অসীম দরিয়ার যাত্রী আবদুল জব্বার

স্বর্ণকণ্ঠে যিনি উচ্চারণ করেছিলেন ‘ওরে নীল দরিয়া’ সেই শিল্পী আবদুল জব্বার আজ অসীম মরণ সাগরের যাত্রী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার ভরাট কণ্ঠে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ কিংবা ‘বাংলার স্বাধীনতা আনলো কে’ যখন ভেসে আসতো তখন এদেশের যুদ্ধরত মুক্তিসেনার বুকের রক্ত অনুপ্রাণিত হয়ে উঠতো আত্মত্যাগে। আবদুল জব্বারের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নিভে গেল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আরেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2017, 04:32 AM
Updated : 31 August 2017, 06:08 AM

আবদুল জব্বার ছিলেন এদেশের জনপ্রিয় প্লেব্যাক শিল্পী এবং স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রধান শিল্পী। তিনি একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকে সম্মানিত শিল্পী।

আবদুল জব্বারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলায়। বাউল-বৈষ্ণবের দেশ কুষ্টিয়ার উদার প্রাকৃতিক পরিবেশে কেটেছে শৈশব। লালন সাঁইয়ের দেশ কুষ্টিয়ার নদীর ঢেউ আর প্রাণখোলা বাতাসেই যেন রয়েছে সুরের ছোঁয়া। আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে সেই সুরেরই স্পর্শ ছিল।

মায়ের অণুপ্রেরণায় ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। অষ্ঠম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন কুষ্টিয়ায় মহম্মদ ওসমানের কাছে গান শিখতে শুরু করেন। এরপর মকসেদ আলী সাঁই ও লুৎফেল হকের কাছেও গানের তালিম নেন।

ওপার বাংলার উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পী শিবুকুমার চ্যাটার্জীর কাছে গান শিখতে কৈশরে দেশমাসের জন্য কলকাতায় ছিলেন আবদুল জব্বার। ১৯৫৭ সালৈ একটি বিচিত্রানুষ্ঠানে তার কণ্ঠে নজরুল সংগীত ‘ঘুমিয়ে আছো বুলবুলি গো মদিনার গুলবাগে’ গানটি শুনে ঢাকা বেতারের গীতিকার আহিজুর রহমান তাকে রাজধানীতে নিয়ে আসেন। ১৯৫৮ সাল থেকে বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি।

বেতারেই তার কণ্ঠে নজরুল সংগীত শুনে সংগীত পরিচালক রবীন ঘোষ তাকে সিনেমায় প্লেব্যাকের প্রস্তাব দেন। এহতেশাম পরিচালিত ও রবীন ঘোষ সুরারোপিত ১৯৬২ ‘নতুন সুর’ সিনেমার মাধ্যমে নেপথ্য শিল্পী হিসেবে অভিষেক ঘটে তার। দুই বছর পরে বিটিভিতেও নিয়মিতভাবে গান গাইতে শুরু করেন তিনি।

১৯৬৪ সালে জহির রায়হানের সংগম ছবিতে প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন আবদুল জব্বার। বিটিভির জন্মলগ্ন থেকে তিনি ছিলেন এর নিয়মিত গায়ক।  ১৯৬৮ সালে মুক্তি পায় ‘এতটুকু আশা’।  এ ছবিতে সত্য সাহার সুরে ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পান আবদুল জব্বার। পর্দায় গানটির দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন শক্তিমান অভিনেতা আলতাফ হোসেন। বাংলা ছবির পুরানো দিনের দর্শকরা আজও এই গানটি স্মরণ করেন বেদনায় ও পুলকে।

১৯৬৮ সালে মুক্তি পায় ‘পীচ ঢালা পথ’। এ ছবিতে ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ‘পীচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতা দর্শকদের মন জয় করে নেন আবদুল জব্বার। গানটির সুরকার ছিলেন রবীন ঘোষ। একই বছর মুক্তি পাওয়া ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’ ছবিতেও প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন তিনি। এ ছবিতে ‘সুচরিতা যেও নাকো’ গানটির মাধ্যমে রোমান্টিক গায়ক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পান তিনি। গানটির সুরকার ছিলেন রাজা হোসেন খান।

আবদুল জব্বার এদেশের অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে তার বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সংগম’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, ‘উলঝন’, ‘পীচ ঢালা পথ’, ‘এতটুকু আশা’, ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’, ‘ভানুমতি’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘বিনিময়’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘নাচের পুতুল’, ‘মানুষের মন’, ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘ঝড়ের পাখি’, ‘আলোর মিছিল’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘তুফান’, ‘অঙ্গার’, ‘সখী তুমি কার’, ‘কলমীলতা’ ইত্যাদি। তিনি এদেশের শীর্ষ স্থানীয় নায়কদের মধ্যে রাজ্জাক, ফারুক, উজ্জ্বলসহ অনেকেরই প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন।

তবে চলচ্চিত্রের গানের মধ্যে তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গানটি হলো ‘ওরে নীল দরিয়া’। শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭৮ সালের ‘সারেং বউ’ ছবিতে আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায়, আলম খানের সুরে গান করেন আবদুল জব্বার। এই ছবিতে প্রবাসী এক নাবিকের ভূমিকায় ছিলেন ফারুক। কদম সারেংরূপী ফারুকের নিজের দেশের প্রতি মমতা, বাড়িতে রেখে যাওয়া স্ত্রীর প্রতি আকুলতা ফুটে ওঠে ‘ওরে নীল দরিয়া গানে’। কণ্ঠের জাদুতে এই আবেগকে রূপায়িত করেন আবদুল জব্বার।

ষাটের দশকের শেষ দিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবিরা গ্রেপ্তারের সময় থেকে প্রতিবাদী গণসংগীতে কণ্ঠ দিতে থাকেন আবদুল জব্বার। ওই সময় থেকেই স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতে থাকেন তিনি। ওই সময় প্রতিবাদী গান ‘তুমি কি দেখেছো বন্ধু আইয়ূবের পরাজয়’, ‘শহরবাসী শোন’, ‘তোমরা যাদের মানুষ বলনা’র মতো গানগুলোর মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এই সময় থেকেই মুজিব পরিবারের সঙ্গেও ঘণিষ্ঠতা বাড়তে থাকে তার।

১৯৬৯ সালে ‘বিমূর্ত’ নামের একটি সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। একই সময়ে তিনি গঠন করেন ‘বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠী’, যার সভানেত্রী ছিলেন বেগম মুজিব।

কলকাতার তৎকালীন মাসিক পত্রিকা প্রসাদ-এর সংস্কৃতি সম্পাদক আশীষ চট্টোপাধ্যায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবদুল জব্বার শুানয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় তার একজন শব্দসৈনিক হয়ে ওঠার পেছনে বঙ্গবন্ধুর অণুপ্রেরণার কথা।

তিনি বলেছিলেন, ২৪ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় আবদুল জব্বারের। বঙ্গবন্ধু তখন তাকে বলেছিলেন, “সাবধানে থেকো, অনেক কাজ আছে তোমার।”

২৫ মার্চের পর স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে আগরতলায় রওনা দেন আবদুল জব্বার। সেখানে পৌঁছে দেখা পান আপেল মাহমুদের। এরপর মুজিবনগরে পৌঁছে তারা যোগদান করেন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে। পরবর্তী নয়মাসে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’,‘অনেক রক্ত দিয়েছি মোরা’, ‘আমি এক বাংলার মুক্তিসেনা’, ‘বাংলার স্বাধীনতা আনলো কে- মুজিব মুজিব’ নামের গানগুলো দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দেওয়ার কাজ করে গেছেন তিনি।

দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এছাড়াও জহির রায়হান স্মৃতি পদকসহ আরও অনেক পুরস্মকার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।  

২০১৭ সালে মুক্তি পায় আবদুল জব্বারের প্রথম মৌলিক গানের অ্যালবাম ‘কোথায় আমার নীল দরিয়া’। অ্যালবামটির গীতিকার মো. আমিরুল ইসলাম এবং সুরকার গোলাম সারোয়ার।

আবদুল জব্বার দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন।  অসুস্থতাকালীন সময়ে বারবার তিনি আকুতি জানিয়েছেন, “আমি বাঁচতে চাই!”। প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে এইসময়ে অনুদানের মাধ্যমেও চিকিৎসা সহায়তা করা হয় তাকে।

অবশেষে ৭৯ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজীব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের চিরসবুজ গানের তালিকায় চিরদিনই রয়ে যাবে তার গাওয়া ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘বাংলার স্বাধীনতা আনলো কে’ , ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘তুমি কি দেখেছ কভু’ সহ অনেক গান। তিনি বাংলা গানের শ্রোতার হৃদয়ে চিরদিনই রয়ে যাবেন আপন মহিমায়।