‘তবু আমারে দেব না ভুলিতে’

সংগীতজ্ঞ সুধীন দাশ সুরের ভুবন ছেড়ে চিরবিদায় নিলেও সুরসাধনা, নজরুল গবেষণা ও শুদ্ধ স্বরলিপির গ্রন্থনের অগ্রদূত হিসেবে তার নাম বারবার উচ্চারিত হবে বলে মনে করেন নজরুল গবেষক ও শিল্পীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 June 2017, 08:04 AM
Updated : 29 June 2017, 10:47 AM

বৃহস্পতিবার এই সংগীতগুরুর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে তারা বলেছেন, তার অসমাপ্ত কাজ তারা এগিয়ে নিয়ে যাবেন; সুধীন দাশকে বিস্মৃত হতে দেবেন না।

অ্যাপোলো হাসপাতালের হিমঘর থেকে সুধীন দাশের মরদেহ বৃহস্পতিবার সকালে প্রথমে তার মিরপুরের বাসায় এবং সেখান থেকে সকাল ১০টায় ধানমন্ডির নজরুল ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়।

মেয়ে মিতু সুপর্ণা দাশ ও জামাতা হাসান মাহমুদ স্বপন এবং নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি এমিরেটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়াও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।  

আজাদ রহমান, ফাতেমা তুজ জোহরা, ফেরদৌস আরা, ইয়াসমীন মোশতারী, বুলবুল মহলানবীশ, সালাউদ্দিন আহমেদের মত শিল্পী, শিষ্য ও অনুরাগীরা নজরুল ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে সুধীন দাশের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন।

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, নজরুলের সুর বিকৃতি রোধে যে মানুষটির ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তিনি দাশ। প্রথম জীবনে রবীন্দ্র, নজরুল, অতুলপ্রসাদ গাইলেও পরে তিনি শুধু নজরুল সংগীতে মনোনিবেশ করেন।

“আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে নজরুলের সুর উদ্ধারে তিনি আমরণ কাজ করে গেছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। এটি ছিল তার সবচেয়ে বড় অবদান।”

যারা জাতীয় কবির ভক্ত, যারা নজরুলকে ভালোবাসেন তারা চিরকাল সুধীন দাশের অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক রফিকুল।

সুধীন দাশের জামাতা হাসান মাহমুদ স্বপন বলেন, “সারা জীবন তিনি নজরুলের বিকৃতি রোধে যুদ্ধ করে গেছেন। তাকে যদি ভুলে যান, তবে সেই যুদ্ধ থেমে যাবে চিরতরে।”

আজাদ রহমান বলেন, সুধীন দাশ স্বরলিপি তৈরি ও নজরুলের গান যথাযথভাবে গাওয়ার চর্চা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। আগামীতেও যারা এ নিয়ে কাজ করবেন, তারা সুধীন দাশকেই অনুসরণ করবেন।

“নজরল সংগীতকে বিকৃতি থেকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। বাংলাদেশের মানুষ এ বিকৃতি রোধে প্রধান ভূমিকা পালন করবে।পথ দেখাবেন সুধীন দাশ।”

ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, “দাদার স্বভাবসুলভ বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল অনেক গভীর। নজরুলের গানের অথেনটিক প্ল্যাটফর্ম করে দিয়েছেন তিনি। আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে সহজ নোটেশন তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন বটবৃক্ষ।”

শিল্পী সুজিত মোস্তফা বলেন, “সুধীন দা এত দ্রুত চলে যাবেন তা ভাবতে পারিনি। অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল।”

শোক জানাতে গিয়ে শাহীন সামাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার শিক্ষক সুধীন দাশ যে কাজ রেখে গেছেন তার ‘তুলনা হয় না’।

“আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল, মাথার ওপর থেকে ছায়া সরে গেল।”

সুধীন দাশের অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নেওয়ার কথাও বলেন এই নজরুল সংগীতশিল্পী।

নজরুল ইনস্টিটিউটে শ্রদ্ধা নিবেদনের পরে সুধীন দাশের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে সর্বস্তরের মানুষ।

প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মুখ্য সচিব কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী।

তিনি বলেন, “সংগীত জীবনে সুধীন দাশ এক কিংবদন্তী হিসেবে চিরকাল উজ্জ্বল থাকবেন। শুদ্ধ স্বরলিপি প্রণয়ন, সংগীত পরিচালনা, সুরকার হিসেবে তার যে অবদান তা কখনও হারিয়ে যাবে না। আগামী প্রজন্মের কাছে তিনি উদাহরণ হয়ে থাকবেন।”

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল ও শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নার চাঁপা এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সচিব ইব্রাহীম হোসেন খান এই সংগীতজ্ঞের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় গণগ্রন্থাগার, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংসদ, সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, প্রসঙ্গ নজরুল সংগীত, অগ্নিবীণা সংগীতায়ন, নজরুল সংগীত শিল্পী পরিষদ, বাংলাদেশ বেতার নিজস্ব শিল্পী সংস্থার পক্ষ থেকে সুধীন দাশের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন খুরশিদ আলম, সুবীর নন্দী, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, লাইসা আহমেদ লিসা, বুলবুল ইসলাম, শারমিন সাথী ইসলাম, সালাউদ্দিন আহমেদ।

সুধীন দাশকে বাংলার সংগীত ভুবনের ‘পুরোধা’ অভিহিত করে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেন, ভবিষ্যতেও তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অনুজদের পথ দেখিয়ে যাবেন।

“পশ্চিমবাংলায় একবার নজরুলের সুর নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা গেল। তখন তাদের গুরু বললেন, তোমরা সুধীন দাশের স্বরলিপি অনুসরণ কর। এটা তার কাছে বড় প্রাপ্তি ছিল কিনা জানি না, তবে এটা আমাদের কাছে এক বড় প্রাপ্তি ।”

সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, “সুধীন দার সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ ছিল না। তিনি যা পেয়েছেন, তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তার কোনো আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষোভ ছিল না।”

রামেন্দু মজুমদার বলেন, “সংগীত ভুবনে এক মহীরুহের পতন হল। তিনি ছিলেন নিভৃতচারী, আত্মমগ্ন। মানুষ কতটা নির্লোভ হতে পারে তার বড় উদাহরণ ছিলেন তিনি। জীবনভর তিনি নজরুল সংগীত চর্চা ও প্রসারে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন।”

তবে রাষ্ট্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা সুধীন দাশের কর্মময় জীবনকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেননি বলে মন্তব্য করেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ। শিল্পী খুরশিদ আলমও একই মন্তব্য করেন।

সুধীন দাশকে সংগীত ভুবনের ‘এক অবিকল্প প্রতিনিধি’ হিসেবে বর্ণনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “তার মৃত্যু সত্যি এক অকাল মৃত্যু। তার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক, তা স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান লীনা তাপসীর চোখে তার শিক্ষক সুধীন দাশ ‘চিরকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক’।

তিনি বলেন, “সকল শ্রেণির মানুষকে তিনি সমানভাবে দেখতেন। তার জীবনের এই অধ্যায়টি আমাদের শিল্পীদের সবার কাছে শিক্ষণীয়।”

শিল্পী ইয়াসমীন মুশতারী বলেন, “সুধীন কাকুর শিক্ষাকে আমরা চিরকাল হৃদয়ে ধারণ করব, চর্চা করব। তার শিক্ষাকে ধারণ করে নজরুল সংগীতের আসল স্বাদ গ্রহণ করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব।”

শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টেনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বলেন, আশির দশকে বাংলাদেশে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তাতে সুধীন দাশের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। সেই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

নাগরিক শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সুধীন দাশের মরদেহ পোস্তগলা শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই হয় শেষকৃত্য।

রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত মঙ্গলবার রাতে মারা যান সংগীতজ্ঞ, স্বরলিপিকার ও নজরুল গবেষক সুধীন দাশ। একুশে পদক পাওয়া এই শিল্পীর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।

১৯৩০ সালে কুমিল্লা শহরের তালপুকুরের বাগিচাগাঁওয়ে সুধীন দাশের জন্ম। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে বিএ পরীক্ষার সময় তিনি পুরোপুরি সংগীতে ঝুঁকে পড়েন।

পরে ১৯৪৮ সালে বেতারে নিয়মিতভাবে নজরুল সংগীত গাইতে শুরু করেন সুধীন দাশ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তিনি মনোনিবেশ করলেন শুদ্ধ স্বরলিপি প্রণয়ণের কাজে।

আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে সেই স্বরলিপি উদ্ধারের কাজে তাকে সহায়তা করেন স্ত্রী নীলিমা দাশ।

১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে ২৫টি স্বরলিপি নিয়ে নজরুল সুরলিপির প্রথম খণ্ডটি প্রকাশ করে নজরুল একাডেমি। পরে নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় আরও ৩৩টি খণ্ড।

নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, আগামী ৬ জুলাই নজরুল ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে সুধীন দাশ স্মরণে শোকসভার আয়োজন করেছেন তারা।