পশ্চিমবঙ্গের সিনেমায় রাজ্জাক

২১ অগাস্ট অগণিত ভক্তকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন বাংলা ছবির চিরসবুজ অভিনেতা রাজ্জা্ক। এই প্রতিবেদনে ‘নায়করাজ’ রাজ্জাকের পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর কথা।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 August 2017, 03:54 PM
Updated : 22 August 2017, 03:54 PM

দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জে জন্ম নেন ঢাকাই ছবির সোনালি যুগের অন্যতম সফল অভিনেতা রাজ্জাক। পশ্চিমবঙ্গে জন্ম হলেও তার ‘মহানায়ক’ হয়ে ওঠার শুরু ঢাকাই সিনেমার কল্যাণে। পরবর্তীতে, বলা যেতে পারে শেষ বয়সে, বেশ কিছু সাড়াজাগানো কলকাতার সিনেমায় দেখা গেছে সদ্যপ্রয়াত এ অভিনেতাকে। কলকাতার সিনেমায় নায়করাজের অভিষেক, উত্থান ও সাফল্য নিয়ে সাজানো হয়েছে এ বিশেষ প্রতিবেদন।

অভিনয়ের শুরু ও পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠালাভে ব্যর্থতা:

পশ্চিমবঙ্গের টালিগঞ্জের নাকতলা’য় জন্ম নেন ঢাকাই ছবির স্বর্ণযুগের মহাতারকা রাজ্জাক। পুরো নাম আব্দুর রাজ্জাক, তবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে শুধুই রাজ্জাক বা ‘নায়করাজ’ হিসেবেই পরিচিত তিনি। টালিগঞ্জে জন্ম নিলেও অভিনেতা হিসেবে সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি।

কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সরস্বতী পূজার অনুষ্ঠানের নাটক ‘বিদ্রোহী’ দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করেন রাজ্জাক। কলেজে পড়াকালীন সময়ে ‘রতন লাল বাঙ্গালি’ সিনেমা দিয়ে প্রবেশ করেন টালিগঞ্জের রূপালি দুনিয়ায়। ‘পঙ্কতিলক’ ও ‘শিলালিপি’ নামের কলকাতার আরও দু’টি সিনেমাতেও নাম লেখান তিনি। তবে সে সময় পশ্চিমবঙ্গে চলছিলো উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জয়জয়াকার। তাদের দাপটে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি রাজ্জাক।

ঢাকাই ছবিতে অভিষেক ও খ্যাতির শীর্ষে আরোহন:

১৯৬৪ সালে কলকাতার ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় দিশেহারা হয়ে পড়েন রাজ্জাক ‍ও তার পরিবার। অনেকটা উদ্বাস্তু হয়েই সপরিবারে তাকে চলে আসতে হয়েছিলো বাংলাদেশে। রাজ্জাক তখন বিবাহিত। স্ত্রীর উৎসাহেই এ সময় আবারও নতুন করে অভিনয়ের দিকে মনোযাগী হন তিনি।

ঢাকাই চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা পেতেও রাজ্জাককে সংগ্রাম কম করতে হয়নি । ছোটখাট টিভি নাটকে অভিনয় করে কষ্টে চলছিলো দিন। এমন সময়ই একদিন ডাক পান প্রতিভাবান তরুণ পরিচালক জহির রায়হানের। তবে অভিনয়ের জন্য নয়, সহকারী পরিচালক হিসেবে। সানন্দেই তাতে রাজি হয়ে যান রাজ্জাক। পরবর্তীতে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ সিনেমার মাধ্যমেই ঢাকাই ছবির রূপালি জগতে প্রবেশ করেন তিনি।

১৯৬৬ সালে সুচন্দার বিপরীতে ‘বেহুলা’ দিয়ে ঢালিউডে অভিষেক ঘটে রাজ্জাকের। প্রথম ছবিতেই ‘লখিন্দর’ চরিত্রে বাজিমাৎ করে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তিনি। সে সময় হঠাৎ করেই পাকিস্তানে পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা আনা বন্ধ করে দেয় সরকার। ফলে রাজ্জাকের ভেতরেই কলকাতার জনপ্রিয় নায়ক উত্তম কিংবা সৌমিত্রের ছায়া খুঁজতে থাকেন পূর্ববঙ্গের দর্শক। অনেকেই তাকে তুলনা করতেন কলকাতার জনপ্রিয় নায়ক বিশ্বজিতের সঙ্গে।

আবার পশ্চিমবঙ্গের ডাক:

বাংলাদেশের মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে আপ্লুত রাজ্জাক নানা সময়ে সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন তার কৃতজ্ঞতার কথা। নব্বইয়ের দশকের পার থেকে ঢাকাই চলচ্চিত্রকে প্রবেশ করতে থাকে অশ্লীলতা। এ সময় নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নেন রাজ্জাক। 

রাজ্জাক পরিচালিত দ্বিতীয় সিনেমা ‘বাবা কেন চাকর’ দিয়ে দীর্ঘিদিন পর আবারও পশ্চিমবঙ্গের দর্শকের সামনে উপস্থিত হন রাজ্জাক। অঞ্জলি ফিল্মস প্রযোজিত এ সিনেমাটি ১৯৯৮ সালে যৌথভাবে মুক্তি পায় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে। এরপর কলকাতার বেশ কিছু সিনেমায় ডাক পান রাজ্জাক। এর মধ্য উল্লেযোগ্য - ‘অন্নদাতা’ (২০০২), ‘হিরো’ (২০০৬), ‘এরই নাম প্রেম’ (২০০৬), ‘জন্মদাতা’ (২০০৮)।

‘বাবা কেন চাকর’: একটি সফল পারিবারিক  সিনেমার গল্প

রাজ্জাক পরিচালিত ‘বাবা কেন চাকর’ নানা কারণেই আলোচিত। বাংলা ছবির ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল এ সিনেমাটি নিয়ে হয়েছে নানা গবেষণা।

পরিবারের চাপে পড়ে এক সময়ের দাপুটে গৃহকর্তার সংসারে গুরুত্ব হারানোর করুণ গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘বাবা কেন চাকর’ সিনেমাটি। সামাজিক গল্পনির্ভর এ সিনেমায় বাবা’র চরিত্রে রাজ্জাকের অনবদ্য অভিনয় আজও মনে রেখেছে দর্শক। এ ছবির মাধ্যমে প্রায় চার দশক পর কলকাতার পর্দায় উপস্থিত হন রাজ্জাক।

বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন রাজ্জাক। প্রথম জীবনের মতো এবার আর হোঁচট খেতে হয়নি তাকে। তখন বাংলাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গেও সুপরিচিত তিনি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনীত এ সিনেমাটি তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিলো দুই বাংলাতেই।

টালিগঞ্জে নায়করাজের  উত্থান ও সাফল্য:

‘বাবা কেন চাকর’এর পর ‘অন্নদাতা’, ‘জন্মদাতা’ এ সিনেমাগুলো দিয়েও দর্শক মাতিয়েছেন রাজ্জাক। অনেকটা ‘বাবা কেন চাকর’এর অনুকরণেই এ সিনেমাগুলোতেও বাড়ির প্রভাবশালী গৃহকর্তার চরিত্রেই দেখা গেছে রাজ্জাককে। এর মধ্যে ‘হিরো’ ও ‘এরই নাম প্রেম’ সিনেমাগুলো ছিলো কিছুটা ব্যতিক্রম।

‘বাবা কেন চাকর’এর পর বলিউড তারকা অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গেই অনেকে তুলনা করেছেন রাজ্জাককে। শেষ বয়সের সিনেমার প্রধান চরিত্রে বয়স্ক কোনো মহানায়কের সাহসী ও প্রাণবন্ত উপস্থিতি- বলা যেতে পারে রাজ্জাকেরই প্রচলন। এমনকি উত্তমকুমার কিংবা সৌমিত্রও সে সাহস দেখাননি কখনও। এদিক দিয়ে মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে রাজ্জাকের কিছুটা মিল পাওয়া যেতে পারে।

টালিগঞ্জের রূপালি দুনিয়ায় নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা না পেলেও অভিনয়শিল্পী হিসেবে পেয়েছিলেন জনপ্রিয়তা। চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নায়ক-নায়িকার বাবা কিংবা প্রথাগত পার্শ্ব-অভিনেতার প্রথা ভেঙে সম্পুর্ণ নতুন অবতারেই হাজির হন রাজ্জাক। চরিত্রপ্রধান সিনেমায় গুরুত্ব ও অভিনয়ে স্বকীয়তার মধ্য দিয়েই নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন তিনি।