নায়করাজ যখন নির্মাতা

দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে কেবল নায়করাজ হিসেবেই নন রাজ্জাক পরিচিত ছিলেন একজন সফল প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবেও। স্ত্রী খায়রুন্নেসা, ভালোবেসে যাকে তিনি ‘লক্ষ্মী’ বলে ডাকতেন, তার নামে ১৯৭৩ সালে নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘রাজলক্ষ্মী প্রডাকশন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে ২০ টির বেশি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন রাজ্জাক, যার মধ্যে ১৮ টির পরিচালক ছিলেন তিনি নিজেই।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 August 2017, 12:59 PM
Updated : 22 August 2017, 12:59 PM

‘রংবাজ’ দিয়ে শুরু

‘বেহুলা’ ছবির মাধ্যমে জহির রায়হান উপহার দিয়েছিলেন রাজ্জাক নামের এক সুপুরুষ তরুণকে, রোমান্টিক হিরোর ইমেজ ব্যবহার করে পরবর্তী এক দশক যিনি একাই শাসন করেছিলেন ঢাকার চলচ্চিত্র। কিন্তু মিষ্টি প্রেমের ছবিতে সেই একই রাজ্জাক-কবরী জুটির রসায়ন যখন পানসে হওয়ার পথে, তখন ‘রংবাজ’ খুলে দিলো নতুন এক দিগন্ত।

১৯৭৩ সালে এই ‘রংবাজ’ সিনেমা দিয়েই প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন রাজ্জাক। ভিন্নধর্মী গল্পের এই সিনেমার জন্য নিজেকে যেন নতুনভাবে গড়েছিলেন তিনি।

চলচ্চিত্র সমালোচক চিন্ময় মুৎসুদ্দি এব্যাপারে বলেন, “প্রযোজক হিসেবে রাজ্জাক আমাদের এখানকার ট্র্যাডিশনকে ব্রেক করেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে উনার প্রযোজিত ও জহিরুল হক পরিচালিত ‘রংবাজ’ সিনেমাটির মাধ্যমে প্রথম ঢাকাই ছবিতে অ্যাকশনের প্রচলন হলো। এবং এই ধারা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঢাকাই সিনেমার পরিচালকেরা ফলো করেছিলেন।”

‘রংবাজ’ দিয়ে যে পথচলার শুরু হয়েছিল রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন্সের, সেই পথে চলতে চলতে প্রযোজক রাজ্জাক জন্ম দিয়েছেন আরও অনেক আলোচিত ছবির। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বদনাম’, ‘প্রফেসর’, ‘পাগলারাজা’, ‘ঢাকা ৮৬’, ‘রাজামিস্ত্রি’র মতো বাণিজ্যিকভাবে সফল সিনেমাগুলো।

প্রযোজনা থেকে পরিচালনায়

নিজের প্রথম প্রযোজিত সিনেমার চার বছর পর প্রথমবারের মতো নির্মাতা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন রাজ্জাক। ১৯৭৭ সালের ছবি ‘অনন্ত প্রেম’। এবার আর কবরী নয়, ভিন্নধর্মী প্রেমের গল্পের জন্য রাজ্জাক বেছে নিলেন গ্ল্যামারাস অভিনেত্রী ববিতাকে।

রাজ্জাকের প্রথম পরিচালিত এই সিনেমা অমর হয়ে আছে একটি বিখ্যাত চুমুর দৃশ্যের জন্য। ঢাকাই চলচ্চিত্রে কেউ এর আগে যা কখনও করেনি, সেই সাহস সিনেমা নির্মাণকালে দেখিয়েছিলেন রাজ্জাক। সিনেমার শেষ দৃশ্যে ববিতার সঙ্গে একটি আবেগঘন চুম্বনদৃশ্যের শুটিং করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহসটিকে দুঃসাহসে পরিণত করতে পারেননি। সিনেমা মুক্তির সময় দৃশ্যটিকে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।

নির্মাতা রাজ্জাক সম্পর্কে চিন্ময় মুৎসুদ্দির মূল্যায়ন, “পরিচালক হিসেবে রাজ্জাক আমাদের এখানে ফিল্মের যে ন্যাচারাল ট্রেন্ড, সেটাকেই ফলো করেছেন। কিছুটা যাত্রাধর্মী, কিছুটা ড্রামাটাইজেশন, ওভার অ্যাক্টিং, সামাজিক বার্তা- এই ধরণের ট্র্যাডিশনাল ঢাকাই ছবির উপাদান তিনি বর্জন করেননি।। ফিল্মের যে লো ভয়েজ ল্যাঙ্গুয়েজ, সেটা উনার ছবিতে কখনো ছিল না। কিন্তু দর্শক যে ধরণের ড্রামা পছন্দ করে, যা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়- সেই ধরণের উপাদান ও সামাজিক বার্তা তার ছবিতে পাওয়া যেত। ফলে দর্শক খুব সহজেই তার সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারতেন এবং তার সিনেমাগুলো দারুণ হিট হতো।”

এই বক্তব্যকে সমর্থন করে তার পরিচালিত ‘চাঁপাডাঙার বউ’ সিনেমাটির অভাবনীয় সাফল্য। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের  সাহিত্যকর্মকে এদেশীয় দর্শকের জন্য পর্দায় তুলে আনার কঠিন কাজটি তিনি করেছিলেন সফলভাবেই। এই সিনেমার মাধ্যমেই পর্দায় অভিষেক ঘটেছিল আশির দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাসের। নিজের বড় ছেলে বাপ্পারাজেরও অভিষেক ঘটে এই সিনেমাতেই।

রাজ্জাক পরিচালিত আরেকটি সফল সিনেমা ‘বাবা কেন চাকর’।সময়টা তখন নব্বইয়ের দশকের শেষ; ঢাকাই চলচ্চিত্রে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে অশ্লীলতার দূষিত স্রোত। এই স্রোতে গা না ভাসানো রাজ্জাক বহুদিন পরে নিজের নির্মাণে উপহার দিলেন এমন এক সিনেমার, যা পরিবারের সবাই মিলে উপভেঅগ করার মতো। আর সেকারণেই সুপারহিট ব্যবসা করে সিনেমাটি।

যৌথপ্রযোজনার এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ, অমিত হাসান, বাপ্পারাজদের মতো তরুণেরা। কিন্তু তাদেরকে ফেলে সব আলো একাই কেড়ে নেন রাজ্জাক। আরও একবার বুঝিয়ে দেন, কেন তিনি নায়করাজ।

রাজ্জাক পরিচালিত অন্য সিনেমাগুলি হলো ‘অভিযান’, ‘জ্বিনের বাদশা’, ‘মৌচোর’, ‘মরণ নিয়ে খেলা’, ‘আমি বাঁচতে চাই’, ‘কোটি টাকার ফকির’, ‘মন দিয়েছি তোমাকে’ ও ‘আয়না কাহিনি’। 

এরমধ্যে ‘মন দিয়েছি তোমাকে’ সিনেমার মাধ্যমে পর্দায় অভিষেক ঘটে তার ছোট ছেলে সম্রাটের।

গত কয়েকবছর ধরেই শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন রাজ্জাক, ২০১৩ সালের পর আর সিনেমা নির্মাণে হাত দেননি। তবে নিজের ৭৩ তম জন্মদিনেও আশাব্যক্ত করেছিলেন সুস্থধারার আরও চলচ্চিত্র নির্মাণের।

সেই স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই চিরতরে বিদায় নিলেন তিনি।