জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান জুনায়েদ আহমেদ হালিম মনে করেন, রোমান্টিক তরুণ হিসেবে দর্শকরা এতদিন তাকে যেভাবে দেখেছে সেখানে রংবাজে রাজ্জাক তার ইমেজ ইম্প্রোভাইজ করেছেন অ্যাকশন ছবিতে।
তার মতে, স্বাধীনতা উত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ধারণ করেছিল সেই চরিত্র। তাতেই সাড়া ফেলেন রাজ্জাক।
জুনায়েদ হালিমের মতে, ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রাণপুরুষই ছিলেন রাজ্জাক। ১৯৫৭ সালে ঢাকাই চলচ্চিত্রের অভিষেকের পর উর্দু ছবির সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে জহির রায়হানের মতো নির্মাতারাও উর্দু ছবি বানান। সেই সময় রাজ্জাকের অভিষেক জিয়নকাঠির মতো বাংলা চলচ্চিত্রকে জাগিয়ে তোলে।
১৯৬৫ সালে বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোতে কলকাতার ছবি মুক্তি পাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। উত্তম-সুচিত্রা আর সৌমিত্রে বুঁদ হয়ে থাকা পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত বিকল্প খুঁজে পেলেন রাজ্জাকে। তিনি হয়ে উঠলেন ঢাকাই ছবির ‘স্ক্রিন আইডল’। কলকাতার বচন আর বাচন নিয়ে ঢাকাই সিনেপাড়ায় একাধারে শাসন করলেন দুই দশক। নায়ক হিসেবে।
জুনায়েদ হালিম রাজ্জাকের অভাবিত বাণিজ্যিক সফলতার পেছনে তার বিশেষ অভিনয়গুণের কথা বললেন। তার মতে, রাজ্জাকের অভিনয় অতিমাত্রায় উচ্চকিত যেমন ছিল না আবার তেমনি খুব বাস্তবিক যেটা বলে সেটাও ছিল না। এর মধ্যেই এই দুয়ের মিশেলে তা ছিল বিশেষ।
প্রযোজক,পরিচালক ও চলচ্চিত্রে শুদ্ধিকরণের আন্দোলনে তার ভূমিকা সবমিলিয়ে রাজ্জাকের জীবনকালকে টোটাল সিনেমা পারসোনালিটি হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন তিনি।
অভিনয়ের জন্য রাজ্জাক পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় তাকে। ২০১৫ সালে তিনি পান স্বাধীনতা পুরস্কার।
অভিনয় জীবনের বাইরে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করেন রাজ্জাক।
বদনাম, সৎ ভাই, চাপা ডাঙ্গার বউসহ প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন রাজ্জাক। তার মালিকানার রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন থেকে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনে চিরসবুজ নায়ক হিসেবেই যে রাজ্জাক রয়েছেন, যা হালের অভিনেতা রিয়াজের কথায়ও স্পষ্ট।
“নায়করাজকে আমরা সবাই এখনও ফলো করি। তার কথা বলার স্টাইল, অভিনয়- সব কিছুই আমরা ফলো করি। তাকে দেখে বড় হয়েছি, তাকে ফলো করেই আমরা অভিনয় শিখেছি।”
রাজ্জাকের জন্ম বাংলাদেশে নয়, অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়; তার পারিবারিক বাসস্থান ছিল টালিগঞ্জের নাকতলায়।
সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় স্বরস্বতী পূজা উপলক্ষে স্কুলের নাটকে প্রথম অভিনয় রাজ্জাকের। এরপর কলেজে পড়ার সময় তিনি ‘রতন লাল বাঙালি’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখেন।
পাঁচশ চলচ্চিত্রের অভিনেতা রাজ্জাকের অভিনয় জীবন শুরুতে মোটেও মসৃণ ছিল না। তীব্র জীবন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।
নায়ক হওয়ার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে মুম্বাই গিয়ে সিনেমা বিষয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। মুম্বাই থেকে ফিরে তিনি কলকাতার ‘পংকতিলক’ ও ‘শিলালিপি’ নামে দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো নায়কদের দাপটে ছিলেন একবারেই মলিন।
এ অবস্থার মধ্যেই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ভেতর ১৯৬৪ সালে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। বাংলাদেশের বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র জগৎ তখন বিকশিত হচ্ছে। রাজ্জাক ভাবলেন, টালিগঞ্জের চেয়ে ঢাকায় সুযোগের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
ঢাকায় তাকে অবশ্য প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়। তখন তিনি বিবাহিত। আর্থিক সঙ্কট যেমন ছিল তেমনি ছিল প্রতিষ্ঠার পথে প্রচুর বাধা।
এক সাক্ষাতকারে রাজ্জাক বলেছিলেন, “আমি আমার জীবনের অতীত ভুলি না। আমি এই শহরে রিফিউজি হয়ে এসেছি। স্ট্রাগল করেছি, না খেয়ে থেকেছি। যার জন্য পয়সার প্রতি আমার লোভ কোনোদিন আসেনি।”
১৯৬৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হলে সেখানে অভিনয়ের সুযোগ নেন রাজ্জাক। তখন ধারাবাহিক নাটক ‘ঘরোয়া’য় অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল চলচ্চিত্রে অভিনয় করা। আবদুল জব্বার খানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পান তিনি তবে নায়ক হিসেবে নয়। সহকারী পরিচালক হিসেবে।
এর মধ্যেই ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’ চলচ্চিত্রে ছোট একটি ভূমিকায় অভিনয় করেন রাজ্জাক। এরপর ‘ডাকবাবু’, উর্দু ছবি ‘আখেরি স্টেশন’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন।
এক সময় জহির রায়হানের নজরে পড়েন রাজ্জাক। তিনি ‘বেহুলা’য় লখিন্দরের ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ দিলেন রাজ্জাককে, সুচন্দার বিপরীতে। ‘বেহুলা’ ব্যবসাসফল হওয়ায় আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্জাককে।
সুদর্শন রাজ্জাক সুচন্দার পর শবনম, কবরী, ববিতা, শাবানাসহ তখনকার প্রায় সব অভিনেত্রীকে নিয়ে একের পর এক ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র দেন ঢালিউডকে।
সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলা সিনেমায় আবির্ভাব ঘটে রাজ্জাক-কবরী জুটির। একের পর এক ছবিতে অভিনয় করেছেন তারা। ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘ঢেউ এর পরে ঢেউ’ এবং স্বাধীনতার পর ‘রংবাজ’, ‘বেঈমান’সহ বিভিন্ন সফল ছবি উপহার দেন এই জুটি।
রাজ্জাক সবচেয়ে বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন শাবানার বিপরীতে। ১৯৭০ সালে ‘মধুমিলন’ ছবি দিয়ে রূপালি পর্দায় জুটি বাঁধেন তারা। তারপর ‘অবুঝ মন’, ‘সাধু শয়তান’, ‘মাটির ঘর’, ‘দুই পয়সার আলতা’সহ অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন তারা।
দশকের পর দশক ধরে বাংলা সিনেমার পর্দায় রাজত্ব করে যাওয়া রাজ্জাক সত্যিকার অর্থেই ‘নায়করাজ’, রিয়াজের ভাষায়, “হি ইজ দ্য কিং। আমাদের কাছে তিনি এখনও রাজা।”