নায়করাজের সেরা ছয়

কলকাতায় জন্মগ্রহণ করা আব্দুর রাজ্জাক নামের ২৪ বছরের এক তরুণ যখন শরণার্থী হয়ে ঢাকার সড়কে পা রেখেছিলেন, তখনও কি কেউ ভেবেছিলো, সাধারণ এই মানুষটিই একদিন কোটি ভক্তের ‘নায়করাজ’ হয়ে উঠবেন?

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2017, 02:14 PM
Updated : 21 August 2017, 02:27 PM

বার্ধক্যজনিত কারণে সোমবার বিকেলে না ফেরার দেশে চলে গেলেন দেশের কিংবদন্তি তারকা রাজ্জাক। কিন্তু সাধারণ এক মোহাজের থেকে জনপ্রিয়তম তারকায় পরিণত হওয়ার গল্পটি কেমন ছিল?

চলুন সেই গল্পই জেনে নিই রাজ্জাকের সেরা ছয়টি সিনেমার ইতিহাসের মাধ্যমে।

১.বেহুলা:

১৯৬৪ সালে যখন একেবারে শূন্যহাতে অচেনা এক শহরে পাড়ি জমিয়েছিলেন রাজ্জাক, তখন জীবিকার উদ্দেশ্যেই অভিনয়কে বেছে নেন তিনি। পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের নাটক দিয়ে দর্শকের কাছে পরিচিত লাভ করেন। এরপর ‘তেরো নং ফেকু ওস্তাগার’ লেনের ছোট একটি চরিত্র দিয়ে চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি। ‘কার বউ’, ‘আখেরি স্টেশন’, ‘ডাক বাবু’ নামের বেশ কিছু সিনেমাতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেও নিজেকে প্রমাণের প্রথম সুযোগটা তার মেলে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ছবিতে।

১৯৬৭ সাল। জহির রায়হান তখন কেবল ‘বাহানা’ তৈরি করেছেন। নতুন ছবির গল্প হিসেবে তিনি বেছে নিলেন মনসামঙ্গল-এর লোককাহিনিকে। বেহুলা হিসেবে সুচন্দাকে বেছে নিলেও লখিন্দরের চরিত্রে তিনি চাইছিলেন নতুন কাউকে। সে কারণেই ডাক পড়লো আনকোরা রাজ্জাকের। প্রথম দর্শনে পছন্দ হলেও জহির রায়হান তাকে নির্দেশ দিলেন দাড়ি না কেটে সাতদিন পরে ফের দেখা করতে।

পরিচালকের কথা মেনে সাতদিন পর খোঁচা খোঁচা দাড়ি সমেত হাজির হলেন রাজ্জাক। এই খোঁচা খোঁচা দাড়িই পাইয়ে দিল তাকে প্রথম নায়কের চরিত্র। মুক্তি পেল ‘বেহুলা’। দর্শক দারুণভাবে গ্রহণ করলো নতুন নায়ককে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্জাককে।    

২. নীল আকাশের নীচে

ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তম জুটি কবরী-রাজ্জাকের পথচলার শুরু সুভাষ দত্তের ‘আবির্ভাব’ দিয়ে হলেও নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘নীল আকাশের নীচে’ এই জুটিকে সুপারহিটের তকমা এনে দেয়। রাজ্জাক-কবরীর রসায়নের পাশাপাশি এই সিনেমার অন্যতম সম্পদ এর সংগীত। সত্য সাহার পরিচালনায় ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘প্রেমেরই নাম বেদনা’র মতো গানগুলো এখনও ঢাকাই চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে আলোড়ন তোলে।

৩. জীবন থেকে নেয়া

যে জহির রায়হানের হাত ধরে নায়ক হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছিল রাজ্জাকের, তার পরিচালনাতেই ১৯৭০ সালে তিনি অভিনয় করলেন বাঙালির স্বাধীনতা-স্বপ্নের রূপক চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’য়। ‘একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন, একটি চলচ্চিত্র’ স্লোগানের এই ছবিতে পরিবারের প্রতিবাদী ছোট ছেলে ফারুকের চরিত্রে রাজ্জাকের চরিত্রটি যেন ছিলো শাসকের শোষণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলার বিদ্রোহী তারুণ্যের বিপ্রবের প্রতীক। এই সিনেমাতে তার বিপরীতে ছিলেন সুচন্দা। 

৪. রংবাজ

১৯৭৩ সাল। স্ত্রী খায়রুন্নেসা লক্ষ্মীর নামে নায়করাজ খুললেন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন্স’। এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম ছবি ‘রংবাজ’, যার নায়ক প্রযোজক নিজেই! আর নায়িকা? রাজ্জাকের দীর্ঘদিনের পর্দাসঙ্গী কবরী।

এই সিনেমার আগ পর্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান রোমান্টিক নায়কের চরিত্রের জন্য সুপরিচিত ছিলেন রাজ্জাক। ‘মিষ্টি মেয়ে’ কবরীর সঙ্গেও তার পর্দা-রসায়নটা ছিল মধুর ভালোবাসারই। কিন্তু রোমান্টিকতার সেই খোলস থেকে বেরিয়ে এই সিনেমায় অ্যান্টিহিরোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন রাজ্জাক। ঢাকাই ছবিতে অ্যাকশনেরও প্রচলন করলেন তিনি এই ছবির মাধ্যমে।

‘হৈ হৈ হৈ রঙ্গিলা রঙ্গিলা রে’, ‘সে যে কেন এলো না’র মতো শ্রোতাপ্রিয় গান উপহার দেওয়া সিনেমাটি রাজ্জাক-কবরী জুটির সেরা ছবিগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত।

৫. অনন্ত প্রেম

কবরীর পাশাপাশি সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকেই নায়িকা ববিতার সঙ্গেও গড়ে উঠেছিল রাজ্জাকের জনপ্রিয় জুটি। এই জুটির সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি ১৯৭৭ সালের ‘অনন্ত প্রেম’, যেটির পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন রাজ্জাক নিজেই।

ছবির গল্প কিংবা ববিতার গ্ল্যামার ছাপিয়েও ‘অনন্ত প্রেম’ আলোচনায় উঠে এসেছিলো এতে রাজ্জাক-ববিতার একটি চুম্বন দৃশ্যের কারণে।

ওই দৃশ্য সম্পর্কে পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে স্মৃতিচারণ করে রাজ্জাক বলেছিলেন, “ছবির শেষ দৃশ্যে নায়ক বিষপান করবেন। নায়িকা (ববিতা) সেই বিষ নায়কের মুখ থেকে চুষে নেবেন। ববিতা এতে একটু বিব্রত হন। আমি ববিতাকে বোঝাই, দৃশ্যটি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। তাই দৃশ্যটি অশ্লীল মনে হবে না। এর পর দৃশ্যটি ধারণ করা হয়। ববিতা অসাধারণভাবে কাজটি করলেন। সন্ধ্যায় শুটিং ইউনিটে ফিরে ববিতার খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলাম, ববিতা কাঁদছেন।

‘কী ব্যাপার পপি, কী হয়েছে?—জানতে চাইলাম। ববিতা আরও জোরে কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘রাজ্জাক ভাই, ওই দৃশ্যটিতে বোধ হয় কাজ করা ঠিক হলো না। আমার তো এখন আর বিয়ে হবে না।’ আমি পপিকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘ছবিটির সম্পাদনা শেষ হোক। তুমি দেখে নিয়ো। যদি তোমার কাছে মনে হয় যে দৃশ্যটি খারাপ লাগছে, তবে আমি এ দৃশ্যটি ফেলে দেব।’ সম্পাদনা শেষে ববিতা ওই দৃশ্যটি দেখে বলল, ‘নাহ্,ঠিক আছে।’”

এরপরও শেষপর্যন্ত দৃশ্যটি সিনেমাতে রাখেননি রাজ্জাক। কিন্তু এরপরও সবশ্রেণির দর্শকের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সিনেমাটি। 

৬. বাবা কেন চাকর

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ। ঢাকাই চলচ্চিত্রে তখন ধীরে ধীরে ঢুকতে শুরু করেছে অশ্লীলতার দূষিত স্রোত। রাজ্জাক-কবরীদের যুগ তখন অতীতের গল্পগাথার মতোই শোনায়। এরপরও ওপারের জনপ্রিয় নায়ক প্রসেনজিতকে নিয়ে তিনি উপহার দিলেন এমন এক চলচ্চিত্রের, যার মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর পারিবারিক মূল্যবোধ উঠে এলো বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মূল বিষয় হিসেবে।

রোমান্স আর অ্যাকশনের চর্বিতচর্বন ছাপিয়ে বহুদিন পর ঢাকাই ছবির দর্শক এই ছবির মাধ্যমে পেয়েছিল পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখার আনন্দ। অমিত হাসান, বাপ্পারাজদের মতো তরুণদের ছাপিয়ে সিনেমাটির সবটুকু আলো কেড়ে নিয়েছিলেন রাজ্জাক একাই। নব্বইয়ের শেষভাগের অন্যতম হিট সিনেমা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে এই সিনেমাটির।

চলচ্চিত্রে পঞ্চাশ বছরের লম্বা ইনিংসে রাজ্জাক অভিনয় করেছেন তিনশোটির মতো বাংলারও উর্দু ছবিতে। জীবনের শেষভাগে শরীর ভেঙে পড়ায় পর্দায় আর খুব একটা আসেননি রাজ্জাক। কিন্তু দেশের চলচ্চিত্রে তার স্থান নিতে পারেনি কেউই।