নিষিদ্ধ নয়টি সিনেমা

শিল্পীর অভিব্যক্তিকে অনেক সময়ই মুখোমুখি হতে হয় বিরুদ্ধতার। সেলুলয়েডে যখনই ছকে বাঁধা চিন্তা কিংবা গোঁড়ামিপূর্ণ সংস্কারকে আঘাত করা হয়েছে তখনই সেন্সর বোর্ডের হাত ধরে এসেছে প্রতিঘাত। আর তাই নিষিদ্ধ হয়েও অনন্য এই নয়টি সিনেমা।

শরীফুল হক আনন্দবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 July 2014, 06:54 AM
Updated : 28 July 2014, 07:01 AM

বার্থ অফ আ নেইশন

মার্কিন গৃহযুদ্ধ এবং এর ভয়াবহ পরিণতির প্রেক্ষাপটে ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ বানিয়েছিলেন ‘বার্থ অফ আ নেইশন’। ১৯১৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমার পিছু ছাড়েনি বিতর্ক। গোপন বর্ণবাদী সংস্থা ‘কু ক্লাক্স ক্ল্যান’কে সেলুলয়েডে গ্রিফিথই প্রথম নিয়ে আসেন। সিনেমাটি ব্যবসাসফল এবং জনপ্রিয় হলেও সিনেমাটিকে বয়কট করে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার সংরক্ষন সংস্থা ‘ইউএস ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ কালারড পিপল’। শিকাগো, সেইন্ট লুইস, ক্যানসাস সিটি, পিটসবার্গ, ডেনভারের মতো শহরে নিষিদ্ধ হয়ে যায় সিনেমাটি। ‘বার্থ অফ আ নেইশন’ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। বিতর্ক থামাতে পরের সিনেমা ‘ইনটলারেন্স’-এর মাধ্যমে ক্ষমা চাইতে হয় গ্রিফিথকে।

বেন-হার 

বেন-হার 

দাসত্বের শেকলে বন্দী এক ইহুদি রাজকুমার যার যীশুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তারই গল্প নিয়ে ১৯৫৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘বেন-হার’। সিনেমাটি জিতে নিয়েছিল রেকর্ড ১১টি অস্কার। উইলিয়াম ওয়াইলারের এই ক্ল্যাসিক ড্রামাটি ব্যবসাসফল হলেও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে চীনে সিনেমাটি নিষিদ্ধ করে মাও সেতুংয়ের সরকার। এমনকি এখন পর্যন্ত থিয়েটারে প্রদর্শন দূরের কথা, চীনে একটি ডিভিডিও নেই এই সিনেমাটির। খ্রীস্ট ধর্মের ইতিবাচক দিকগুলো চীনাদের বিভ্রান্ত করতে পারে এমন ধারণা থেকে এখনও এই নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে চীন।

ব্যাটেলশিপ পটেমকিন

ব্যাটেলশিপ পটেমকিন

রুশ প্রোপাগান্ডা সিনেমা সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’-এর মুক্তি যেন সেলুলয়েডে নতুন বিপ্লবের সূচনা। ১৯২৫ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি দেখার পর ইতালিতে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছিলেন স্প্যানিশ পরিচালক লুই বুনুয়েল এবং তার বন্ধুরা। চার্লি চ্যাপলিন এবং ফেয়ারব্যাঙ্কসের মতো চলচ্চিত্রের কিংবদন্তীরা এই সিনেমাটিকে তাদের জীবনে দেখা সেরা সিনেমা বলে উল্লেখ করেছেন। সিনেমাটির সমাজতন্ত্রের মন্ত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে-- বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের এমন আশঙ্কা থেকে অনেক দেশেই সেন্সর বোর্ডের খড়গ নেমে এসেছে ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’-এর ওপর। ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফ্রান্সে নিষিদ্ধ ছিল ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’। এমনকি যুক্তরাজ্যেও সিনেমাটি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা ছিল ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত।

দ্য টেক্সাস চেইন স ম্যাসাকার

দ্য টেক্সাস চেইন স ম্যাসাকার

হরর সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সেরা সিনেমা হিসেবে স্বীকৃত ১৯৭৪ সালে মুক্তি পাওয়া টবি হার্পার পরিচালিত ‘দ্য টেক্সাস চেইন স ম্যাসাকার’।  এই হরর ক্লাসিকের ছায়ায় নির্মিত হয়েছে বহু সিনেমা, রিমেইকও হয়েছে সিনেমাটির। তবে, সিনেমার অনেক দৃশ্যই সেন্সর বোর্ডের কাঁচিতে কাটা পড়ে। এমনকি, সেন্সরের সীমা পেরুতে না পেরে কয়েকটি দেশে নিষিদ্ধও হয় সিনেমাটি। পশ্চিম জার্মানি, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, সিঙ্গাপুরের মতো দেশে সিনেমাটি নিষিদ্ধ ছিল অনেক বছর।

লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস

লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস

ইতালীয় পরিচালক বারনার্র্দো বারতোলুচ্চির পরিচালনায় ‘দ্য লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস বিপত্নীক মধ্যবয়সী এক মার্কিন ব্যবসায়ীর সঙ্গে ফরাসি এক তরুণীর যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠার কাহিনি। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন মারলন ব্র্যান্ডো ও মারিয়া স্নাইডার। মাত্রারিতির্ক যৌনতা ও যৌন সহিংসতা প্রদর্শনের অভিযোগ ওঠে সিনেমাটির বিরুদ্ধে। বিতর্কের মুখে পড়ে বারতোলুচ্চির নিজের দেশ ইতালিতেই নিষিদ্ধ হয়ে যায় সিনেমাটি। এমনকি, এখন পর্যন্ত সিনেমাটি কোথাও দেখানোর উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সিঙ্গাপুরে।

ডিস্ট্রিক্ট ৯

ডিস্ট্রিক্ট ৯

২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটির মধ্য দিয়ে সাউথ আফ্রিকায় অ্যাপারথেইড বা প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবৈষম্যকে রূপক আকারে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন পরিচালক নিল ব্লমক্যাম্প। কিন্তু এই সিনেমাটির বিরুদ্ধেই বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় নাইজেরিয়ায়। কারণ সিনেমাটির একটি অংশে কিছু নাইজেরীয়কে খলচরিত্রে দেখানো হয়।

ভিরিদিয়ানা

ভিরিদিয়ানা

পরাবাস্তববাদী চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েল সেলুলয়েডে প্রচলিত ধারণা ভাঙ্গায় সিদ্ধহস্ত। তার ব্যতিক্রম ঘটেনি ভিরিদয়ানা সিনেমায়। সম্ভ্রান্ত এক ব্যক্তি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এক সন্ন্যাসিনীর প্রতি যিনি সম্পর্কে তার ভাই অথবা বোনের মেয়ে। ক্যাথলিক মতাদর্শবিরোধী উপাদানে পরিপূর্ণ সিনেমাটির স্পেনের তরফ থেকে ১৯৬১ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেওয়ারও কথা ছিল। কিন্তু চার্চের তরফ থেকে ব্যাপক প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে সিনেমাটির প্রদর্শন বন্ধ করে দেন রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল ফ্রাঙ্কো। ১৯৭৫ সালে ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিনেমাটি স্পেনে কেউই দেখতে পারেনি।

মিল্ক

মিল্ক

সত্তর এবং আশির দশকে সমকামীদের অধিকার আদায়ে সমাজের সঙ্গে লড়াই করে যাওয়া হারভি মিল্কের গল্প নিয়েই নির্মিত হয়েছে ‘মিল্ক’ সিনেমাটি। অনবদ্য অভিনয়ের জন্য যা শন পেনকে এনে দিয়েছিল সেরা অভিনেতার অস্কারও। তবে সামোয়ান আইল্যান্ডে সিনেমাটি নিষিদ্ধ হয়। সিনেমাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, এটি খ্রীস্ট ধর্মের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সামোয়ান রীতিবিরুদ্ধ। 

সালো অর দ্য ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড টোয়েন্টি ডেইজ অফ সডম

সালো অর দ্য ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড টোয়েন্টি ডেইজ অফ সডম

ইতালীয় কবি ও পরিচালক পিয়ের পাওলো পাসোলিনির শেষ সিনেমা এটি। ১৯৭৫ সালে খুন হওয়ার আগে তিনি নির্মাণ করেন ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত এই সিনেমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকের ইতালিকে তুলে ধরে ‘সালো অর ১২০ ডেইজ অফ সডম’। নয়জন ছেলে-মেয়ের উপর টানা যৌন নির্যাতন চালানোর দৃশ্যগুলোই মূলত বিতর্কের কার। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডে সিনেমাটি নিষিদ্ধ ছিল ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। আর মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে সিনেমাটি এখনও নিষিদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিনেমাটি কখনো নিষিদ্ধ না হলেও ১৯৯৪ এ সিনেমাটির ডিভিডি বিক্রির সময় এক পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় বিক্রেতাকে, যার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন মার্টিন স্করসেজি এবং অ্যালেক ব্যাল্ডউইন। পরবর্তীতে আদালতে মামলাটি বাতিল করে দেওয়া হয়।