দাবাং এবং রগরগে দোষ

নতুন বছরের শুরুতে বেশ কয়েকটি সিনেমা মুক্তির কড়া নাড়ছিল। তাদের কয়েকটি বেশ আকর্ষণীয়ও বটে। কিন্তু নানা কারণে সেগুলো মুক্তি পেতে দেরি হচ্ছে। ফাঁকতালে বছরের প্রথম ছবির মর্যাদা মাথায় উঠেছে একটি তৃতীয় শ্রেণির ছবির কপালে।

নাবীল অনুসূর্যবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Jan 2014, 02:56 AM
Updated : 26 Jan 2014, 09:42 AM

‘দাবাং’ নামের সেই চলচ্চিত্রটি নিয়ে আলোচনা করার মূল কারণও সেটিই-- বছরের প্রথম ছবি।

আর যে কারণ দুইটি বিদ্যমান, সে দুইই বিতর্ক-সাপেক্ষ; প্রথমত, চলচ্চিত্রটি অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট কি না এবং দ্বিতীয়ত, এটিকে আদৌ চলচ্চিত্র বলা চলে কি না।

চলচ্চিত্রটির প্রথম যে দুটি বিষয়, নেতিবাচক অর্থেই, আকর্ষণ করে-- নাম ও পোস্টার; সঙ্গে ট্রেইলারকেও এই ব্র্যাকেটে রাখা যেতে পারে। চলচ্চিত্রটির নাম হিসেবে যে শব্দ চয়ন করা হয়েছে, সেটি বলিউডের কল্যাণে বাঙালির কাছে সুপরিচিত হলেও, সুবোধ্য নয়। ‘দাবাং’ বললে বাঙালি দর্শকের মনে সালমান খান অভিনীত সিনেমার কথাই মনে হয়, কোনো পৃথক অর্থ দ্যোতিত হয় না। উপরন্তু সিনেমাতেও দাবাং বলে বিশেষ তো নয়ই, কোনো কিছুরই উল্লেখ নেই। আচমকা কেন চলচ্চিত্রটি দাবাং নাম পরিগ্রহ করল, তা এক রহস্য।

উপর্যুপরি রহস্য, সিনেমাটির পোস্টার কেন বাংলা সিনেমার অন্ধকার যুগের স্মৃতিতে ভাস্বর করে বানানো হয়েছে, যেগুলো দেখলেই মনে হয় অশ্লীল কিংবা বিশেষ রংয়ের বিশেষ ঘরানার চলচ্চিত্রের পোস্টার। পোস্টারগুলোতে সিনেমার মেয়েদের ছবিই মুখ্য হয়ে উঠেছে এবং সেই ছবিগুলো সিনেমার বিভিন্ন গান থেকে বাছাইকৃত উত্তেজক ছবি। সব মিলিয়ে পোস্টারগুলো বর্তমান চলচ্চিত্রের পোস্টার বলে মনে তো হয়ই না, মানতেও কষ্ট হয়। বিশেষত আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প সে অন্ধকার যুগ পেরিয়ে যে আশা জাগানিয়া পথে হাঁটছে, সে চলার প্রতি এই পোস্টার যেন এক বিরাট উপহাস। আর পোস্টারগুলোতে একটি বিশাল ত্রুটিও রয়েছে; পোস্টারগুলো যে-ই দেখবে, পার্শ্বনায়ককেই নায়ক ভেবে বসবে। কাউকে যদি নায়ক বানানোর ইচ্ছা থাকেই, তাকে পোস্টারের নায়ক না বানিয়ে সিনেমাতেই নায়ক বানানো উচিত। নায়কচরিত্র যে কোনোভাবেই কুচ্ছিতদর্শন হতে পারে না, এমন কোনো ধারা চলচ্চিত্রের আইনে নেই। চাইলে এমন চলচ্চিত্রের অসংখ্য উদাহরণও দেওয়া সম্ভব।

চলচ্চিত্রটির কাহিনি আহামরি কিছু নয়; এক শহরে থাকে এক ডন, হিটলার খান (অমিত হাসান)। সে শহরের মানুষদের অনেক অত্যাচার করে (যদিও অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায় মনে হয়, সবাই স্বপ্রণোদিত হয়েই অত্যাচারিত হয়)। তাকে প্রতিরোধ করতে উত্থান ঘটে নায়কের, ‘আজাদ দ্য গ্রেট’ (জায়েদ খান)। ডনের আছে এক ছোট ভাই, ওসমান খান (ডিজে সোহেল)। নায়কেরও আছে এক ছোট ভাই, রাজ (নাদিম)। সিনেমার শুরুতে মারা যায় পুলিশ অফিসার মাসুদ, যে ছিল সৎ-প্রতিবাদী পুলিশ অফিসার। ক্লাইমেক্স জমতে শুরু করে যখন আজাদ ওসমানকে মেরে ফেলে। বিনিময়ে হিটলারও মেরে ফেলে রাজকে। খবর পেয়েই কান্নাকাটি শেষ করে আজাদ ছুটে যায় প্রতিশোধ নিতে; রাজকে খাটিয়ায় তোলার আগেই হত্যা করে হিটলারের ডান হাতকে (সানু শিবা), গোর দেওয়ার আগে পাশেই খোড়া কবরে জ্যান্ত-কবর দেয় হিটলারকে। তখনই উপস্থিত হয় এক গাড়ি পুলিশ, (যদিও পুলিশের গাড়ির সঙ্গে দুইটি র‌্যাবের গাড়ির আসাও দেখানো হয় আগের সিকোয়েন্সে) নায়ককে পরায় হাতকড়া। ‘সমাপ্ত’ (নায়িকা রীতিমতো উপেক্ষিত)।

ক্রমানুসারে প্রথম পাঁচটি চরিত্রের বিপরীতেই নারী চরিত্র আছে। এবং পাঁচটি যুগলই তাৎপর্যপূর্ণ-- প্রতিটি যুগলের একটি করে গান আছে; সবগুলোই, কেবল উত্তেজক নয়, রীতিমতো রগরগে। ডন হিটলার দ্য ডেভিলের থাকে মুন্নি নামের রক্ষিতা; অবশ্য তার মূল দুই বডিগার্ডও নারী, তবে তাদের সঙ্গে ডনের সম্পর্ক নিষ্কাম। সিনেমায় একটাই প্রেম হয়, নায়ক আজাদ দ্য গ্রেটের সঙ্গে নায়িকা বুলবুলির প্রেম (নায়কের এক মারামারিতেই মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে যায় নায়িকা, কিংবা উপায়ান্তর না থাকায় নায়কের কাঁধে ঝুলে পড়ে)। নায়কের ভাই কাম বন্ধু কাম জীবন-মরণের পার্টনার রাজের প্রেমিকার নাম বিন্দিয়া। মাসুদ সিনেমার একমাত্র বিবাহিত পুরুষ, যদিও এক ছাদের নিচে বসবাস সকল যুগলেরই। আর ওসমানের বিপরীতে কোনো নারীচরিত্র নেই বটে, কিন্তু আদিরসাত্মক নৃত্য হতে সেও নয় বঞ্চিত; তার বিপরীতে গানের তাল-লয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন কিন্তু আকর্ষণীয় নৃত্য পরিবেশন করে বিপাশা, যে নিয়মিতই উপস্থিত থাকে আইটেম গানে। এটি যে সিনেমাটির আইটেম সং, তা চেনার জন্য বিপাশা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হলেও একমাত্র সূত্র নয়; সে জন্য আইটেম সংয়ের এই সূত্র মনে রাখলেই চলবে-- আইটেম গানে যে নারী নাচে, সে সাধারণত সিনেমায় অভিনয় করে না; এই সূত্রটি শিথিল করলে, সিনেমার প্রায় কোনো গানকেই আইটেম গানের কাতার থেকে সরানো যাবে না।

কাহিনির পাশাপাশি সিনেমাটোগ্রাফি, চিত্রনাট্য, সংলাপ, লোকেশন-নির্বাচন, সাজসজ্জা, সাউন্ড ডিজাইন ইত্যাদি প্রায় সবই আলোচনার অযোগ্য। কেবল অভিনয় মোটামোটি চলনসই। তবে সবচেয়ে বাজে ব্যাপারটি সিনেমার গানকেন্দ্রিক; হিন্দি গানের এতটাই অনুকরণ করা হয়েছে, সিনেমা শেষ হওয়ার পর গানের কলি হিসেবে মনে ‘মারহাবা মারহাবা’ গুনগুন করে না, গুনগুন করে ‘উলালা উলালা’। বলিউডের গানের বঙ্গানুবাদ বাংলা সিনেমায় নতুন নয়, হরহামেশাই হচ্ছে, স্বর্ণযুগের অনেক স্বর্ণোজ্জ¦ল গানের জন্মও এই প্রক্রিয়ায়; তবে তা এতটা শোচনীয়ভাবে হওয়া মোটেও কাম্য নয়। পুরো চলচ্চিত্রে নিদেনপক্ষে একটি সুস্থ-স্বাভাবিক মৌলিক গান অন্তত থাকা উচিত ছিল, যাতে মনে থাকে আমাদের চলচ্চিত্রে গানের আধিক্য মূলত এই কারণে যে, উপমহাদেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যই হল যে কোনো উপলক্ষ্যে বা আবেগে গীতের আশ্রয় নেওয়া; স্থ’ূল আনন্দের আস্বাদ গ্রহণ গানের মূল উদ্দেশ্য নয়।

‘উলালা উলালা’ ছাড়াও সিনেমাটিতে অনুকৃত হয়েছে এই গানগুলোও-- ‘আজা কারলে রোম্যান্স’, ‘ভানা ভানা বিল্লু বাই’।

সিনেমাটিতে প্রত্যক্ষ অশ্লীলতাও ব্যাপ্ত মূলত এই গানগুলোতে। গানগুলোর কোরিওগ্রাফি রীতিমতো রগরগে। আজাদ-বুলবুলির এবং ডিজে সোহেল-বিপাশার (আইটেম গান) গান দুটি অপেক্ষাকৃত কম রগরগে, সেগুলোকে রগরগে না বলে আকর্ষণীয়ও বলা যেতে পারে। নায়িকার গানে রগরগে দৃশ্য না রাখাটা পুষিয়ে নেওয়া হয়েছে তার পোশাক পরিকল্পনায়। নায়িকা নিজের বাসায় যে পোশাকে থাকে বলে দেখানো হয়েছে, তা বাংলাদেশি নারীর পোশাক বলে চেনাই দুষ্কর (যদিও ঘরের ভেতরের দৃশ্য এবং উঠোনের দৃশ্য পরিমাণে সমান, সমান্তরালে উঠোনের দৃশ্য এবং ঘরের ভেতরের দৃশ্য এক বাসার বলে সাক্ষ্যও দেয় না)। সিনেমায় নায়িকার আবির্ভাবও সেই পোশাক পরেই, যদিও সেটা ছিল সাগরসৈকতের দৃশ্য, এবং সেই সিকোয়েন্সে নায়িকা এক বান্ধবী-সহকারে জলকেলিতে মত্ত হয়ে পড়ে (পরবর্তীতে এই বান্ধবীকে অবশ্য আর খুঁজে পাওয়া যায়নি)। এর বাইরেও কিছু রগরগে দৃশ্য আছে, মূলত ডন হিটলারের রক্ষিতা কেন্দ্রিক। এই দৃশ্যগুলোতে রুচিগত স্খলন ঠেকানো গেলে সম্ভবত রগরগে দোষও এড়ানো যেত। আর যাবতীয় ‘দুষ্টু’ ফ্রেমে স্লো মোশনে চলে যাওয়াটাও বেশ সুড়সুড়িদায়ক।

তবে প্রত্যক্ষ অশ্লীলতার চেয়ে অধিক প্রকট নৈতিক বা মানসিক অশ্লীলতা। বাণিজ্যিক ঘরানার অধিকাংশ সিনেমায় এখনও নায়ক চরিত্রকে বীররসম-িত করেই গড়ে তোলা হয়। ফলে চরিত্রের নৈতিকতার ঝোঁকও ইতিবাচক রাখা হয়। এই সিনেমাতেও নায়ক বীররসম-িত, এবং নৈতিক ঝোঁক ইতিবাচক। কেবল নায়ক-পার্শ্বনায়কের প্রেমজীবন ছাড়া। তারা দুজনই নায়িকাসহ একই বাসায় থাকে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে নায়ক-পার্শ্বনায়ককে এমন জীবনে ঠেলে দিলে, তার জন্য উপযুক্ত প্রেক্ষাপট কিংবা দ্বন্দ্ব নির্মাণ করা অত্যন্ত জরুরি, যার ছিটেফোঁটাও ছিল না সিনেমাতে। বিবাহবন্ধন ছাড়াই নায়ক-নায়িকারা নির্বিকারভাবে বিবাহিত যুগলের মতো নির্বিঘেœ যৌথজীবন যাপন করে যায় আদ্যন্ত। এই প্রেক্ষাপট কিংবা দ্বন্দ্ব নির্মাণের উৎকৃষ্ট নিদর্শন আছে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’-এ।

আবার মৃত স্বামীকে ঘিরে বিধবা নারীর কামাবেগ নির্মম সত্য। কিন্তু সেই কামাবেগের স্থ’ূল প্রকাশ কতটা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য, এবং সেই প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ‘উলালা উলালা’ গানের নি¤œমানের অনুকরণ রুচির কোন পর্যায়ের স্বাক্ষ্য দেয়, তাও বিবেচ্য।

সব মিলিয়ে সিনেমাটিকে ‘অশ্লীল’ অভিধায় অভিহিত করাটা তর্কসাপেক্ষ হলেও, কিছু অতি-রগরগে দৃশ্যায়ন এবং এই নৈতিক বিষয়গুলো সেন্সর বোর্ডের চোখ কিংবা কাঁচি কীভাবে এড়িয়ে গেল, তা চিন্তার বিষয়। সমান্তরালে সেন্সর বোর্ডকেও চিন্তার খোরাক হিসেবে কেউ বেছে নিলে আপত্তি করাটা মুশকিল হয়ে পড়ে। আর ‘দাবাং’ নামের এই সিনেমাকে ‘অশ্লীল’ বলাটা যতটা তর্কসাপেক্ষ, একে ‘চলচ্চিত্র’ বলে মেনে নেওয়াটা তারচেয়ে কম তর্কসাপেক্ষ নয়। ছাড়পত্র দেওয়ার আগে এই বিষয়ও সেন্সর বোর্ডের বিবেচনা করা উচিত-- তারা যে চলমান দৃশ্যাবলি সিনেমা হলে দেখানোর অনুমতি দিচ্ছেন, সেটি শেষ পর্যন্ত ‘চলচ্চিত্র’ হয়ে উঠেছে কি না।

যে কোনো চলচ্চিত্রের বাজারের ক্ষেত্রেই এটা সত্য যে, সকল চলচ্চিত্রের মান একই হয় না। আর সে কারণে চলচ্চিত্রের ‘বি-গ্রেড’, ‘সি-গ্রেড’ ইত্যাদি শ্রেণিকরণ করা হয়। এই শ্রেণির চলচ্চিত্রগুলোর মূল বৈশিষ্ট্যই হয় কম বাজেট, কিছুটা আদিরসাত্মক, স্থ’ূল কৌতুক ইত্যাদি। এই চলচ্চিত্রগুলোকে মেরে না ফেলে এদের প্রচার-প্রসার সীমিত করার জন্য বিভিন্ন দেশে সেন্সরের বিভিন্ন প্রক্রিয়াও থাকে, থাকে নানা বাধ্যবাধকতা। আমাদের দেশে এখনও তেমন প্রক্রিয়া গড়ে ওঠেনি। তারচেয়ে বড় বিষয় হল, এই ধরনের সিনেমাগুলোকে স্থান করে দেওয়ার মতো প্রদর্শন ও প্রচারের অবকাঠামোও আমাদের দেশে এখন নেই। কাজেই এটি বিবেচনা করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে যে, আমাদের বাজারে এই ধরনের দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণির চলচ্চিত্রকে জায়গা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কি না। আর যদি তা রাখতেই হয়, তার প্রচার-প্রসার সীমিত করার প্রক্রিয়াটা কেমন হতে পারে, সেটি নির্ধারণ করাটা রীতিমতো আবশ্যক।

বছরের প্রথম ছবিটি রীতিমতো লজ্জাজনক হলেও, আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের বাস্তবতার নিরিখে এটা আশা করা যায়, বছর শেষে আমরা বলতে পারব, সকাল সব সময় দিনের পূর্বাভাস দেয় না।