ওরা কোনো পরিচালকই না: আমজাদ হোসেন

চলচ্চিত্রশিল্প এখন ‘ধ্বংস হয়ে গেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন পরিচালক আমজাদ হোসেন। চলচ্চিত্র শিল্প নষ্টদের দখলে চলে গেছে বলেও আক্ষেপ করেছেন তিনি। এখানে আর ভালো কোনো সিনেমা নির্মিত হবে না বলে মনে করেন তিনি। গ্লিটজের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় চলচ্চিত্র শিল্পের পাশাপাশি তিনি শিল্পীদের নিয়েও তার ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2014, 01:38 PM
Updated : 23 April 2014, 01:38 PM

গ্লিটজ: লেখালেখির মাধ্যমে অভিনয়ে এসেছেন আপনি। পরবর্তীতে চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার ও পরিচালক হয়েছেন। নিজের শুরুর দিনগুলোর কথা কিছু বলুন।

আমজাদ হোসেন: স্কুলবেলা থেকে লেখালেখি করি। লেখালেখি করতে করতে একদিন ঢাকায় চলে আসি। শুরু করি নাটক দিয়ে। তারপর আমার ‘ধারাপাত’ নাটক নিয়ে সালাউদ্দিন জাকী নির্মাণ করলেন চলচ্চিত্র।

আমি এখন পুরোদস্তুর লেখক। লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত আমি। পুরনো দিনের কথা মনে পড়লে কষ্ট লাগে। অন্য কথা হোক।

গ্লিটজ: স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে আপনি সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতার পর নিজের পরিচালনায় ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘ভাত দে’-র পাশাপাশি আপনার চিত্রনাট্যে খান আতার পরিচালনায় ‘আবার তোর মানুষ হ’ সিনেমাতে সমাজের নানা চিত্র ফুটে উঠেছে। বর্তমানে বাংলা সিনেমাতে সামাজিক চিত্র কতটা ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন?

আমজাদ হোসেন:
অনেক যত্ন নিয়ে সিনেমাগুলো নির্মাণ করেছিলাম। আমরা সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে সচেতন ছিলাম। জানতাম, দর্শকের কাছে সে গল্প কীভাবে উপস্থাপন করতে হবে। দেশ-কালের সে গল্পও দর্শক লুফে নিত। পরবর্তীতে সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে যে সিনেমাগুলো নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর গল্প একদম নকল, বড় উদ্ভট। চিত্রনাট্যকাররা যেমন-তেমন গল্প লিখছে, পরিচালকদেরও কোনো মাথাব্যথা নেই।

গ্লিটজ: সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ‘বাংলার মুখ’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন। সিনেমাটি মুক্তি পায়নি কেন?

আমজাদ হোসেন: সে তো অনেকদিন আগের কথা। অনেক যত্ন নিয়ে সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলাম। সিনেমাটির রিল জমা ছিল এফডিসিতে। সবাই বলত, সিনেমাটির এ টু জেড সবকিছু ছিল দারুণ। শেখ সাহেব (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) নিজেই সিনেমাটি আলাদা করে রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সিনেমার রিল খুঁজে পেলাম না। আমার তো মনে হয়, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল কেউ। সিনেমার শিল্পী প্রয়াত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন, অভিনেত্রী রোজী, উজ্জ্বল, সুচরিতা, গোলাম মুস্তাফা সবাই দারুণ অভিনয় করেছিলেন। সিনেমাটি মুক্তি পায়নি বলে আনোয়ারের খুব মন খারাপ হয়েছিল।

গ্লিটজ: উনসত্তরের গণঅভ্যুথানে শহীদ আসাদকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। পরে সেটি হল না কেন?

আমজাদ হোসেন:
আসাদের পরিবারের অনুমতি মেলেনি। অনেক অনুরোধের পরও তার পরিবার রাজি হয়নি। তার পরিবার তাকে নিয়ে সিনেমা যেন কখনও না হয় সে জন্য আমাকে অনুরোধও করেছিল। অথচ আমি সবকিছুই প্রায় গুছিয়ে নিয়েছিলাম। আসাদের চরিত্রে আনোয়ার হোসেনের কথা ভাবছিলাম।

গ্লিটজ: মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

আমজাদ হোসেন: মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা নির্মাণ চাট্টিখানি কথা নয়। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা বানাতে গেলে আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে যতগুলো ক্ল্যাসিক সিনেমা হয়েছে সেগুলো ভালোভাবে দেখতে হবে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে হবে। তবেই না মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা হবে। একটা রাইফেল নিয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি খেলেই মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা হয়ে গেল, ব্যাপারটি এমন নয়। আমার তো মনে হয়, এমন কোনো পরিচালক নেই যারা ১০ মিনিট দৈর্ঘ্যের সত্যিকারের একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা বানাতে পারবে। আমি চ্যালেঞ্জ করতে পারি, কেউ নেই।

আসলে যেখানে সবকিছু খারাপ সেখানে ভালো কিছু করার আশা বৃথা। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমার কথা বলতে গেলে, আমি তৌকিরের (অভিনেতা, পরিচালক তৌকির আহমেদ) ‘জয়যাত্রা’ সিনেমার কথা বলব। আমার কাহিনি, চিত্রনাট্য নিয়ে বড় যত্ন করে সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি।

গ্লিটজ: বাংলাদেশের নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের গল্প নিয়ে সিনেমা হওয়ার কথা থাকলেও সেগুলো নির্মিত হয়নি। এর কারণ কী?

আমজাদ হোসেন: সবার মধ্যে একটা ভয় কাজ করে। ভয়টা হল, গল্প নিয়ে। কেউ সিনেমা বানাবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্র বা ইতিহাস নিয়ে, কেউ বানাবে বিএনপিকে নিয়ে। কেউ বলবে, ঐ সিনেমাতে তো বঙ্গবন্ধুকে অপমান করা হল। অন্য কেউ বলবে ওর সিনেমাতে জিয়াকে অপমান করা হয়েছে। এই অদ্ভুত কারণে রাজনৈতিক সিনেমা সেভাবে হয়নি। তবে আমার মনে হয়, উনিশ শতকের গোড়ার দিকের রাজনীতি নিয়ে সিনেমা হলে ভালো হত। বঙ্গভঙ্গ, বিশ্বযুদ্ধকালীন বাঙালি সমাজের চালচিত্র-- এসব গল্প নিয়ে কাজ করতে পারলে দারুণ হত।

গ্লিটজ: বর্তমানের ডিজিটাল সিনেমা নিয়ে আপনি কী ভাবেন?

আমজাদ হোসেন:
এদের নিয়ে আসলে কী বলব! তথাকথিত ডিজিটাল সিনেমা নির্মাতাদের আমি কোনোভাবেই চলচ্চিত্র নির্মাতা বলব না। মুখে মুখে বললেই হল! ডিজিটাল সিনেমা মানে সবকিছুই হবে আধুনিক। গল্প থেকে শুরু করে সিনেমার এডিটিং প্যানেলের সবাই ডিজিটাল সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করে আসবে, এমনই তো হবে। কিন্তু বাস্তবের চিত্রটা ভিন্ন। কেউ পড়াশোনা করে আসছে না। ডিজিটাল সিনেমা কী ব্যাপারটাই জানে না তারা। কী কী সব ডিজিটাল ক্যামেরা আসছে। ওগুলো কি আসলেই ডিজিটাল ক্যামেরা? আমার তো মনে হয়, ৩৫ মিলিমিটারে সিনেমাই আসলে ভালো ছিল। ডিজিটাল সিনেমা ব্যাপারটা সিনেমা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।

গ্লিটজ: ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে সিনেমাতেও ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগছে। এতে আপত্তি কিসে?

আমজাদ হোসেন: ডিজিটাল প্রযুক্তির কথা উঠছে। কিন্তু সিনেমাতে কতজন এ প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করে এসেছে? আর যারা বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে এসেছে তারা কী করছে। তারা তো কোনো অবদানই রাখতে পারল না। লাভ কী হল! অনেক ছেলেমেয়ে ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজে পড়াশোনা করছে। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস করে সিনেমা বানাতে আসে মাত্র ৫ ভাগ। বাকিরা সব বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসে কেরানিগিরি করে। কীভাবে ডিজিটালাইজড হবে সিনেমা?

ডিজিটাল সিনেমা না হয় বানাল। কিন্তু সেগুলো হলে চালাবে কীভাবে। হলগুলোতে ২-কে ইফেক্ট সম্পন্ন প্রজেক্টর নেই। আর ডিজিটাল সিনেমা চালানোর ব্যাপারে যথাযথ প্রশিক্ষিতও নয় হলের কর্মীরাও। আগে এদের প্রশিক্ষিত কর, কলাকুশলীদের মধ্যে ডিজিটাল সিনেমা ব্যাপারটি ক্লিয়ার হোক, তারপর ডিজিটাল সিনেমার ব্যাপারে ভাবা যাবে।

গ্লিটজ: আপনার বেশকিছু উপন্যাস থেকে সিনেমা নির্মিত হয়েছে। সাহিত্যভিত্তিক সিনেমা নির্মাণের ব্যাপারে আপনার কী অভিমত?

আমজাদ হোসেন:
এ জন্য দায়ী করব, তরুণদের পাঠাভ্যাসকে। ওরা এখন পড়তে চায় না। আগে যখন আমার গল্প থেকে সিনেমা হয়েছে, দর্শক সে গল্প আগেই পড়ে ফেলত। ওরা সিনেমার দৃশ্যগুলো নিয়ে ভাবত। সিনেমা হলে এসে মিলিয়ে দেখত, তাদের ভাবনার সঙ্গে আমি কতটা মিল রেখেছি। এখন সে ‍যুগ নেই। সাহিত্যনির্ভর সিনেমা নির্মাণের হারও কমতে কমতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

গ্লিটজ: সম্প্রতি নকল সিনেমা ও ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির ব্যাপারে চলচ্চিত্র পাড়া সরগরম। দুটি ব্যাপার নিয়ে আপনি কী ভাবেন?

আমজাদ হোসেন: নকল সিনেমার ব্যাপারে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। নকল সিনেমা ধরিয়েও দিতাম। কিন্তু নকলবাজরা নতুন তরিকা আবিষ্কার করে ফেলেছে। সেন্সর বোর্ডকে কিছু একটা বুঝিয়ে ঠিকই অনুমতি আদায় করে নেয়। সেন্সর বোর্ডও তেমনই। কী বলব আর।

ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির ব্যাপারে স্বাধীনতার পর থেকেই অনেক হল-মালিক জোর চেষ্টা চালিয়েছে। এ নিয়ে আমরা পরিচালকরা আপত্তি জানালেও সরকারি মহলে শিথিলতা আমাদের হতাশ করেছে। ভারতীয় সিনেমা আমদানির ব্যাপারে এখনও অনেকে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। খোকন (শহীদুল ইসলাম খোকন, পরিচালক সমিতির সভাপতি ও সেন্সর বোর্ড সদস্য) ও  নওশাদ (ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ, মধুমিতা হল মালিক ও সেন্সর বোর্ড সদস্য) দুপক্ষ হয়ে লড়াই করছে। দেখা যাক, শেষে কে জেতে।

গ্লিটজ: এখন যারা অভিনয় করছে, তাদের ব্যাপারে কী বলবেন?

আমজাদ হোসেন:
একজনও অভিনয় জানে না। ওদের প্রশিক্ষণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। ওরা কী সত্যি সিনেমাতে থাকতে এসেছে না শখের বশে কাজ করছে, আমি সন্দিহান। অন্যান্য গুণাবলীও অনুপস্থিত।

গ্লিটজ: আপনি বলছেন, প্রশিক্ষণের কথা। এতদিনেও পূর্ণাঙ্গ একটা ফিল্ম ইনস্টিটিউট হল না কেন?

আমজাদ হোসেন: একটা পূর্ণাঙ্গ একটা ফিল্ম ইনস্টিটিউট হলে আসলেই ভালো হত। অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনা, সম্পাদনা, ক্যামেরা চালানো অনেক বিষয়ে ছেলেমেয়েরা হাতে-কলমে শিখতে পারত। সিনিয়রদের এ ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া দরকার।

গ্লিটজ: এত সমস্যা! কোথাও কী কোনো আশা দেখেন না?

আমজাদ হোসেন: না একদমই না। তবে শূন্য থেকে শুরু করতে পারলে অবশ্যই হবে। সবাইকে নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। সরকারি মহলকেও উদ্যোগী হতে হবে। শিল্পীদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তাদেরই সোচ্চার হতে হবে। হয়ত একদিন আবার ঘুরে দাঁড়াবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি।

গ্লিটজ: সিনেমার পাশাপাশি নাটকের হালহকিকত নিয়ে কিছু বলুন।

আমজাদ হোসেন: নাটকের কোনো মানই নেই। সব নাটক একদম মানহীন। এখন যারা নতুন আসছে তাদের মধ্যে আমি একজনকেও ভালো পারফর্মার বলব না। নাটকের গল্পগুলো কোথাও না কোথাও থেকে চুরি করা। এসব নকল নাটকের প্রতি দর্শকেরও আগ্রহ নেই।

গ্লিটজ: আপনি কি তাহলে পরিচালনায় আসবেন না আর?

আমজাদ হোসেন: এখনই বলতে পারছি না। আসতেও পারি। তবে আমি সিনেমা বানালে সেটা বাংলাদেশে করা যাবে না। সিনেমার শতভাগ কাজ আমি ভারতে করতে চাই। অনেক যত্ন নিয়ে সিনেমা বানাব। তবে সহসা সেটি হচ্ছে না। এখন লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই।

আলোকচিত্র: আসিফ মাহমুদ অভি