১৯ এপ্রিল, রূপসী বাংলা হোটেলের উইন্টার গার্ডেনে ‘রকনেইশন ওভারলোড’ কনসার্টে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কিছুক্ষণ পরপরই দর্শকদের কণ্ঠে ছিল ‘আর্টসেল, আর্টসেল’ স্লোগান।
তাই বলে অংশ নেওয়া অন্য ব্যান্ডগুলোর চাহিদাও কম ছিল না।
কনসার্টের শুরুতেই ছিল পাওয়ারসার্জের পারফর্মেন্স। ডি-রকস্টার দিয়ে পরিচিতি পাওয়া এই ব্যান্ডের স্টেইজ পারফর্মেন্স নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ ছিল না কখনোই। বরাবরের মতোই এই কনসার্টে পাওয়ারসার্জের ছিল ‘টাইট পারফর্মেন্স’। উপস্থিত দর্শকদের সিংহভাগ ‘মেটালহেড’-ফ্যান আর মঞ্চে তখন পাওয়ারসার্জ। হেডব্যাং, উইন্ডমিল আর মশপিট দিয়ে রকনেইশন ওভারলোড পরিণত হল পুরোদস্তুর হেভি মেটাল কনসার্টে।
পাওয়ারসার্জের পর ছিল আর্বোভাইরাসের পালা। তাদের ‘মন্তব্য নিস্প্রয়োজন’ অ্যালবামের সংক্রমণের প্রকোপ যে এখনও কাটেনি। বরং আরও যেন জেঁকে বসেছে। ‘জ্বালো আগুন জ্বালো’, ‘হারিয়ে যাও’, ‘অমানুষ’— এই গানগুলো পরিনত হল স্লোগানে। ভোকাল সুফির সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইলেন দর্শকরা, কখনও হাত নেড়ে, কখনও বা ‘বানি হপ’ আর শেষমেশ ‘অমানুষ’ গানের সময় হেডব্যাং আর মশপিট।
তাদের পরিবেশনার মাঝেই একবার ‘রোটেটিং ড্রামস’ সেট ছেড়ে স্টেইজ ডাইভ দিয়ে বসলেন ড্রামার নাফিস।
তারপরও বাকি ছিল অ্যার্বোভাইরাসের ‘অ্যান্টিক’ পারফর্মেন্সের। শেষ গান ছিল ‘অমানুষ’। কথা নেই বার্তা নেই, গান শেষ হওয়ার আগেই স্টেইজে আছড়ে হাতের স্ট্র্যাটোকাস্টার গিটারটি ভাঙলেন গিটারিস্ট রঞ্জন।
ভাঙা গিটার ছুড়ে দিয়েই স্টেইজ ডাইভ। হাতের লেস পল গিটারটা ভাঙবেন নাকি ভাঙবেন না সেটা নিয়ে গানের শেষে হয়তো একটু দোটানাতেই ভুগছিলেন ব্যান্ডের আরেক গিটারিস্ট সুহার্তো। শেষ পর্যন্ত তিনিও হুঙ্কার ছাড়লেন লেস পলটি আছড়ে ভেঙ্গে। আর ততক্ষণে ভক্তদের চোখ ছানাবড়া!
দর্শকদের মাঝে ছুঁড়ে দেওয়া রঞ্জনের ভাঙা গিটার নিয়ে রীতিমতো ধস্তাধস্তি লেগে গিয়েছিল। কনসার্টের শেষে এক ভক্তের হাতে সুহার্তোর লেস পল গিটারটির নেক! হেডস্টক আর বডি নেই, তারপরও যক্ষের ধনের মতোই আগলে রেখেছেন সেটা! রকনেইশন ওভারলোডে আর্বোভাইরাসের এই পারফর্মেন্স বাংলাদেশের রক মিউজিকের ভক্তরা যে দীর্ঘদিন মনে রাখবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর্বোভাইরাসের পর স্টেইজে উঠল ‘শূন্য’। হেভিমেটাল শ্রোতাদের মধ্যে তাদের অবস্থা ছিল ডাঙায় আছড়ে পড়া মাছের মতোই। ‘শত আশা’র মতো হিট গান দিয়ে শুরু করলেও দর্শকদের কাছ থেকে সাড়াটা ঠিক যেন সেভাবে আসছিল না। গান শেষ হতে না হতেই বারবার ‘আর্টসেল আর্টসেল’ স্লোগান উঠছিল দর্শকদের মধ্যে থেকে। পুরো সেট লিস্ট শেষ না করেই হয়তো মঞ্চ থেকে ছাড়তে হয়েছিল শূন্যকে।
শূণ্যের পারফর্মেন্সের পর অনেকটাই ভাটা পরেছিল দর্শকদের উন্মাদনায়। মঞ্চের একদম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু দর্শক বাদে বেশিরভাগ দর্শকই তখন বসে পরেছেন মাটিতে, অনেককেই দেখা গেল গোল হয়ে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে।
দর্শকদের সেই ভাটা পরা উন্মাদনায় যেন নতুন রক্তের সঞ্চালন করে নেমেসিস। ভোকাল জোহাদ স্টেইজে আসতে না আসতেই স্লোগান উঠলো ‘জোহাদ, জোহাদ’। মুহূর্তে সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে দর্শকরা তখন আবারও দু’পায়ে দাঁড়িয়ে, গানে গলা মিলিয়ে এবার নেমেসিসের সঙ্গে মাতলেন তারা। এরমধ্যে সেই উন্মাদনায় পানি ঢেলে দিল সাউন্ড সিস্টেমের গলদ।
মনিটর থেকে ঠিকমতো শুনতে না পাওয়ায় গানের মাঝেই একবার সব থামিয়ে দিলেন নেমেসিসের সদস্যরা। তারপর পারফর্মেন্স আবার শুরু করলেও সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে কমবেশি ভুগতে হয়েছে পরের প্রায় সব আর্টিস্টকেই।
নেমেসিসের পারফর্মেন্স শেষ, দর্শকদের অধিকাংশই ততক্ষণে বেশ খুশি। তবে পরের ব্যান্ডের কথা কেউ যদি ‘ভুল করেও ভুলে গিয়ে থাকেন’ তবে তার অন্তরাত্মা যে কেঁপে গিয়েছিল তা নিশ্চিত। কারণ নেমেসিসের পরেই মঞ্চে আসে ক্রিপ্টিক ফেইট, যেন পৌরাণিক রাক্ষসের মতোই তাদের আগমন! ‘দানব’ নামের পুরো একটা অ্যালবামই আছে তাদের। আর মঞ্চেও যেন দানবীয় উপস্থিতি। বরাবরের মতোই কমিক ভক্ত ভোকাল শাকিবের পরনে সুপারহিরো টি-শার্ট। তবে চিরপরিচিত সুপারম্যান নয়, রকনেইশনের কথা ভেবেই বোধহয় পরে এসেছিলেন গ্রিন ল্যান্টার্নের টি-শার্ট।
গ্রিন ল্যান্টার্নের মতো ‘পাওয়ার রিং’ নেইতো কি হয়েছে! মেটাল ভোকালের দানবীয় কণ্ঠ আর হাতের বেইজ গিটারটাতো আছে। সেই ‘সুপারপাওয়ার’ দিয়েই যেন ভেন্যুর সামনে থেকে পেছনের সব দর্শককে এক কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসলেন শাকিব। শুরু করেছিলেন ক্রিপটিক ফেইটের শেষ অ্যালবাম ‘নয় মাসের গান’ দিয়ে। এরপর একে একে ‘যাত্রা’, ‘অনাদরের সন্তান’ আর ‘ভবঘুরে’। থেকে থেকে শাকিবের দানবীয় কন্ঠ ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন দর্শকরা। ততক্ষণে উইন্টার গার্ডেন কাঁপছে ক্রিপটিক ফেইট আর দর্শকদের উন্মদনায়।
শেষ গান ছিল ‘আক্রমণ’। গিটারের প্রথম পাওয়ার কর্ডের আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই উইন্টার গার্ডেন যেন পরিণত হল যুদ্ধক্ষেত্রে। কনসার্টের সবচেয়ে বড় মশপিটটাই হল ক্রিপটিক ফেইটের আক্রমণের সঙ্গে। মশপিটের হঠাৎ করেই পরে গেলেন এক ভক্ত। বাকিদের পায়ের নিচে চাপা পড়ার আগেই তাকে টেনে তুলে নিলেন আরেক মেটালহেড।
টেনে তুলেই প্রশ্ন, “আর ইউ ওকে ব্রাদার?” উত্তর ছিল, “লাইক নেভার বিফোর।” পিঠ চাপড়ে দিয়ে আবারও মশপিটে ঝাঁপিয়ে পরলেন দুজন একসঙ্গে।
ক্রিপটিক ফেইটের দানবীয় পারফর্মেন্সের পর ছিল ব্ল্যাকের পালা। শুরুতেই মাইক্রোফোনে ড্রামার টনি। স্মরণ করলেন ২০০৫ সালের ১৯ এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনার কথা। যাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিক জগতের শীর্ষ শব্দ প্রকৌশলী ইমরান আহমেদ চৌধুরি। ৯ বছর পর একই দিনে কনসার্টের পারফর্মেন্স ইমরান আহমেদ চৌধুরিকেই উৎসর্গ করলেন টনি। এরপর পারফর্মেন্সের পালা। পুরানো গানগুলোর সঙ্গে নতুন ট্র্যাক ‘অমর’ পারফর্ম করল ব্ল্যাক। মাঝে ভেন্যুর পেছন থেকে আর্টসেল স্লোগান উঠলেও, উত্তরটা আসলো ব্ল্যাক ভক্তদের কাছ থেকেই।
একদিকে ‘আর্টসেল’, অন্যদিকে ‘ব্ল্যাক’ স্লোগান। শীর্ষ দুই ব্যান্ডের ভক্তদের মধ্যে বিভক্তি পরিষ্কার। তারপরও ঠিকই রকনেইশন মাতিয়েই স্টেজ ছাড়লো ব্ল্যাক।
সবার শেষে আর্টসেল। ততক্ষণে ঘড়ির কাটা পার হয়েছে রাত ৯টা। বিকেল ৪টা থেকে অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছেন আর্টসেল ভক্তরা। অবশেষে মিললো অপেক্ষার ফসল। মাঝে সদস্যদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সূত্র ধরে আর্টসেলে শোনা যাচ্ছিল ভাঙনের সুর। ‘ডাই হার্ড’ আর্টসেল ভক্তদের মনেও যেন পৌছেঁ গিয়েছিল সেই ভাঙন। ভক্তদের সেই সব হতাশা, দুশ্চিন্তা মুছে দিয়ে মঞ্চে ফিরলো এই ব্যান্ড।
আর্টসেলের সদস্যরা স্টেইজে পা দেওয়া মাত্রই ভেন্যুর এ মাথা থেকে ও মাথা ‘আর্টসেল, আর্টসেল’ স্লোগান। সাউন্ড পরীক্ষায় বেশ কিছু সময় লাগছিল। তারপরও আর্টসেল উন্মাদনায় ভাটা নেই ভক্তদের। দীর্ঘদিন পর দুই ব্যান্ডমেট লিংকন আর এরশাদকে পাশাপাশি মঞ্চে দেখে দর্শকদের খুশির যেন শেষ ছিল না। মেকানিক্সের রিয়াজ আর্টসেলে বাজাচ্ছেন অনেকদিন ধরেই। নেই দীর্ঘদিনেই বেজিস্ট সেজান। তার জায়গায় বাজালেন জাহিন।
তবে সাজু-সেজানের অনুপস্থিতি কোনোভাবেই বুঝতে দেননি রিয়াজ আর জাহান। আর লিংকন-এরশাদ জুটির উপস্থিতিও দর্শকদের যেন ভুলিয়ে দিয়েছিল বাকি সবকিছুই।
লিংকন শুরুটা করলেন অদেখা স্বর্গ গানটা দিয়ে। গলা মেলালেন দর্শক আর ভক্তরা, মুহূর্তেই লিংকনের গলায় ছাপিয়ে গেল ভক্তদের চিৎকার। আমার পথচলা, দুঃখ বিলাশ, চিলেকোঠার সেপাই, স্মৃতিস্বারক আর অন্যসময়— মিলিয়ে একে একে ৭টি গান পরিবেশন করলো আর্টসেল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যেও থামেনি দর্শকদের চিৎকার।
গানের মাঝের সময়টায় ‘আর্টসেল, আর্টসেল’ স্লোগান। আর গানের সময় লিংকনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান, সত্যিকার অর্থেই ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েই প্রত্যাবর্তন ঘটলো তাদের।
৭টি ব্যান্ডের পারফর্মেন্সের পরেও ছিল আরও চমক। যেন রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের মতো ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’— আর্টসেলের পর ‘অলস্টার’ পারফর্মেন্সে একসঙ্গে বাজিয়েছেন দেশের শীর্ষ শিল্পীরা।
ছিলেন ওয়ারফেইজের কমল ও অনি, ইন্দ্রালোর জন, শ্র্যাপনেইল মেথডের বেইজিস্ট পাভেল, ফিডব্যাকের লাবুসহ আরও অনেকেই। সবাই মিলে পারফর্ম করেন প্যান্টেরার সেমেটারি গেইটস, পিংক ফ্লয়েডের অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল আর ওয়ারফেইজের একটি ছেলেসহ আরও অনেক গান।