'হৃদয়ে লেখ নাম, সে নাম রয়ে যাবে'

বছর ঘুরে এসে গেল ২৪শে অক্টোবর। ২০১৩ সালের এই দিনেই চলে গিয়েছিলেন তিনি। গেয়েছিলেন, “যদি কাগজে লেখ নাম কাগজ ছিঁড়ে যাবে,.. হৃদয়ে লেখ নাম, সে নাম রয়ে যাবে।” সে নাম কখনও মুছে যাবার নয়, তিনি মান্না দে।

শান্তা মারিয়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2014, 06:29 AM
Updated : 24 Oct 2014, 06:29 AM

‘আবার হবে তো দেখা’, ‘পৌষের কাছাকাছি’, ‘যদি হিমালয়’, ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’, ‘তোমার না যদি থাকে সুর’, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো’ - বাংলা গানের শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরা  এই গানগুলোর গায়ক তিনি।  সত্তর বছরের ক্যারিয়ারে চার হাজারের বেশি গান গেয়েছেন বাংলা, হিন্দি, মারাঠিসহ নানা ভাষায়।

এই কিংবদন্তি শিল্পীর জন্ম ১৯১৯ সালের পহেলা মে। তিনি প্রায়ই ঠাট্টা করে বলতেন ‘মে ডে’ মানে মান্না দে। জন্ম কলকাতায় এক সংগীতপ্রেমী পরিবারে। বাবা পূর্ণচন্দ্র দে, মা মহামায়া। আনুষ্ঠানিক নাম রাখা হয় প্রবোধ চন্দ্র দে। ডাক নাম মান্না। এই ডাক নামেই পৃথিবী চিনলো তাকে। মান্না দের জীবনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তার কাকা সংগীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে। কলকাতা ও বোম্বের বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন কৃষ্ণ চন্দ্র দে। বিশেষ করে কলকাতার পেশাদারী থিয়েটারে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী কণ্ঠশিল্পী। কাকার কাছ থেকেই মান্না দে পেয়েছিলেন গানকে ভালোবাসার শিক্ষা। স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজের ছাত্র মান্না দে বন্ধুদের মাতিয়ে রাখতেন গানে গানে। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তো বটেই কাকার সঙ্গে মঞ্চেও গান গাইতেন তিনি। খেলাধূলায়ও ছিলেন ভালো। বিখ্যাত কুস্তিগীর গোবর বাবুর কাছে কুস্তি ও বক্সিংয়ের তালিম নেন তিনি। পাশাপাশি ছিল গানের সাধনা। কৃষ্ণ চন্দ্র দে এবং ওস্তাদ দবির খানের শিষ্য মান্না দে আন্তঃকলেজ সংগীত প্রতিযোগিতায় তিনটি ভিন্ন বিভাগে টানা তিন বছর সেরা হন।

মাত্র ২৩ বছর বয়সে চলচ্চিত্রের সংগীতে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু হয়। ১৯৪২ সালে কাকার সঙ্গে বোম্বে যান। সেখানে তিনি প্রথমে কৃষ্ণচন্দ্র এবং পরে শচীনদেব বর্মনের সঙ্গে সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন হিন্দি ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। সে সময় ওস্তাদ আমির আলি খান ও ওস্তাদ আবদুল রহমান খানের কাছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নেন। ১৯৪২ সালেই ‘তামান্না’ ছবিতে গান গেয়ে প্লেব্যাক শিল্পীর খাতায় নাম লেখান তিনি। ‘সুরিয়া’ ছবিতে কাকার সঙ্গে ডুয়েট গেয়ে খ্যাতি পান। গানটি ছিল “জাগো আয়ে ঊষা, পানছি বোলে জাগো”।  ১৯৪৩ সালে ‘রামরাজ্য’ ছবিতে সুযোগ পেলেন একক গান গাওয়ার। ছবিটির প্রযোজক বিজয় ভাট এবং সংগীত পরিচালক শংকর রাও প্রথমে কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে গানটি গাওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসে। কিন্তু তিনি এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে মান্না দেকে গানটি গাওয়ার সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করেন। কাকার ধরনেই গানটি গেয়েছিলেন তিনি। ‘গায়ি তু গায়ি সীতা সতী’ গানটি হিট হয়। সে সময় পর্যন্ত কাকার গায়কীর ধরন অনুসরণ করতেন তিনি। পরে খুঁজে নেন নিজস্ব স্টাইল। এর পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক হিন্দি ছবিতে প্লেব্যাক করতে থাকেন। ‘কাদম্বরী’, ‘কমলা’, ‘বিক্রমাদিত্য’, ‘ইনসাফ’- সব ছবিতেই তার কণ্ঠ দর্শককে মোহিত করে। ‘গীত গোবিন্দ’ ছবিতে বৈষ্ণব পদাবলী থেকে নেওয়া পদের সংগীতায়োজন করেন পণ্ডিত ইন্দ্র, কণ্ঠ দেন মান্না দে। ফলাফল বিপুল জনপ্রিয়তা।

১৯৫০ সালে ‘মশাল’ ছবি থেকে শুরু হয় শচীনদেব বর্মনের সঙ্গে তার জুটি। এর ফলে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে হিন্দি ছবিতে তার আসন পাকা হয়ে যায়। ১৯৫২ সালে ‘অমর ভূপালি’ সিনেমাটি বাংলা ও মারাঠি ভাষায় মুক্তি পায়। এ ছবিতে মান্না দের গান ব্যপক দর্শকপ্রিয়তা পায়। এ ছবির মাধ্যমেই বাংলা ও মারাঠি ভাষার গানে তার যাত্রা শুরু হয়।

লতা মুঙ্গেশকর-মান্না দে জুটির প্রথম গান ছিল ‘নরসিংহ’ ছবিতে ১৯৫৯ সালে। পরবর্তীতে এই দুজনের অসংখ্য দ্বৈত গান হিন্দি ছবিকে সমৃদ্ধ করে। হিন্দি ছবিতে তার জনপ্রিয় গানের তালিকা দীর্ঘ।  ‘ও মেরে জোহরা জাবিন’ থেকে ‘আওয়ারা হু’ জনপ্রিয়তার মালায় একেকটি মুক্তো। ‘বুট পলিশ’, ‘শ্রী ৪২০’, ‘মেরা নাম জোকার’, ‘তিসরি কসম’ - এমন অনেক ছবিতে তার গান সমাদৃত হয়েছে। ‘পাড়োসান’ ছবিতে কিশোর কুমারের সঙ্গে গাওয়া 'এক চাতুর নার’ এবং ‘শোলে’ সিনেমার ‘ইয়ে দোস্তি’ ইতিহাস হয়ে আছে।

 ১৯৫৩ সালে মান্না দে বিয়ে করেন কেরালার মেয়ে সুলোচনা কুমারনকে। এই দম্পতির দুই মেয়ে সুরমা এবং সুমিতা। বিবাহিত জীবনে দারুণ সুখী মান্না দে ব্যর্থ প্রেমের অসংখ্য গান গেয়েছেন বাংলায়। ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’ কিংবা ‘তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ’র মতো বিরহের গানে মান্না দে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এই প্রসঙ্গে একবার মান্না দে ঠাট্টা করে বলেছিলেন তার নিজের জীবনে কোনো ব্যর্থ প্রেমের ঘটনা না ঘটলেও তার গীতিকারদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ব্যর্থ প্রেমিক।

অসাধারণ মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার আর সম্মাননা তার জীবনে কম আসেনি। ভারতের রাষ্ট্রীয় বেসামরিক সম্মাননা  পদ্মশ্রী এবং পদ্মভূষণ পেয়েছেন। ১৯৬৮ সালে সেরা পুরুষ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ‘মেরে হুজুর’ ছবিতে গান গেয়ে। ১৯৭১ সালে বাংলা ছবি ‘নিশি পদ্ম’তে গাওয়ার জন্য আবার সেরা গায়কের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। সে বছরই ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিটিও তাকে একই পুরস্কার এনে দেয় হিন্দি ভাষা বিভাগে। একই ছবির জন্য ১৯৭২ সালে পেয়েছেন সেরা গায়ক হিসেবে ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার। ২০০৭ সালে ভারত সরকার দাদা সাহেব ফালকে সম্মাননা এবং ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তাকে ‘বঙ্গ বিভূষণ’-এ ভূষিত করে।

মান্না দে গানের টানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। বেশ কয়েকবার এসেছেন বাংলাদেশে। ঢাকার শ্রোতাদের বিমুগ্ধ করেছেন তার কণ্ঠ-জাদুতে। মান্না দের আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসা ঘরে’ প্রকাশিত হয়েছে বাংলা, হিন্দি ও মারাঠি ভাষায়। মুম্বাইতে বাস করেছেন প্রায় পঞ্চাশ বছর। ২০১২ সালে ব্যাঙ্গালুরুতে স্ত্রীর মৃত্যু হলে তিনি মুম্বাই ছেড়ে ব্যাঙ্গালুরুতে বাস করতে থাকেন। ২০১৩ সালের ৮ই জুন মান্না দে অসুস্থ হয়ে ব্যাঙ্গালুরু হাসপাতালে ভর্তি হন। মাসখানেক হাসপাতালে থাকার পর তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। তবে অক্টোবর মাসে তিনি আবার অসুস্থ হন। ২৪শে অক্টোবর ৯৪ বছর বয়সে হৃদরোগে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।