে। কিন্তু দিলীপ কুমারকে অতিক্রম করতে পারেননি কোনো অভিনেতাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘নৌকাডুবি’র হিন্দি চিত্ররূপ ‘মিলন’-এ তিনি ছিলেন অসাধারণ। সে সময় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মেলা’, ‘অমর’, ‘উড়ান খাটোলা’, ‘দিদার’, ‘ফুটপাথ’(১৯৫৩), ‘নয়া ডোর’ (১৯৫৭), ‘মুসাফির’ (১৯৫৭), ‘পয়গাম’(১৯৫৯)ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয় তাকে। ‘দাগ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ফিল্ম ফেয়ারের প্রথম আসরে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান তিনি।
চল্লিশ,পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি অভিনয় করেছেন দেবিকা রানি, কামিনী কৌশল, মধুবালা, নার্গিস, নিম্মি, মীনা কুমারী এবং বৈজয়ন্তিমালার মতো পর্দা কাঁপানো নায়িকাদের বিপরীতে। সবচেয়ে বেশিবার জুটি বেঁধেছেন বৈজয়ন্তি মালার বিপরীতে। তবে মধুবালার সঙ্গে তার প্রেম ছিল পর্দার বাইরেও। মধুবালার সঙ্গে প্রেম অবশ্য পরিণতি পায়নি।
১৯৬০ সালে মুক্তি পায় ইতিহাস সৃষ্টিকারী ছবি ‘মুঘল-ই-আজম’। কে আসিফের এই ঐতিহাসিক ছবিতে শাহজাদা সেলিম ছিলেন দিলীপ কুমার, মধুবালা ছিলেন আনারকলি এবং সম্রাট আকবরের ভূমিকায় ছিলেন পৃত্থিরাজ কাপুর। বলিউডের একশ’ বছরের ইতিহাসে অন্যতম সেরা সিনেমা বলা হয় একে। শাহজাদা সেলিমের চরিত্রে দিলীপ কুমার শুধু অনবদ্যই ছিলেন না, এ ভূমিকায় তার বিকল্প সে সময় কেউ ছিল না। মুঘল শাহজাদার আভিজাত্য, আবেগ, প্রেম, বেদনা সবকিছুই সার্থকভাবে তুলে ধরেছিলেন দিলীপ কুমার। পর্দায় সেলিম-আনারকলির প্রেম আরও সার্থক হয়েছিল দিলীপ-মধুবালা জুটির ব্যক্তিগত রোমান্সের কারণে।
বিষাদময় চরিত্রে অদ্বিতীয় এই নায়ক কমেডিতে সফলতা পেয়েছিলেন। ‘আজাদ’, ‘আন’, ‘কোহিনূর’ ছবিতে তার উচ্ছ্বল অভিনয় দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে ১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাম আউর শ্যাম’ তার অভিনীত কমেডি সিনেমার মধ্যে সেরা। ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্য পায় দারুণ। এ ছবির আদলে পরবর্তীতে নির্মিত ‘সীতা আউর গীতা’, ‘কিষণ-কানহাইয়া’, ‘চালবাজ’-ও সুপারহিট হয়েছে।
১৯৬১ সালে দিলীপ কুমার ‘গঙ্গা যমুনা’ ছবিটি প্রযোজনা করেন। ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দিল দিয়া দর্দ লিয়া’ ছবিটি আবদুল রশিদ কারদারের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করেন তিনি। এ ছবিতে ওয়াহিদা রেহমানের বিপরীতে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি।
সত্তরের দশকে মারদাঙ্গা ছবির ভিড়ে ক্যারিয়ারের মন্দগতি লক্ষ্য করে তিনি সিনেমা থেকে কয়েক বছরের বিরতি নেন।
১৯৮১ সালে ‘ক্রান্তি’ সিনেমার মাধ্যমে আবার পর্দায় ফিরে আসেন চরিত্রাভিনেতা হিসেবে। উপহার দেন ‘শক্তি’(১৯৮২) ‘কার্মা’ (১৯৮৬)র মতো অসাধারণ কিছু ছবি। ‘শক্তি’ ছবিতে আদর্শবান পুলিশ কর্মকর্তার ভূমিকায় দিলীপ কুমার এবং তার বিপথগামী পুত্রের চরিত্রে অমিতাভ বচ্চনের দুর্দান্ত অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করে। এই ছবিতে দুজনের সংলাপ-প্রতিসংলাপ এবং অনবদ্য অভিনয় আজও আশির দশকের সিনেমাপ্রেমীদের স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে।
১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মশাল’ ছবিতে দিলীপ কুমারের অভিনয় অবিস্মরণীয়। এ ছবির একটি দৃশ্য সবচেয়ে বিখ্যাত। বর্ষণমুখর রাতে সড়কে মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীকে(অভিনয়ে ছিলেন ওয়াহিদা রেহমান) নিয়ে অসহায় দিলীপ কুমার। স্ত্রীকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য একের পর এক গাড়ি থামাতে চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু একটি গাড়িও থামছে না। ‘এ ভাই গাড়ি রোখো’- এ সংলাপটি হিন্দি ছবির ক্ল্যাসিকে পরিণত হয় তার অসামান্য অভিব্যক্তির কারণে।
‘বিধাতা’, ‘কানুন আপনা আপনা’, ‘দুনিয়া’ ইত্যাদি ছবিতে বিশেষ ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। ১৯৯১ সালে ‘সওদাগর’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেন আরেক বিখ্যাত অভিনেতা রাজকুমারের সঙ্গে। এ ছবির মাধ্যমেই বলিউডে পা রাখেন মনিষা কৈরালা। দিলীপ কুমার সর্বশেষ অভিনয় করেছেন ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কিলা’ ছবিতে।
১৯৬৬ সালে তার চেয়ে ২২ বছরের ছোট অভিনেত্রী সায়রা বানুকে বিয়ে করেন দিলীপ কুমার। এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ভীষণ খেয়ালি। কিছুটা নিভৃতচারীও। দিলীপ কুমার হিন্দকো, ফার্সি, হিন্দি, উর্দু, পশতু এবং ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারেন।
ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতা কমিয়ে দুদেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তিনি। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সেবায়ও কাজ করেছেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে। বাংলাদেশে এসেছিলেন নব্বইয়ের দশকে। সে সময় এদেশের ভক্তদের ভালোবাসায় প্লাবিত হন তিনি। তার পরিশীলিত ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন এদেশের মানুষও।
ছয় দশকের অভিনয় জীবনে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। সবচেয়ে বেশি পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে গিনেজ বুক অফ ওয়াল্ডর্ রেকর্ডসে তার নাম রয়েছে। আটবার ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন সেরা অভিনেতা হিসেবে। নমিনেশন পেয়েছেন ১৯ বার। ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে। ১৯৮০ সালে মুম্বাই শহরের সম্মান জনক শেরিফ পদটি অলংকৃত করেন তিনি। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য পেয়েছেন ভারত সরকারের সম্মাননা পদ্মভূষণ ও দাদা সাহেব ফালকে। পাকিস্তান সরকার তাকে ভূষিত করেছে ‘নিশান-এ-ইমতিয়াজ’ সম্মাননায়।
তবে দিলীপ কুমারের সবচেয়ে বড় অর্জন হিন্দি ছবির দর্শকের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। বিষাদের মহানায়ক এবং হিন্দি সিনেমার অন্যতম সেরা অভিনেতা হিসেবে দর্শকহৃদয়ে তার আসন চিরস্থায়ী।