'মডেল, নায়িকা বললেই বাঁকা চোখে তাকায়'

‘চোরাবালি’ সিনেমার সুজানা চরিত্রে অভিনয় করা জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া এখন পুরোদস্তুর সিনেমার অভিনেত্রী। এক সময়ের ব্যস্ত এই মডেল মনে করেন চলচ্চিত্র ও মডেলিং - বিনোদনশিল্পের এই দুই খাতে কাজ করা নারীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসা প্রয়োজন।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2014, 05:53 AM
Updated : 2 Nov 2014, 06:27 AM

গ্লিটজ : ক্যারিয়ারের দুই আর তিন নম্বর সিনেমা দুটি মুক্তির পথে। কী মনে হচ্ছে? ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’ নাকি ‘স্টোরি অব সামারা’ কোনটি বেশি সাড়া ফেলবে?

পিয়া : দুটো সিনেমা আলাদা। আন্ডারগ্রাউন্ড জগতের গল্প নিয়ে অ্যাকশন ধাঁচের সিনেমা ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’। সিনেমাতে আমি অভিনয় করছি শিনা চরিত্রে। গতানুগতিক সিনেমার মতো ভিতুর ডিম নায়িকা হিসেবে নয়, পরিচালক আশিকুর রহমান আমাকে রাফ অ্যান্ড টাফ লুকেই হাজির করছেন। সিনেমাতে আমার বিপরীতে রয়েছেন অপূর্ব। সিনেমাটি নায়ককেন্দ্রিক হলেও নায়িকাকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্রে এ ধরনের সিনেমা খুব কমই হয়েছে। সিনেমাটির ব্যবসায়িক সাফল্যের ব্যাপারে আমি খুবই আশাবাদী।

অন্যদিকে ‘স্টোরি অব সামারা’তে প্রচুর স্পেশাল ইফেক্টসের কাজ রয়েছে। অ্যানিমেটেড মুভি এটি। এই সিনেমাটি দর্শক আসলে কিভাবে নেবেন, তাই ভাবছি। এ ধরনের সিনেমা দেখে সাধারণ দর্শক অভ্যস্ত নন। 

গ্লিটজ: নাটকে অপূর্বর সঙ্গে কাজ করেছেন। সিনেমায় সহ-অভিনেতা হিসেবে তাকে কেমন লাগলো? 

পিয়া :
‘গ্যাংস্টার রিটার্নস'- এ অপূর্ব অভিনয় করছেন ‘শাওন’ চরিত্রে। তার চরিত্রটি নানা ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে যায়। আমি তার বান্ধবীর ভূমিকায় রয়েছি।

মজার ব্যাপার হল, সিনেমার শুরুতেই আমাদের দুজনের একটি গানের দৃশ্যায়ন হয়েছে। ‘তুমি আজ হাত ধরো’ শিরোনামের গানটি সত্যিই দারুণ লেগেছে আমার কাছে। গানটিতে পারফর্ম করতে গিয়ে দুজনেই বেশ ইতস্ততবোধ করছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, আগে অন্য কোনো দৃশ্য টেক করলে ভালো হত। পরে গানটি করলে গানটিতে আরও ভালো অভিনয় করতে পারতাম।

ছেলেদের যে গুণটি আমাকে ভীষণ টানে সেটি হল কেউ যদি খুব সুন্দর করে কথা বলে। অপূর্বর মধ্যে সে গুণটি রয়েছে। এছাড়া সহ-অভিনেতা হিসেবে সেটে এত সাহায্য করেছেন আমাকে। এ সিনেমাতে কাজ করতে গিয়ে আমি তার কাছে সত্যি অনেক কৃতজ্ঞ।

গ্লিটজ: আপনি নিজে সিনেমাতে নতুন এসেছেন। সেক্ষেত্রে একেবারেই নবাগত পরিচালক আশিকুরের সঙ্গে কাজ করাটা একটু ঝুঁকির হয়ে গেল না?

পিয়া: মোটেই না। আশিক সত্যি মেধাবী একজন পরিচালক। তার পরিচালিক ‘কিস্তিমাত’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে। সেখানে সে দেখিয়েছে সিনেমাতে আসলে কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা দরকার। তার মতো মেধাবী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করাটা ভাগ্যের ব্যাপার।

আমি যে কাজগুলো করি, তা আমার প্যাশন থেকেই করি। একজন প্রফেশনাল আর্টিস্ট হিসেবে হয়তো আমার আরও বেশি ভাবা উচিত। কিন্তু আমার যখন যেটা করতে খুব ভালো লাগে তখন তা করি। কি কতদূর যাবে সেটা পরের বিষয়।

গ্লিটজ: আলভি আহমেদের ‘ইউটার্ন’ ছেড়ে দিলেন কেন?

পিয়া : এই যে বললাম যখন যা ভালো লাগে তাই করি।  প্রযোজকের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না বলে ছেড়ে দিলাম সিনেমাটি। প্রযোজক [আরশাদ আদনান] নিজেই নায়ক হতে চাইছেন আমার। তার তো অভিনয়ের তেমন কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। 

গ্লিটজ: ‘স্টোরি অব সামারা’ সিনেমাটি তো বারবার মুক্তির দিনক্ষণ ঠিক করে পিছিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটি কী?

পিয়া: একটি অ্যানিমেটেড মুভির পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ তো আর মুখের কথা নয় যে রাতারাতি শেষ হয়ে যাবে।  আমি জানি না কে বলছে সিনেমাটির মুক্তির কথা। তবে পরিচালক রিকিয়া মাসুদো আমাকে জানিয়েছেন, এ বছরের ডিসেম্বরে কিংবা নতুন বছরের শুরুতে মুক্তি পাবে সিনেমাটি।

গ্লিটজ: চলচ্চিত্র নিয়ে আসলে আপনার পরিকল্পনা কি? বছরে কটা সিনেমা করতে চান?

পিয়া :
আমি যখন  এফডিসিতে ‘চোরাবালি’র শুটিং করি, তখনই অফার আসতে শুরু কর। তখন চাইলে কিন্তু পারতাম। কিন্তু তখনই আমি চলচ্চিত্র নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবিনি। এছাড়া দেখুন না, আমাদের চলচ্চিত্রের আমূল পরিবর্তন কিন্তু গেল দু বছরেই হয়েছে। এখন আমি সিনেমা নিয়ে ভাবছি।

বছরে অনেকগুলো সিনেমা করার চেয়ে দুটি ভালো সিনেমা করব, তাই ভালো। অনেকগুলো সিনেমা করে ফেললাম আর একটিও মুক্তি পেল না ব্যাপারটি ভীষণ বাজে দেখায়।

আর হ্যাঁ, আমি বাণিজ্যিক ধারার সিনেমাই করতে চাই। অবশ্যই দেখব, আমি চরিত্রটি কতটুকু এগিয়ে নিতে পারব।

গ্লিটজ: এখন যেসব সিনেমা চলছে তা নিয়ে  নিজেই বা কি ভাবছেন?

পিয়া: অধিকাংশ বাংলা সিনেমাই নায়ককেন্দ্রিক। নায়িকা মানেই নিষ্পাপ মুখের ভালো একটি মেয়ে, আমি তা মানি না।

চলচ্চিত্র আমাদের সমাজকে নানাভাবে উপস্থাপন করে। সিনেমাতে নারীদের উপস্থাপনের ধরনটা বদলাতে হবে। নারীদের ভিকটিম দেখিয়ে, হিরোকে সব ক্রেডিট দিয়ে বাংলা সিনেমা নির্মাণের হিড়িক বন্ধ করা উচিত। নারীর প্রতিবাদী সত্তাকে উপস্থাপন করা যেতে পারে। নারীদেরও সমান প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

গ্লিটজ : আপনি সবসময়ই বলেন, র‌্যাম্প আপনার নিজের ভুবন। তো সেই ভুবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন কেন?

পিয়া: র‌্যাম্প জগতে এখন অপেশাদার লোকের আনাগোনা বেড়ে গেছে। আমি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সেরা হয়ে দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছি। আমার মাধ্যমে ফ্যাশন দুনিয়ার অনেকে বাংলাদেশকে চিনেছে, জেনেছে বা জানতে চাইছে। আমি তো একটু সম্মান আশা করতে পারি, সেই সম্মানটুকু আমি পাচ্ছি না। কেন করব র‌্যাম্প, বলুন তো! অনেকবার বলেছি। কিন্তু আর না। এনার্জি লস করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই আর।

গ্লিটজ: একটি আন্তর্জাতিক সু্ন্দরী প্রতিযোগিতায় আপনার উপস্থিতি নিয়ে বেশ বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। সে বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা কি?

পিয়া : প্রতিটি বিউটি কনটেস্টে বিকিনি রাউন্ডের নিয়ম থাকে। এটা করা হয় একজন মডেল ন্যাচারালি কতটা বিউটিফুল তা বোঝার জন্য। নিয়ম মেনেই সব প্রতিযোগিরা সেখানে যান। এটাকে প্রফেশনাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যারা দেখতে পারছে না তারাই বিতর্ক তুলছে।

দেখুন আমাদের সামাজিক অধঃপতন কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পেশাদারিত্বের দৃষ্টিভঙ্গি এখনও তৈরি হয়নি আমাদের সমাজে।

গ্লিটজ: র‌্যাম্পে মেয়েদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে বারবার। কেন?  

পিয়া:
র্যাম্প শো মানে  হচ্ছে, মডেলদের হ্যাঙ্গার হিসেবে দেখানো হবে। একটি পণ্য কতটা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যায়, তার জন্যই ফ্যাশন শো। কিন্তু ফ্যাশন শোর সংজ্ঞাই তো পাল্টে ফেলেছে অপেশাদারের দল। তারা এখন র‌্যাম্প শো করছে, স্রেফ বিনোদনের জন্য, স্রেফ মেয়ে দেখার একটা আয়োজন হিসেবে।

অনেক শো হচ্ছে, যেখানে ডিজাইনার নেই, পোশাকগুলোর আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই। তো এমন ফ্যাশন শোকে মেয়ে দেখানোর পালা ছাড়া আর কি বলব। আমার লজিক তো তাই বলছে। বিতর্ক তো সংগত কারণেই উঠছে।

গ্লিটজ : র‌্যাম্প মডেলরা মডেলিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চান না। এর কারণ কী?

পিয়া : আমাদের দেশে এটা কখনও সম্ভব না। অনেকে আছে যারা র‌্যাম্পে নিয়মিত হতে চায়। কিন্তু পারছে না। কারণ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। রাতারাতি স্টার হওয়ার প্রবণতা তরুণদের মধ্যে অনেক বেশি। তারকাখ্যাতিও পেয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। সর্বনাশটা এখানেই হচ্ছে। এদের মাথায় তুলে নাচানাচি করে আবার ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এমন অস্থিতিশীল জগতে কে ক্যারিয়ার গড়তে চায়।

গ্লিটজ: বলছিলেন, মডেলদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কথা…

পিয়া: শুধু মডেল না, একজন অভিনেত্রী হিসেবেও আমাকে সামাজিক অনেক বাধা, কটুক্তি, উপেক্ষা সহ্য করতে হয়েছে। সত্যি বলতে, আপনি যখন একটা পেশায় থাকবেন, আর সে পেশাকে কেউ সম্মান না দেয়, তখন সে পেশাটি চালিয়ে যাওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। কম বয়সে হয়তো ব্যাপারটি বুঝতে পারে না অনেকেই। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে ঠিক বুঝতে পারে কেউ তাকে সম্মান দিচ্ছে না।

আমি আমার কথাই বলি, আমি যখন বলি আমি আইন বিষয়ে লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, আমি ইন্টারন্যাশনাল একটা কনটেস্ট জিতে এসেছি, তখন সবাই আমাকে বাহবা দেয়। আবার যখন বলি আমি র‌্যাম্প মডেল, বাংলা সিনেমার নায়িকা তখনই তারাই আবার বাঁকা চোখে দেখে।

কেন মডেল আর অভিনেত্রীরা কি আলাদা! তাদের একটু সম্মান দিলে কি এমন ক্ষতি?

আমি জানি, পরিবর্তনটা রাতারাতি আসবে না। সময় লাগবে। তবে শুরু তো করা যেতে  পারে।