জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতার মতো “অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়, আরও এক বিপন্ন বিষ্ময়” খেলা করেছে তাদের রক্তের ভেতরে। মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করা এই তারকাদের মধ্যে আছেন জনপ্রিয় নায়ক, আবেদনময়ী নায়িকা, কমেডিয়ান, সফল পরিচালক, সংগীতকার।
ঢাকাই সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া নায়ক ছিলেন সালমান শাহ। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দিয়ে শুরু হয়েছিল তার যাত্রা। ‘অন্তরে অন্তরে’ ‘দেনমোহর’, ‘তোমাকে চাই’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’সহ অসংখ্য হিট সিনেমার নায়ক সালমান শাহর মতো জনপ্রিয়তা খুব নায়কই পেয়েছেন। অথচ ১৯৯৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর মাত্র ২৫ বছর বয়সে এই সফল নায়ক গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তার ভক্তদের অনেকেই অবশ্য এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে মেনে নিতে চায়নি। গুঞ্জন উঠেছিল ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব কিংবা পারিবারিক অশান্তির জের ধরে তিনি খুন হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাই তার মৃত্যুর কারণ বলে সরকারিভাবে বলা হয়। সালমান শাহ কোনো সুইসাইড নোট লিখে যাননি, তবে দাম্পত্য কলহ এবং সহশিল্পীর সঙ্গে প্রেমই এই করুণ পরিণতির কারণ বলে মনে করা হয়।
২০১৩ সালের পহেলা জুলাই আত্মহত্যা করেন টিভির অভিনেত্রী, উপস্থাপক ও একসময়ের জনপ্রিয় মডেল মিতা নূর। সুন্দরী, প্রতিভাময়ী এই শিল্পীর ছিল স্বামী, সন্তান নিয়ে সাজানো সংসার। গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। এর কারণ সম্পর্কে সঠিকভাবে বলতে পারেনি কেউ।
কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেত্রী মহুয়া রায় চৌধুরীর মৃত্যু চমকে দিয়েছিল ভক্তদের। ‘দাদার কীর্তি’, ‘কপাল কুণ্ডলা’সহ অনেক ব্যবসাসফল সিনেমার এই নায়িকা ১৯৮৬ সালের ২২শে জুলাই নিজের দেহে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন। অবশ্য শ্বশুরবাড়ির লোকরা তাকে হত্যা করেছে বলে সেসময় জোর গুঞ্জন ওঠে। কিন্তু হত্যা বা দুর্ঘটনা প্রমাণিত হয়নি।
‘তুমি অনেক যতন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ, দিতে পারোনি’ কিংবা ‘কতদিন পরে এলে একটু বসো’- এমন অনেক হৃদয়ছোঁয়া গানের যিনি স্রষ্টা, সেই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আত্মহত্যা করেন ৬৮ বছর বয়সে। তার লেখা অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, আরতি মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় শিল্পীরা। কলকাতার বনেদী পরিবারের সন্তান সফল এই গীতিকার ১৯৯৯ সালে মাঝগঙ্গায় একটি লঞ্চ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। কেন তিনি মৃত্যুকে বেছে নিলেন তা আজও জানা যায়নি।
পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা গান— আয় খুকু আয়
বলিউডের অভিনেত্রী জিয়া খানের মৃত্যু জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্নের। তার আত্মহত্যায় প্ররোচনা দানের অভিযোগে হাজতবাস করতে হয়েছে তার প্রেমিক সুরাজ পাঞ্চোলিকে। জিয়া খান ছিলেন সম্ভাবনাময় অভিনেত্রী। ‘নিশাব্দ’, ‘গাজিনি’, ‘হাউসফুল’ এর মতো ব্যবসাসফল ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তার ক্যারিয়ার এগুচ্ছিল ধীর গতিতে। সেইসঙ্গে যোগ হয়েছিল প্রেমিকের উদাসীনতা। শেষপর্যন্ত প্রেমিক তার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়। এই আঘাত সহ্য করতে পারেননি জিয়া খান। ২০১৩ সালের ৩রা জুন মাত্র ২৫ বছর বয়সে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।
আত্মহত্যা করেছিলেন দক্ষিণের আরেক সফল অভিনেতা শ্রীনাথ। ২০১০ সালের ২২ জুলাই ৫৩ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন সফল এই অভিনেতা।
মডেল এবং টিভি অভিনেত্রী কুলজিত রানধোয়া ২০০৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জুহুতে তার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি ক্যাটস সিরিজের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন। ওই একই সিরিজের আরেক অভিনেত্রী এবং কুলজিতের ঘনিষ্ট বান্ধবী নাফিসা জোসেফ ২০০৪ সালের ২৯ জুলাই ২৬ বছর বয়সে একই ভাবে আত্মহত্যা করেন।
বলিউডের এক সময়ের খ্যাতিমান অভিনেত্রী পারভীন ববির মৃত্যু হয় ২০০৫ সালে। তিনি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতেন। তার মৃতদেহ মৃত্যুর কয়েকদিন পর উদ্ধার করে পুলিশ। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ববি মদ ও মাদকে আসক্ত ছিলেন। তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন বলে মনে করা হয়।
হিন্দি সিনেমার স্বর্ণযুগের অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক গুরু দত্তের আত্মহত্য্যা চলচ্চিত্র অঙ্গনের এক অপূরণীয় ক্ষতি। অসাধারণ প্রতিভাবান এই পরিচালক উপহার দিয়েছিলেন ‘কাগজ কি ফুল’, ‘পিয়াসা’,‘সয়লাব’,‘জাল’- এর মতো সব সিনেমা। অভিনেতা হিসেবেও ছিলেন দুর্দান্ত। ‘কাগজ কি ফুল’, ‘চৌদভি কা চান্দ’, ‘আরপার’, ‘সাহেব বিবি আউর গোলাম’ ছবিতে তার অভিনয় আজও সিনেমাভক্তদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এই সিনেমাগুলোর প্রযোজকও ছিলেন তিনি। তার স্ত্রী গীতা দত্ত ছিলেন সে সময়ের নামকরা প্লেব্যাক শিল্পী। মৃত্যুর আগে গুরু দত্তর ক্যারিয়ার
হলিউডে অনেক তারকাই আত্মহত্যা করেছেন। জীবন দিয়ে তার রূপায়িত করেছেন বিষাদময় কাহিনী। হলিউডে খ্যাতি পাওয়া ল্যাটিন আমেরিকান অভিনেত্রীদের অন্যতম লুপে ভেলেজ। বিশের দশকের শেষে নির্বাক চলচ্চিত্র দিয়ে তার হলিউডে যাত্রা শুরু হয়। ত্রিশের দশকে তিনি ছিলেন হলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী। আবেদনময়ী হিসেবে তার ছিল দারুণ জনপ্রিয়তা। সহশিল্পী ও পরিচালক, প্রযোজকদের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জন ছিল। তার প্রেমিকদের মধ্যে ছিলেন সেসময়ের খ্যাতিমান অভিনেতা গ্যারি কুপার, চার্লি চ্যাপলিন, ক্লার্ক গেবল, এরল ফিন। তার অন্যতম প্রেমিক ছিলেন হ্যারল্ড মারেশ। তার সঙ্গে সম্পর্কের এক পর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন ভেলেজ। কিন্তু হ্যারল্ড মারেশ তাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানালে ১৯৪৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৩৬ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন মেক্সিকান অভিনেত্রী লুপে ভেলেজ।
ষাটের দশকে আত্মহত্যা করেছিলেন হলিউডের আরেক খ্যাতিমান অভিনেত্রী ডায়ানা ব্যারিমোর। তার বাবা ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা জন ব্যারিমোর। মা ছিলেন নামকরা লেখক। শৈশবে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ও তিক্ত সম্পর্ক তার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বড় হয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন বোর্ডিং স্কুলে। মঞ্চে এবং সিনেমায় ব্যাপক খ্যাতি পেলেও বিষন্নতা ও তিক্ততা তাকে কখনও ছেড়ে যায়নি। তিনবার বিয়ে করলেও সুখের মুখ দেখেননি কখনও। শেষ পর্যন্ত অ্যালকোহলের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের বড়ি গ্রহণ করে ১৯৬০ সালের ২৫ জানুয়ারি ৩৮ বছর বয়সে মৃত্যুর পথ বেছে নেন এই সুন্দরী অভিনেত্রী।
নব্বইয়ের দশকের খ্যাতিমান টিনএজ অভিনেতা জোনাথন ব্র্যানডিস। পাঁচ বছর বয়স থেকে তিনি অভিনয় শুরু করেন। কিশোর বয়সেই ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। নারী ভক্তরা সব সময় ঘিরে রাখতো তাকে। ক্যারিয়ার ছিল সফল। অথচ ২০০৩ সালের ১২ নভেম্বর ২৭ বছর বয়সে কেন তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলেন তা আজ পর্যন্ত এক রহস্য।
স্প্যালডিং গ্রে ছিলেন খ্যাতিমান কমেডিয়ান এবং লেখক। বুদ্ধিদীপ্ত কমেডির জন্য ছিলেন বিশেষ খ্যাতির অধিকারী। তিনি বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছিলেন। ২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি ৬২ বছর বয়সে তিনি নিখোঁজ হন। পুলিশ তার মৃতদেহ নদী থেকে উদ্ধার করে। ফেরি থেকে মাঝ নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তিনি।
বিখ্যাত অভিনেতা ক্যারল ও’কনরের দত্তকপুত্র সুদর্শন তরুণ অভিনেতা হিউ ও’কনর আত্মহত্যা করেন ১৯৯৫ সালে। কিশোর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। চিকিৎসায় ক্যান্সার থেকে মুক্তি পেলেও ব্যথানিরোধক ঔষধের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন। নিজের তৃতীয় বিয়েবার্ষিকীর দিন বাবা ও পরিবারের সদস্যদের কাছে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি নিজে বলে যান যে আসক্তির সঙ্গে সংগ্রামে ক্লান্ত হয়ে তিনি চিরমুক্তির পথ বেছে নিচ্ছেন।
হলিউডের আরেক খ্যাতিমান কমেডি অভিনেতা ফ্রেডি প্রিনজ ১৯৭৭ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে নিজের মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। খুব কম বয়সেই ক্যারিয়ারে দারুণ সাফল্য পান তিনি। কিন্তু মাদকাসক্তি তাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়।
অর্থ, খ্যাতি, জনপ্রিয়তার আড়াল করতে পারেনি তাদের হতাশা, অভিমান ও যন্ত্রণাকে। আর তাই হয়তো নিজ হাতেই এই তারকা নিভিয়ে দিয়েছেন জীবনের আলো।