'আমরা সবাই কখনো না কখনো পাগল'

“ব্রিটেনের আছে এমন তিন সম্পদ, যা আমেরিকার নেই। যে কারণে আমরা আমেরিকানরা এখনও ব্রিটিশদের চেয়ে পিছিয়ে। আর তা হল, ম্যাগনা কার্টা, টাওয়ার ব্রিজ এবং ‘আলফ্রেড দ্য গ্রেট’ হিচকক।”

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Oct 2014, 04:51 AM
Updated : 6 Oct 2014, 04:51 AM

উক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথিতযশা দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের কোনো এক সাংবাদিকের। সময়টা ত্রিশের দশক। বিশ্ববাসী তখন সবে চিনে নিতে শুরু করেছে সর্বকালের অন্যতম প্রতিভাবান নির্মাতা আলফ্রেড হিচকককে।

এই সময়েরও প্রায় তিন দশক পরে, হিচকক তখন পার করছেন ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা। ঠিক তখনই তিনি জন্ম দিলেন তার সেরা কীর্তির। আলফ্রেড হিচককের ‘সাইকো’ ইতিহাসে স্থান করে নিল চলচ্চিত্রের অনন্য এক অধ্যায় হিসেবে। হিচককের ক্যারিয়ারে সর্বপ্রথম এই হরর সিনেমা থেকেই পরবর্তীতে বিকাশ লাভ করে সাইকোলজিকাল থ্রিলার ধারা।

অর্ধশতাব্দী পর ‘সাইকো’ আজ সেলুলয়েডের কিংবদন্তী। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র নরম্যান বেটস এমনভাবেই নিজের ছাপ ফেলেছেন যে বার বার তার কাছে ফিরে যেতে হয়েছে বড় পর্দা ও ছোট পর্দার নির্মাতাদের।

১৯৬০: ‘সাইকো’র জন্ম

লন্ডনের শহরতলীতে এক রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেওয়া মোটাসোটা ভিতু প্রকৃতির বালক আলফ্রেড বড় হয়ে কখনও সিনেমা তৈরিতে হাত দেবে- এই চিন্তা হয়তো স্বপ্নেও মাথায় আসেনি তার। কিন্তু তারুণ্যের সূচনালগ্নেই যখন তিনি সংস্পর্শে এলেন আলোকচিত্রের মায়াময় জগতের, তখনই যেন একটু একটু করে চলমান ছবির দুনিয়া তাকে টানতে শুরু করেছিল। শুরুটা হিচককের হয়েছিল লন্ডন অবস্থিত এক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের স্টুডিওতে, মামুলি এক টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে। এখন বিশ্বের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া সেই প্যারামাউন্ট পিকচার্সের ব্যানারে তৈরি ‘সাইকো’ ছিল হিচককের শেষ কাজ।

প্যারামাউন্টের সঙ্গেই এর কিছুদিন আগে হিচকক শেষ করেছেন তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সফল এবং বড় বাজেটের সিনেমা ‘নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট’। ক্যারি গ্রান্টের মতো বড়মাপের তারকা, চার কোটি ডলারের বেশি বাজেট, বিশাল শুটিং সেট- সব মিলিয়ে খুবই জমকালোভাবে বানানো এই সিনেমার পরেই যেন কিছুটা হাঁপিয়ে উঠলেন হিচকক। চাইলেন, পরের সিনেমাটি স্বল্প পরিসরেই তৈরী করতে। প্যারামাউন্টও মোটামুটি অখ্যাত এক লেখক রবার্ট ব্লশের উপন্যাস থেকে সিনেমা বানানোর পরিকল্পনায় উৎসাহ দেখালো না তেমন। আর তাই, সিনেমা তৈরিতে হিচকককে তারা বাজেট বেঁধে দিল আশি হাজার ডলারের সামান্য বেশিতে। শুটিংও হলো মোটে ত্রিশ দিন।

বাজেট স্বল্পতার কারণেই সাদাকালোতে তৈরি হল সিনেমাটি। সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কারোরই তেমন তারকা খ্যাতি নেই। নিজের পারিশ্রমিকটাও এসব কারণেই শেষ পযর্ন্ত নিলেন না হিচকক। প্যারামাউন্টকে শুধু জানিয়ে রাখলেন, সিনেমার আয়ের ৬০ শতাংশ চাই তার।

তবে, গ্রীষ্মের মাঝামাঝিতে যখন মুক্তি পেল এই অল্প বাজেটের সিনেমা, আয়ের দিক থেকে আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেললো। যুক্তরাষ্ট্রতো বটেই সারা বিশ্ব তোলপাড় করা সিনেমাটি আয় করে নিল ৬০ কোটি ডলারেরও বেশি। 

আর সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া? সে তো পরের বছরের অস্কার আসরে সেরা পরিচালক, পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেত্রীসহ চারটি বিভাগে মনোনয়ন বাগিয়ে নেওয়ার ঘটনা দেখলেই বোঝা যায়। শুরুতে অবশ্য সিনেমায় অতিরিক্ত নিষ্ঠুরতা দেখানোর অভিযোগ তুলে অনেক সমালোচকই সিনেমাটির বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। আজ আমেরিকান ফিল্ম ইন্টটিউট এবং ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিউটের তালিকায় শতবর্ষের সেরা থ্রিলার সিনেমা এটি।

ইতিহাসের প্রথম সাইকো: নরম্যান বেটস

সিনেমার নাম যেহেতু ‘সাইকো’, নিঃসন্দেহেই সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রটি হবে মানসিক বৈকল্যের শিকার কোনো ব্যাক্তি। কিন্তু হিচককের এই ‘সাইকো’, খোদ সাইকো শব্দটিকেই অন্য মাত্রা দিয়েছে। 

বেটস মোটেলের ম্যানেজার এবং মালিক নরম্যান বেটস। প্রায় পরিত্যাক্ত এই মোটেলের পাশে একাকীই বসবাস করেন নরম্যান। নরম্যানের ভাষ্যে বাড়িতে আছে তার বিধবা মা যে কীনা একমাত্র ছেলের ব্যাপারে অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণ। ছেলের আশেপাশে কোনো নারীকে দেখলেই ইর্ষাকাতর হয়ে পড়েন তিনি। এমন সময়েই মোটেলে থাকতে এলো ম্যারিয়ন ক্রেইন। সেদিন সকালেই নিজের চাকরিস্থল থেকে চল্লিশ হাজার ডলার চুরি করে পালিয়েছে সে। নরম্যানের মোটেলে রাত কাটানোই তার উদ্দেশ্য। 

সেই রাতেই স্নানরত অবস্থায় এক রহস্যজনক নারীর এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে খুন হয় ম্যারিয়ন। নরম্যান বুঝতে পারে, খুনটা তার মা করেছে। মালসমেত ম্যারিয়নের লাশকে তার গাড়িতে করে একটা ডেবায় ফেলে আসে সে।

ম্যারিয়নের বোনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বছর দশেক আগেই মৃত্যু ঘটেছে নরম্যানের মায়ের। কিন্তু মায়ের মৃত্যুকে মন থেকে মেনে নিতে না পারায় তার মৃতদেহকে কবর থেকে তুলে এনে নিজের বাড়িতেই সংরক্ষণ করে রেখেছে সে। মাকে ‘বাঁচিয়ে’ রাখতেই মায়ের পোশাক পড়ে নিজেই সাজে নরমা বেটস। মায়ের শোক ভোলাতে তার মস্তিষ্ক তৈরি করেছে তার মায়ের ‘দ্বৈত সত্ত্বা’। আর সেই সত্ত্বা ধীরে ধীরে হটিয়ে দিচ্ছে নরম্যানকে। 

নরম্যান বেটসের এই মানসিক বৈকল্যকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটি এসেছে মাক্সর্িস্ট দার্শনিক ও পপুলার কালচার বিশেষজ্ঞ স্লাভো জিজেকের কাছ থেকে। তার মতে, নরম্যান বেটসের তিন তলা বাড়ির মতোই, তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা তিনটি পযর্ায়ে বিভক্ত। নরম্যানের মস্তিষ্কের ওপরের তলা শাসন করে তার মায়ের সত্ত্বা। নিচের তলাটা তার নিজের ব্যাক্তিত্ব। আর মাটির নিচের অংশটায় সংঘাত হয় এই দুই সত্ত্বার, যার ফলে শেষমেশ এক সহিংস অসুস্থতার জন্ম নেয় নরম্যানের মধ্যে।

নরম্যান বেটসের চরিত্রকে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন অ্যান্থনি পার্কিন্স। বিশেষ করে সিনেমার শেষ দৃশ্যে, যখন দেখা যায়, নিজের সত্ত্বা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলায় নরম্যানের ব্যাক্তিত্ব দখলে চলে গেছে তার মায়ের- ওই মুহূর্তে তার শীতল কিন্তু মর্মভেদী চাহনী আজও দর্শকের গায়ে কাঁপন ধরায়।

সিকুয়েল, প্রিকুয়েল, রিমেইক আর স্পিন-অফ

হিচককের ‘সাইকো’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই পরবর্তীতে নরম্যান বেটসকে নিয়ে তৈরি হয়েছে আরও তিনটি সিনেমা। ১৯৯৮ সালে রিমেইক করা হয় সিনেমাটি। ছোট পর্দার জন্যও তৈরি করা হয়েছে একাধিক স্পিন অফ। আর এখনতো চলছে এই গল্পকে কেন্দ্র করে ‘বেটস মোটেল’ নামের আস্ত এক টিভি সিরিজই।

হিচককের নির্মাণশৈলী থেকে অনুপ্রাণিত হলেও এসবের কোনোটিই অবশ্য যেতে পারেনি প্রত্যাশার ধারে কাছেও। প্যারামাউন্টের কাছ থেকে সত্ত্ব কিনে নেওয়ায় ইউনিভার্সাল পিকচার্সই তৈরী করেছে ‘সাইকো’র পরবর্তী পর্বগুলো। এর পরের তিনটি সিনেমা ‘সাইকো টু’, ‘সাইকো থ্রি’ এবং ‘সাইকো ফোর’-এর মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন অ্যান্থনি পার্কিন্সই। তিন নম্বর সিনেমার পরিচালকও ছিলেন তিনি নিজেই। কিন্তু সাইকো টু বাদে এর কোনটিই দর্শক কিংবা সমালোচক- কোন মহলেই আলোড়ন তুলতে পারেনি।

১৯৯৮ সালে রিমেইক হওয়া সিনেমাটিও বলতে গেলে ব্যর্থই হয়। ভিন্স ভন, জুলিয়ান মুর, অ্যান হেশের মতো তারকাও সিনেমাটিকে উতরাতে পারেনি। এটি নির্বাচিত হয় ইতিহাসের ‘সবচেয়ে বাজে রিমেইক’ হিসেবে।

সেই তুলনায় চলমান টিভি সিরিজ ‘বেইটস মোটেল’ গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে ভালোই। ভেরা ফার্মিগা, ফ্রেডি হাইমোর, ম্যাক্স থিয়েরয়েট অভিনীত সিরিজটির দুটি সিজন বের হয়েছে এ পযর্ন্ত। আইএমডিবিতে এর রেটিং ৮.২।   

‘সাইকো’: হিচককের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি

৬০ বছরের ক্যারিয়ারে হিচকক তৈরী করেছেন ৫০টি সিনেমা। এরমধ্যে, ‘রেবেকা’, ‘ভার্টিগো’, ‘রিয়ার উইনডো’, ‘দ্য বার্ডস’, ‘নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট’, ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’- এরকম আরও অনেক সিনেমাকেই ক্ল্যাসিক হিসেবে ধরা হয়। অনেকেই তার ক্যারিয়ারের সেরা সিনেমা হিসেবে ‘ভার্টিগো’র কথা বলবেন। তবে, একবাক্যে এটাও স্বীকার করা হয় যে, হিচককের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি হলো ‘সাইকো’।

অভিনব সিনেমাটোগ্রাফি, বার্নার্ড হেরমানের আত্মা কাঁপিয়ে দেওয়া আবহ সংগীত, সিনেমাজুড়েই হিচককিয়ান স্টাইলের মনস্তাস্ত্বিক মোটিফের ব্যাবহার- সব মিলিয়েই সিনেমাটি কেবল থ্রিলারপ্রেমী নয় সব দর্শকের কাছে উপভোগ্য। 

‘সাইকো’ মুক্তি দেওয়ার সময় হলের সামনে নিজের ছবি সম্বলিত একটি প্ল্যাকার্ড লাগিয়েছিলেন হিচকক। যার বক্তব্য ছিল, “এই সিনেমাটি অবশ্যই একদম শুরু থেকে দেখুন”। হিচককের এই উক্তির সঙ্গে সংগতি রেখেই বলা যায়, সাইকোথ্রিলারের প্রথম পাঠ হতে পারে এই সিনেমা দিয়েই।