মুভি রিভিউ: 'যুদ্ধশিশু'

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা যখন যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছিল, সেখানে থাকা ভারতীয় সাংবাদিক অমিতা মালিক লক্ষ করলেন বাঁকা হাসি হেসে এক পাকিস্তানি সেনা বলছে, ‘আমরা যাচ্ছি, কিন্তু বীজ রেখে যাচ্ছি’।

সেঁজুতি শোণিমা নদী বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2014, 07:44 AM
Updated : 18 May 2014, 08:56 AM

‘দ্য ইয়ার অফ দ্য ভালচার’ বইয়ে মালিক বলেন, “এই মন্তব্যের পেছনে লুকিয়ে আছে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস, সংগঠিত এবং নির্বিচার ধর্ষণযজ্ঞ, স্থানীয় সশস্ত্র সহযোগীদের নিয়ে যা চালিয়েছে একটি পেশাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।”

আইনের অধ্যাপক ক্যাথেরিন ম্যাককিননের ব্যাখ্যায় স্পষ্ট হয় এই ধর্ষণের চরিত্র।

“এমন ধর্ষণ, যা ধর্ষিতার বেঁচে থাকার ইচ্ছা কেড়ে নেয়। বাধ্য করে ঘর ছাড়তে এবং কখনও আর ফিরে না যেতে। এই ধর্ষণ দেখার, দেখানোর এবং অন্যকে শোনানোর। এই ধর্ষণের উদ্দেশ্য একটি গোষ্ঠীকে ছিঁড়ে ফেলা, একটি সমাজকে বিধ্বস্ত করা এবং মানুষকে ধ্বংস করা।”

এমন ধর্ষণকেই সমস্ত ভয়াবহতা সমেত উপস্থাপন করেছেন ভারতীয় পরিচালক মৃত্যুঞ্জয় দেবব্রত তার 'চিলড্রেন অফ ওয়ার’ সিনেমায়, যা বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছে 'যুদ্ধশিশু’ নামে।

মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে অস্ত্র সরবরাহকারী বীথিকা ধরা পড়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। একটি বাঁশের খুঁটিতে বীথিকাকে বেঁধে একের পর এক ধর্ষণ করতে থাকে পাকসেনারা। যন্ত্রণায় শুরুতে পশুর মতো গোঙাতে থাকা বীথিকাকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে বোধহীন নিস্তব্ধতা। শেষদিকে পাকিস্তানি শিবিরে বন্দি আরেক নারী ফিদার দিকে সে তাকিয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে। মৃত্যুতে তার এই অবর্ণনীয় লাঞ্চনার অবসান হয় অবশেষে।

এমন অনেক দৃশ্যেই গণহত্যার মতো সর্বোচ্চ অপরাধকে মূর্ত করে তুলতে পেরেছেন দেবব্রত। 

আর তাকে যথাযথ সহায়তা করেছেন রাইমা সেন, তিলোত্তমা সোম, পাভান মালহোত্রা, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, ফারুখ শেখ, ঋদ্ধি সেন এবং একটি ক্যামিও চরিত্রে ভিক্টর ব্যানার্জি। উপরের দৃশ্যে বীথিকা চরিত্রে তিলোত্তমা সোমের অভিনয় ভিত্তোরিও দি সিকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সিনেমা ‘টু উইমেন’ এ ইলিনয়ের ব্রাউনের ধর্ষণদৃশ্যের সঙ্গে তুলনীয়।

‘যুদ্ধশিশু’ মূলত ফিদা ও তার সাংবাদিক স্বামী আমিরের গল্প। ২৬ মার্চ রাতেই তাদের বাড়িতে হানা দেয় পাকিস্তানি সেনারা। আমিরের চোখের সামনে ফিদাকে ধর্ষণের অসহ্য ও দীর্ঘ দৃশ্য শুরুতেই সতর্ক করে দেয় সিনেমাজুড়ে দর্শকদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিতে যাচ্ছেন প্রথমবারের এই পরিচালক। কুইন্টিন টারান্টিনোর সিনেমা নাজিবিরোধী সিনেমা ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’-এর মতোই নৃশংসতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার একটা প্রয়াস লক্ষণীয়। তবে টারান্টিনো যেমন শক্ত বুনটে পাশাপাশি ছুটে চলা কয়েকটি গল্পকে এক সুতোয় বেঁধেছেন তেমনটা মুনশিয়ানা দেখাতে পারেননি দেবব্রত।

সিনেমায় ফিদা-আমিরের গল্পের সমান্তরালে এগিয়েছে বাবা-মা হারানো ভাইবোন রফিক এবং কওসারের গল্প, আশ্রয়ের খোঁজে যারা ছুটছে ভারতের দিকে। অথচ দুই ঘণ্টা ৪৩ মিনিটের এই সিনেমায় এই দুই গল্পের সম্মিলন ঘটে না। যার ফলে সিনেমার শেষ অংশে নদীতে নৌকা দিয়ে পার হওয়ার দৃশ্যে যখন কওসারের কল্পনায় যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশের রূপক হিসেবে ফিদার অবতারণা করলেন পরিচালক, তখন পুরো দৃশ্যটিকে খাপছাড়া মনে হওয়াটাই দর্শকদের জন্য স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে সিনেমার দৃশ্যগুলো স্বতন্ত্রভাবে ‘সিনেমাটিক বিউটি’র মুহূর্ত তৈরি করতে পারলেও গল্পের শক্তিশালী কাঠামোর অভাবে মাঝেমধ্যে ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের বাইরে চিত্রায়িত হওয়ায় বাংলাদেশি দর্শকদের চোখে পড়বে বেশ কিছু ভৌগলিক অসামঞ্জস্য। সিনেমার কিছু দৃশ্যে বলা হয়েছে পাকিস্তানি ক্যাম্পটি গোপালপুরে, আবার কয়েকটি দৃশ্যে বলা হয়েছে ক্যাম্পটি ঢাকায়। ক্যাম্পের পেছনে আবার দেখা গেছে পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপ। ক্যাম্পে বন্দি বীরাঙ্গনাদের পোশাকও সে সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এসব ক্ষেত্রে পরিচালক হয়ত আরও একটু ইতিহাসচর্চার পরিচয় দিতে পারতেন।  

তবে সিনেমার চিত্রগ্রহণ ও সংগীতের ব্যবহার প্রশংসার দাবি রাখে। ‘রক্তই তো’ শিরোনামের গানটির কথা বলতে হচ্ছে আলাদা করেই। গানটিতে চলচ্চিত্রের জন্য ধারণকৃত দৃশ্যের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র, নিউজ রিল এবং তথ্যচিত্রের ফুটেজের ব্যবহার করা হয়েছে।

হিন্দিতে নির্মিত ‘চিলড্রেন অফ ওয়ার’-এর বাংলা সংস্করণ ‘যুদ্ধশিশু’তে ডাবিংয়ের প্রক্রিয়ায় গলদ থেকে গেছে অনেক বেশি। সিনেমার চরিত্ররা কথা বলেন কলকাতার ‘বাঙাল’দের ঢংয়ে। বাংলাদেশেও মুক্তি পাওয়ার কথা মাথায় রেখে এ দেশীয় চলতি বাংলা ব্যবহার করলেই হয়ত বেশি ভালো হত।

ছবিতে প্রচুর উর্দু সংলাপ থাকায় ব্যবহার করা হয়েছে সাবটাইটেল। এবং সেই সাবটাইটেলও বাংলাদেশের বাংলার সঙ্গে সংগতিহীন। ভুল ব্যাকরণ (“তারা ‘ইয়া’ এইটা করবে, ‘ইয়া’ ওইটা!”) এবং ভুল শব্দের ব্যবহার (তারা যেন এই ঘটনা থেইকা আখেরি ‘চেতবানি’ পায়!) অনেকক্ষেত্রেই বিরক্তিকর।

আর তাই অনেকগুলো ভালো দিক থাকা সত্ত্বেও ‘যুদ্ধশিশু’কে স্বার্থক সিনেমা বলা যাচ্ছে না। পরিচালক মৃতুঞ্জয় দেবব্রতের এটিই যে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র- সেটা বোঝা গেছে ভালোভাবেই। সিনেমার প্রথমদিনের আইএমডিবি রেটিং ৮.৫ হলেও সমালোচকদের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে এখনো অনেকটা পথই পাড়ি দিতে হবে এই নবীন নির্মাতাকে।

তারপরও এই সিনেমার মাধ্যমে বাংলাদেশি না হয়েও ১৯৭১ কে তুলে ধরার যে মহৎ প্রয়াস দেখিয়েছেন পরিচালক- তা অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে এই মানের কাজ এটাই প্রথম। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি গণহত্যার দালিলিক বিবরণ হিসেবেও এই সিনেমাটির গ্রহণযোগ্যতা থেকে যাবে।