‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’

যখন তিনি গেয়েছিলেন “আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে”, এক ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো বর্তমানের চাদর চিরে কি দেখে নিয়েছিলেন এক টুকরো আগামীকে? কারণ বাংলা গানের ইতিহাস থেকে তার নাম কখনোই মুছে যাবে না। তিনি গায়ক ও সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

>> শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Sept 2014, 07:03 AM
Updated : 26 Sept 2014, 07:32 AM

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২০ সালের ১৬ই জুন অবিভক্ত ভারতের বেনারসে। পশ্চিমবঙ্গের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান তিনি। লেখাপড়া করেছেন কলকাতায়। মিত্র ইন্সটিটিউশনের ছাত্র ছিলেন। স্কুল জীবনে গান গেয়ে সহপাঠীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তবে স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক তার গান করাকে ভালো চোখে দেখেননি। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় গান গাওয়ার অপরাধে শাস্তিও পেতে হয়েছিল তাকে।

সন্তোষ কুমার ঘোষ এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন হেমন্তর বন্ধু। দুজনেই পরবর্তীতে কবি হিসেবে যশ লাভ করেন। হেমন্তও সাহিত্যচর্চা করতেন। তার লেখা ছোটগল্প এক সময় দেশ পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে। হেমন্তর লেখা আত্মজীবনী ‘আনন্দধারা’তে তিনি তার স্কুল জীবন এবং পরবর্তীতে সংগীতভুবনে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য সংগ্রামের কথা লিখেছেন। কণ্ঠে সুর থাকলেও সংগীতের প্রাতিষ্ঠানিক তেমন কোনো শিক্ষা তার প্রথমে ছিল না। বাড়িতে হারমোনিয়াম পর্যন্ত ছিল না। এক বন্ধুর বাড়িতে হারমোনিয়াম বাজানো এবং স্বরলিপি থেকে গান তোলা শেখেন। পরবর্তীতে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ এবং তার ছাত্র ফণীভূষণ গাঙ্গুলির কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নেন। বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় ১৯৩৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তার গান প্রথম রেকর্ড করা হয়। ১৯৩৭ সালে কলম্বিয়া কোম্পানি থেকে তার প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়।

সে সময় তিনি যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু বুঝতে পারছিলেন গান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া একসঙ্গে চলবে না। তাই পড়া ছেড়ে দিয়ে গানের জগতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। সে সময় বেশ অর্থকষ্ট ছিল তার। গান গাইতেন রেডিওতে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কয়েকবার অপমানিতও হতে হয়েছে। অনুষ্ঠানে গান গাইবার কথা বলে তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়তো সুযোগ মেলেনি। তখনকার নামকরা শিল্পী পঙ্কজ মল্লিকের অনুসরণে গাইতেন তিনি। তাই ‘জুনিয়ার পঙ্কজ’ নাম জুটে যায়। তবে এর কিছুদিন পরই হেমন্ত নিজস্ব ধরনে গাইতে শুরু করেন।

চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন হেমন্ত। একদিন দেখা করতে গেলেন সে সময়ের নামকরা সাহিত্যিক এবং চিত্রনাট্যকার প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে। সুদর্শন, দীর্ঘদেহী তরুণ হেমন্তকে দেখে প্রেমেন্দ্র মিত্র ভাবলেন বুঝি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য এসেছে। একটি ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তাবও দিলেন তাকে। হেমন্ত অবশ্য সে প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৪১ সালে সুযোগ এলো চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার। ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবির জন্য গাইলেন। এরপর শুধু গাওয়া নয় সুরও করতে থাকেন। ‘কথা কয়ো নাকো’ গানটির রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে। নিজের সুরে গাওয়া এই গান বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সে সময় রবীন্দ্রসংগীত গেয়েও বেশ খ্যাতি পান তিনি। ‘প্রিয় বান্ধবী’ সিনেমায় গাইলেন রবীন্দ্রসংগীত। হিন্দি সিনেমাতেও গান গাওয়ার সুযোগ পেলেন। ১৯৪৪ সালে হিন্দি ছবি ‘ইন্দ্র’তে গান গাইলেন।

১৯৪৫ সালে ভালোবেসে বিয়ে করলেন সংগীত শিল্পী বেলা মুখোপাধ্যায়কে। রেডিওতে গাইতে গিয়ে দুজনের পরিচয়। বেলার বাবা ছিলেন না। পরিবারের ছোট ভাইবোন ও বিধবা মায়ের দায়িত্ব পালন করতে হতো। হেমন্ত বিয়ের পর বেলার পরিবারের পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। সেই সঙ্গে নিজের বাবা মায়ের দেখাশোনাও করতেন।

১৯৪৭ সালে বাংলা ছবি ‘অভিযাত্রী’র সংগীত পরিচালনা করেন হেমন্ত। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পঞ্চাশের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের ব্যস্ততম সংগীত পরিচালকদের একজন হয়ে ওঠেন। এদিকে চল্লিশের দশকেই যোগ দিয়েছিলেন আইপিটিএ(ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশ)-তে। বিপ্লবী গান ও গণসংগীতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পান। সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে গাইলেন ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’। দারুণ প্রিয়তা পেল গানটি। অকাল প্রয়াত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা ‘রানার' গাইলেন। সলিল চৌধুরী-হেমন্ত জুটি পরিচিত হয়ে উঠলো। এদিকে ছবিতেও একের পর এক সাফল্য। ‘শাপমোচন’, ‘হারানো সুর’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ প্রতিটি ছবির গান জনপ্রিয়তা পেল। ১৯৫১ সালে বোম্বে গেলেন ‘আনন্দমঠ’ ছবির সংগীত পরিচালনার কাজে। ছবিতে লতা মুঙ্গেশকর ও হেমন্তর গাওয়া ‘বন্দে মাতরম’ গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। হিন্দি ছবিতে হেমন্ত কুমার নামে তিনি প্লেব্যাক শিল্পী ও সংগীত পরিচালক হিসেবে খ্যাতি পেতে থাকেন। দেব আনন্দ অভিনীত ‘জাল’ ছবিটি গায়ক হেমন্ত কুমারকে ব্যাপক সাফল্য এনে দেয়। ছবিটির সংগীত পরিচালক ছিলেন শচীনদেব বর্মন।

তিনি বোম্বেতে তখন স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে পড়েন। ‘নাগিন’ ছবির গানগুলো হিট হয়। সাপুড়ের বীনের আওয়াজের সঙ্গে ‘তান ডোলে মেরা মন ডোলে’ আজও উদাহারণ হয়ে আছে। হিন্দি ও বাংলা সিনেমায় প্লেব্যাক ও সংগীত পরিচালনা ছাড়াও মারাঠি, অহমিয়া, কন্নাড়া, তামিলসহ ভারতের বিভিন্ন ভাষায় গান করেছেন।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তো বটেই সত্তরের দশকেও বাংলা ছবিতে এবং পুজোর বাজারে গায়ক-সুরকার হিসেবে তিনি খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন। ‘আজ দুজনার দুটি পথ’, ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাব’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’, ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’, 'কোনোদিন বলাকারা এত দূরে যেত কি’, 'এই রাত তোমার আমার', 'এই পথ যদি না শেষ হয়’- এমন অনেক অবিস্মরণীয় গানের তিনি গায়ক ও সুরকার।

পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনায় হাত দেন। ‘হেমন্ত-বেলা’ ব্যানারে মৃণাল সেনের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘নীল আকাশের নীচে’। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি তাকে এনে দেয় ‘প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল’ যা তখন ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার। গীতাঞ্জলি নামে হেমন্তর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত হয় ‘বিশ সাল বাদ’, ‘কোহরা’, ‘বিবি আউর মাকান’, ‘ফারার’, ‘রাহগির’, ‘খামোশি’সহ বেশ কয়েকটি ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র। বাংলাতে ‘বালিকা বধূ’, ‘মনিহার’, ‘অদ্বিতীয়া’র মতো বেশ কয়েকটি ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের প্রযোজক তিনি। ‘অনিন্দিতা’ নামে একটি ছবি পরিচালনাও করেছেন।

১৯৭১ সালে হেমন্ত হলিউডের বিখ্যাত পরিচালক কনরাড রুকসের ‘সিদ্ধার্থ’ ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। তিনিই প্রথম ভারতীয় সংগীত পরিচালক যিনি কোনো হলিউডি সিনেমায় সংগীতায়োজন করেন। কনরাড রুকস হেমন্তর কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে তাকে অনুরোধ করেন পুরো ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে নিজের খালি গলার গান ও গুণগুণ ব্যবহার করতে। ছবিটি ব্যাপক সাফল্য পায়। এ ছবিতে ‘ও নদীরে’ এবং ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ গান দুটি ব্যবহার করেন হেমন্ত। মার্কিন সরকার তাকে বাল্টিমোর শহরের সম্মান সূচক নাগরিকত্ব দেয়।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি ঢাকায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে সম্মান পান। ১৯৮০ সালে হার্ট অ্যাটাকের পর থেকেই হেমন্ত শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে আবার ঢাকায় আসেন এবং বেশ কিছু অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। বিটিভিতে সে সময় কবি ও গীতিকার আবু হেনা মোস্তফা কামাল তার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনটি চারটি গান পরিবেশন করেন আর তার গাওয়া শেষ গানটি ছিল ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’। ঢাকা থেকে ফিরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২৬শে সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ১৫ মিনিটে কলকাতার একটি নার্সিং হোমে মেজর হার্ট অ্যাটাকের কারণে মৃত্যুবরণ করেন।

সংগীতের সাধনায় জীবন কাটানো এই শিল্পী অসংখ্য দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গোপনে বহু ব্যক্তিকে সাহায্য করেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত সাহায্য পাঠাতেন নিজের পরিচয় গোপন রেখে। দেশ-বিদেশের কোনো অনুষ্ঠানে তাকে গান গাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি তা ফেরাতে পারতেন না। অনেক প্রত্যন্ত গ্রামে বিনা পারিশ্রমিকে সংগীত পরিবেশন করেছেন শুধুমাত্র ভক্তদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে। নিরহংকার, বিনয়ী এই শিল্পী গানের জগতে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।