শাকিব ফিল্ম ছাড়লেও খুব বেশি ক্ষতি হবে না: সোহেল রানা

তিন বারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত দাপুটে অভিনেতা সোহেল রানা। তিন শরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রযোজনায়ও ছিলেন সফল। প্রযোজনা করেছেন ‘ওরা ১১ জন’-এর মতো বিখ্যাত চলচ্চিত্রে। সম্প্রতি গ্লিটজের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। কথা বলেছেন, চলমান যৌথ প্রযোজনা নীতিমালা, শাকিব-চলচ্চিত্র ঐক্যজোট দ্বৈরথ, ইন্ডাস্ট্রির সংকট, উত্তরণ নিয়ে।

গ্লিটজ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 July 2017, 11:51 AM
Updated : 21 July 2017, 07:49 PM

গ্লিটজ: নীতিমালা না হওয়া অবধি যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করছেন আপনি?

সোহেল রানা: ‘যৌথ প্রযোজনা’ শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে যৌথ প্রযোজনা কেমন হবে। শিল্পী-কলাকুশলী সমান হবে। তবে ওজন দিয়ে তো আর মাপা যাবে না। সে কারণে এমনভাবে করতে হবে যাতে ফিল করা যায় আসলেই পঞ্চাশ ভাগের ব্যাপারটা এখানে আছে। শিল্পীদের ব্যাপারে এখানে একেবারে পঞ্চাশে পঞ্চাশই হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু শিল্পী এক বা দু’জন নিয়ে আর বাকি এক্সট্রাদের নাম ঢুকিয়ে পঞ্চাশ ভাগ করার কোনো মানে নেই। টেকনিশিয়ান্সদেরও বহু বিভাগ আছে। ক্যামেরাম্যান, গল্পকার, স্ক্রিপ্টরাইটার, গীতিকার আছে। তাদের এমনভাবে ভাগ করতে হবে যেন দুই দেশেরই ফিফটি-ফিফটি অংশগ্রহণ থাকে। এখানে অদৃশ্য কোনো কারসাজি করলে, সেটাকে গ্রহণ করবো না। শুধু নাম হিসেবে ব্যবহার হলে সেটা হতে দেয়া যাবে না।

গ্লিটজ: যৌথ প্রযোজনার প্রিভিউ কমিটি ভেঙে দেয়া হলো কেন? যৌথ প্রযোজনা নিয়ে আপনাদের অভিযোগ কী?

সোহেল রানা: অনেক সময় দেখা গেছে, ইন্ডিয়াতে যৌথ প্রযোজনার সিনেমাগুলো ড্যাম্প করে রাখা হয়। আমাদের ছবিগুলো যতটা অ্যাটেনশন নিয়ে রিলিজ করা দরকার সেটা সেখানে করা হয় না। কেন হয় না সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু ছবি ড্যাম্প করে রাখা দেখেছি আমরা। পাবলিসিটি করা হয় না। সোজা ভাষায়, যে দেশের সঙ্গেই ব্যবসা করি না কেন তাদের সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো হতে হবে। আমরা এখন তো ইসরাইলের সঙ্গে ব্যবসা করি না। আর ইন্ডিয়ার বাইরেও এখন আর কো-প্রোডাকশন করি না। পাকিস্তানের সঙ্গে তো করার প্রশ্ন নেই। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পরেও ‘স্যরি’ বলার মতো ভদ্রতা করেনি। তাই তাদের নিয়ে বলার কিছু নেই। এখন আমরা ইন্ডিয়াকে নিয়েই কথা বলতে পারি। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের সহযোগিতা করেছেন। বরবরই আমাদের পাশে ছিল। সে হিসেবে অন্যান্য দেশের চেয়ে ইন্ডিয়ার ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ভালো।

ছবি: পারভেজ ফিল্মসের ফেইসবুক পেজ থেকে নেয়া

গ্লিটজ: সেক্ষেত্রে আপনার প্রত্যাশা কী?

সোহেল রানা: নিয়মতান্ত্রিকভাবে যেটা হয় সেটা হওয়াই ভালো। এই জায়গায় কোনোরকম মিথ্যাচার, চালাকি, ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি যেন না করে। তাদের সঙ্গে আমাদের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে, কৃতজ্ঞতাবোধ আছে সেই জিনিসটাই অব্যাহত থাকুক। দুই বাংলা যদি কো-প্রোডাকশন করে তাহলে টাকা-পয়সার দিক দিয়ে শুরু করে সবদিকেই উন্নতি হবে। কো-প্রোডাকশন বলতে যে শুধু কলকাতা বলছি তাও না। বোম্বে, তামিল ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গেও হতে পারে। তবে কলকাতার সঙ্গে যেহেতু আমাদের ভাষা এক, আমাদের কালচার এক, তাই তাদের সঙ্গে কো-প্রোডাকশন হওয়াটাই বেটার। এটা যেন কো-প্রোডাকশনই হয়, অনাচার যেন না হয়। আমি মনে করি মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলা ভাষার ছবি সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারবো আমরা।

গ্লিটজ: যৌথ প্রযোজনা নিয়ে চলচ্চিত্র ঐক্যজোটের আন্দোলনকে ঘিরে বারবারই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে ইন্ডাস্ট্রিতে। সিনিয়রদের নিয়ে অশালীন বক্তব্যের অভিযোগে শাকিবের সঙ্গে ১৬ টি সংগঠন কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সময়ে শাকিবের প্রতি আপনার পরামর্শ কী থাকবে?

সোহেল রানা: পরামর্শ দেয়ার ব্যাপারটা আমি পছন্দ করি না। শাকিব কোনো বালক না। সে ক্লাস টেনে পড়া কোনো ছেলে না। তার চেয়ে বরঞ্চ সে নিজেই চিন্তা করুক। তাকে ভাবতে হবে, সে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের একজন অ্যাসেট। যখনই কেউ বাসার বড় ভাই হয়, তখন তার একটা দায়-দায়িত্ব থাকে। সেই দায়িত্বটাকে ভুলে গিয়ে নিজস্ব স্বার্থের খাতিরে নিজের দেশ, জাতি, সংস্কৃতিকে ভুলে গেলে মানুষ হিসেবে তাকে বড় মনের মানুষ বলব না। মানুষ হিসেবে সবাইকেই ‘গুড হিউম্যান বিং’ হতে হবে। সেই গুড হিউম্যান বিং হবার জন্য আমি তাকে বলব, তোমার কার্যকলাপগুলোকে নিজে থেকে চিন্তা কর।

সিনিয়রদের তুমি সম্মান করছো কি করছো না এটা সম্পূর্ণ তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি তোমার পিতাকে যদি সম্মান না করো, মানুষ তোমাকে খারাপ বলবে। আমার খারাপ বলার দরকার নেই। তুমি যদি তোমার মাকে না ভালোবাস তাহলে আমার তোমাকে খারাপ বলার দরকার নেই। সাধারণ মানুষই তোমাকে বলবে, ‘ব্যাডবয়’। তুমি যেই গাছের ফল খাচ্ছো সেই গাছটা লাগিয়েছে যারা তাদের সঙ্গে এই ধরনের কথা বলা উচিত হয়েছে কীনা-এটা ফিল করো। মানুষ ভুল করলে ভুল শোধরানো ও ভুলের ক্ষমা চাইলে তার মহত্বটাই প্রকাশ পায়। তাতে ছোট হওয়ার কিছু নেই। আমি যদি বাবার সঙ্গে অন্যায় করি। আর বাবাকে যদি বলি, বাবা আমাকে মাফ করে দাও। বাবা তখন খুশি হবে। কিছু কিছু জায়গায় দেখেছি তুমি বলেছ, ‘স্টুপিড’। এটা ভদ্রতা তো নয়, বিনয় তো নয়ই, কোনো ভালো শব্দের মধ্যে পড়ে না। তুমি নিজেই চিন্তা করে দেখ। তোমাকে ভাবতে হবে, তুমিও কিন্তু সিনিয়র হয়ে যাচ্ছো। আগামীকাল তোমাকে কেউ সম্মান করবে না। একজন আর্টিস্ট হওয়া আর একজন পপুলার হিরো হওয়ার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। পপুলার হিরো অনেকে হতে পারে। কিন্তু আর্টিস্ট হতে হলে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বড়-ছোট, ভালো-মন্দ সকলকে বলতে হবে, লোকটা ভালো। তোমরা ইদানীংকালে শুরু করেছ আর্টিস্ট বলা। সুপারস্টার বলা শুরু করেছ। চল্লিশবছর কাজ করার পরও নিজেকে স্টার বলতে পারি না। অভিনয় করে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এতেই খুশি। অন্যকিছু দরকার নেই। আর্টিস্ট হতে হলে সমষ্টিগত যতগুলো গুণের দরকার সেগুলো আমাদের নেই। তোমার মধ্যে যদি থাকে দোয়া করি তুমি সেইসব গুণে গুণান্বিত হয়ে নিজেকে আর্টিস্ট হিসেবে প্রমাণিত করো।

ছবি: পারভেজ ফিল্মসের ফেইসবুক পেজ থেকে নেয়া

গ্লিটজ: কিন্তু শাকিব খান বরাবরই দাবি করে এসেছেন, ‘নবাব’ যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা মেনে করা। এমনকি ছবিতে দেশীয় পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।

সোহেল রানা: কখনোই কো-প্রোডাকশনের ছবি নয় এটি। তুমি হয়তো বলবে আমার ছবিতে আমি একা আছি। সেখানে দু’ তিনটা সিনের জন্য আমাদের একজন টপ ভিলেন সেই ছবিতে কাজ করেছে। আর পুলিশ অফিসারের মধ্যে একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। আর তার পেছনে আরো পাঁচজন পুলিশ দাঁড় করিয়ে শুধু সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।

ক্যামেরাম্যান থেকে শুরু করে মেকআপম্যান, স্ক্রিপ্টরাইটারও নিয়মনীতির মধ্যে হয়নি। এটাও বোঝার ক্ষমতা শাকিবের নেই। যদি না থাকে তাহলে বলব, তোমার ছবিগুলো নিজে দেখ। ফিল করো। সিদ্ধান্ত তোমারই নেয়া উচিত। তুমি কারো খাও না, আবার পরোও না। তুমি ফিল্ম ছেড়ে চলে গেলেও একেবারে খুব বেশি ক্ষতি হবে না। কিছুদিনের জন্য হয়তো হোঁচট খাওয়ার মতো কিছু হতে পারে। তবে কিছুদিন পর আরেকজন শাকিব তৈরি হবে। তুমি তো আজকে তৈরি হয়েছ। যখন রাজ্জাক ছিল, ফারুক ছিল, আলমগীর ছিল, ওয়াসিম ছিল, আমি ছিলাম। তখন দেশে ছবি চলেনি? তখন ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি ছবিও আসত। তারা আমাদের ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারেনি কখনো। কারণ আমরা দেশটাকে ভালোবেসে ছিলাম। শাকিবকেই বলবো, তুমি ফ্ল্যাশব্যাকে যাও। ফিল কর, ছবিটা (নবাব) আসলেই কো-প্রোডাকশন ছিল? তুমি যদি মনে কর, এটা আসলে কো-প্রোডাকশন ছিল না। তাহলে তুমিই স্টপ কর। সরকারকে তুমিই বলো, কো-প্রোডাকশনে নীতিমালা এই ধরনের হওয়া উচিত।

গ্লিটজ: এবার আসি কাজের আলাপে। দীর্ঘদিন ধরেই অভিনয়ে নিয়মিত নন আপনি। কারণ কী?

সোহেল রানা: পরশুদিন একটা কাজ ‘না’ করেছি। কাজ করব না তা নয়। আমার যে বয়স সেই বয়সের মতো চিন্তা করে গল্প হতে হবে। আমাদের জন্য উপযুক্ত গল্প, সংলাপ আর প্রডিউসার পেলে নিশ্চয় ছবি করব। শুধু আজকে না, কালকেও করবো। আমরা কেউই চলচ্চিত্র থেকে সরে যাইনি। আমরা আমাদের পছন্দমতো চরিত্র পাচ্ছি না। পছন্দ মতো গল্প পাচ্ছি না। যারা ছবি নিয়ে আসছে তারা আমাদের স্যাটিসফাই করতে পারছে না।

গ্লিটজ: ‘ওরা এগারো জন’এর মতো নন্দিত চলচ্চিত্রের প্রযোজক আপনি। প্রযোজনা নিয়ে কিছু ভাবছেন ?

সোহেল রানা: প্রযোজনা নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। আমি যে টাকাটা ইনকাম করি সেটা ব্ল্যাকমানি না। ব্যাংক থেকে লুট করা টাকা না। আমার চিন্তা করতে হবে, লাভ না হোক অন্তত আমার টাকাটা যেন ফেরত আসে। ১৬ শ’ সিনেমা হল থেকে যখন ৩ শ’ সিনেমাহল হয়েছে, ডিজিটালের নাম করে অ্যানালগ মেশিনেই যখন ছবিগুলো চালানো হচ্ছে-ওই অবস্থায় ছবি বানানোর প্রশ্নই আসে না। যেখানে আমার তিন’শ ছবির দশভাগের একভাগ টাকাও উঠছে না সেখানে প্রডিউসার হিসেবে টাকা লগ্নি করার প্রশ্নই আসে না।

গ্লিটজ: বাংলা চলচ্চিত্রে চলমান সংকট নিরসনে কী ধরনের সরকারি পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে মনে করছেন?

সোহেল রানা: সিনেমা হল বানানোর জন্য যে জায়গাগুলো দেয়া হয়েছে সেখানে হল বানাতে হবে। যে শপিংমলগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে দু’টির অধিক সিনেমাহল বানাতে হবে। যখন বাংলাদেশে দুই হাজার সিনেমাহল হবে তখন কিন্তু কোনো ছবিই মুখ থুবড়ে পড়বে না। পৃথিবীতে ত্রিশ কোটি বাঙালি আছে। বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি সরকারের বড় একটা আয়ের উৎস হতে পারে।