‘রবীন্দ্রনাথ এখনও আপামর জনসাধারণের কাছে পৌঁছাননি’

শুধু কবি হিসেবেই নয়, চিন্তক হিসেবে, দার্শনিক হিসেবে একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে অবদান রেখেছেন ২০১৭ সালে এসেও সে আবেদন ফুরোবার নয়। রবীন্দ্রনাথ যেন প্রতিনিয়ত নতুন করে উপলব্ধি করবার, নতুন করে তাকে জানবার হাতছানি দিয়ে চলেছেন। ২০১৭ সালে এসে কেমন করে তিনি ধরা দেন আমাদের কাছে? তাই জানতে ব্রতী হয়েছেন শ্যামল চন্দ্র নাথ। নির্মাণ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রামাণ্যচিত্র। কবির ১৫৬তম জন্মজয়ন্তীতে এই প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে গ্লিটজের মুখোমুখি হলেন নির্মাতা।

রুদ্র হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2017, 12:09 PM
Updated : 8 May 2017, 12:09 PM

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের ভাবনা এলো কিভাবে?

আমার তো লক্ষ্যই হলো লেখালেখি করা এবং নির্মাণ করা। আমি তো জীবনে অনেক মানুষের কাছে ঋণী। সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হকের কাছে ঋণী। উনার সাথে পরিচয় না হলে আমি লেখালেখি কিংবা নির্মাণের পথে হয়তো আসতাম না। এর আগে আমি এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এর উপর ‘আলোকযাত্রা’ নামক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করি। ‘রবীন্দ্রনাথ ২০১৭’ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা আমার মাথায় আসে ‘আলোকযাত্রা’ করার সময়কালে। আমি পরিকল্পনার কথা অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী-কে বলি, তিনি সমর্থন দেন। এবং প্রামাণ্যচিত্রটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি পেছনে লেগে ছিলেন। যা সত্যি বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা এবং প্রাপ্তি ছিল আমার কাছে। এছাড়া ড. আনিসুজ্জামান এবং প্রাবন্ধিক আহমদ রফিকের ভূমিকা তো ভুলে যাবার মত নয়।  তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তো আমাদের দেশে এভাবে প্রামাণ্যচিত্র আর হয়নি।

কিভাবে শুরু হল এর নির্মাণ কাজ?

একটা ক্যামেরা কেনা ছিল আমার কাছে স্বপ্ন। একটা ক্যামেরা যখন কেনা হল তখন আমি মাঠে নেমে যাই। প্রথম শুটিং করি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। অর্থের অনটন তো ছিলই। একবার ভেবেছিলাম আমি হয়তো শেষ করতে পারবো না টাকার অভাবে। আমার বাবা আমাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। আহমদ রফিক আমাকে বলেছিলেন- শেষ করতে পারবে তো? আমি বলেছিলাম, পারবো। এরপর বাকিটা তো ইতিহাস।

কোথায় কোথায় চিত্রায়িত হয়েছে এটি?

এটি চিত্রায়িত হয়েছে ঢাকায়, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায়, কলকাতার জোঁড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, বীরভূমের শান্তিনিকেতন, বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর, নওগাঁর আত্রাইয়ের পতিসর, রাজশাহী, পদ্মার পাড় কুষ্টিয়া এবং জাপানের টোকিওতে।

প্রামাণ্যচিত্রটিতে দর্শক আসলে কী দেখতে পাবে? 

প্রামাণ্যচিত্রটিতে দর্শক দেখতে পাবে যে, ২০১৭ সালে এসেও আমরা এবং বিশ্ব রবীন্দ্রনাথকে কিভাবে দেখছে। আমাদের এখানে রবীন্দ্রনাথ এখনও যে আপামার জনসাধারণের কাছে পৌঁছাননি তা দেখতে পাবে। আরও দেখতে পাবে রবীন্দ্রনাথের দর্শন, রবীন্দ্র সাহিত্যের বর্ণনা, রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহ, রবীন্দ্রনাথের জনকল্যাণমুখী কাজগুলোর ধারণা।

নির্মাণের পর কী মনে হয়েছে? কতটুকু সফল হয়েছে আপনার অনুসন্ধান?

নির্মাণের পর মনে হয়েছে আমি হয়তো সফল। প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি তবু পিছপা হইনি। কারণ, রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে এক আরাধ্য বিষয়। যখন আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই তখন আমি রবীন্দ্রনাথের বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে সেই মুগ্ধতা এখনো কাটেনি। আমি সফল কিনা সেটা হয়তো সময় বলবে। তবে আমি নিজের কাছে হয়তো এই কাজে সফল। জীবনের কাজ নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম যখন বলেন- শ্যামল চন্দ্র নাথ যা করেছে তা একটি দুঃসাহসিক কাজ কিংবা প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র-গবেষক আহমদ রফিক যখন বলেন- এই প্রামাণ্যচিত্র একটি মাইলস্টোন হয়ে থাকবে তখন একে তো অগ্রাহ্য করা যায় না। আমি মনে করি এই কাজ করার মধ্য দিয়ে আমার প্রাথমিক যাত্রা শুরু হলো। পথ এখনো অনেক বাকি। তবে আরো ভালো কাজ করার তাগিদ রয়েছে।

এ প্রামাণ্যচিত্র নতুন প্রজন্মকে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কতটুকু আগ্রহী করবে বলে মনে করছেন?

এই প্রামাণ্যচিত্র তাদেরকে নতুন নতুন কিছু বিষয়ে নাড়া দেবে নিশ্চিতভাবে। এবং এটি আগ্রহী না করার কোনো কারণ আমি দেখছি না। যেহেতু আমাদের সময়কালের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন মানুষ এতে সম্পৃক্ত রয়েছেন, অবধারিতভাবে এটা নবতর এক প্রামাণ্যচিত্র। একে আমি অন্যতম এক সংযোজন মনে করি রবীন্দ্রনাথের উপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র গুলির মধ্যে।

এ সময়ের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা ও সংকটগুলো কতটুকু উদঘাটিত হয়েছে আপনার প্রামাণ্যচিত্রে?

আমি যতটা দিতে পেরেছি ততটা উদঘাটিত হয়েছে। তবে মূল দর্শন যেমন ভক্তিবাদ থেকে মানুষের দিকে, মাটির দিকে তার গমন। তার উৎকর্ষতম চিন্তা এবং সংকটগুলো এতে অনায়াসে চলে এসেছে বলে আমি বিশ্বাস করি।

আপনার চোখে বিভিন্ন বিজ্ঞজনের সঙ্গে আলাপে যে উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতিগুলো উঠে এসেছে...

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছেন যেমন- “রবীন্দ্রনাথের পরিচয় শুধু এইটুকুই নয় যে, তিনি একজন কবি। কবিতা ছাড়াও তিনি সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও চমৎকার বিচরণ করেছেন। কোনো কোনো কাজ দেখলে মনে হয় যেটা তাঁর আদর্শ তিনি তাঁর বিরোধী কাজও করেছেন। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে তিনি একটা পারিবারিক পরিবেশের মধ্যে বাস করছিলেন।” অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী- “রবীন্দ্রনাথ তো আমাদের জন্য খুবই জরুরী। সাংস্কৃতিকভাবে জরুরী, সামাজিকভাবে জরুরী। আমরা যে ভাষায় কথা বলি, নিজেদেরকে প্রকাশ করি, চিন্তাকে ধারণ করি,  লিখি, সে ভাষার বিকাশ ও অগ্রযাত্রায় রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা তো অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের শিক্ষা হল চলমানতা ও অগ্রগতি।”

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন- “জাতীয়তাবাদী ভাবের ধারা আমরা লক্ষ্য করি বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনের সময়, সেই সময়ে তিনি বাঙালিত্বের গৌরব গান করেছেন।”

অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন- “সব বাঙালিরা যে রবীন্দ্রনাথকে চেনে কিংবা আদর করে এটা ঘটনা নয়।”

প্রাবন্ধিক ও কবি আহমদ রফিক- “আমি এই পর্যায়ে এসে বলি আসলেই রবীন্দ্রনাথ আমাদেরই লোক।” 

কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক- “তাকে আমার লাগবে, তাকে ছাড়া আমার চলবে না।”

বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাথ  কতটুকু উঠে এসেছে?

বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ-এর যাপিত জীবনের ১০ বছর সময়কালের বিভিন্ন বিষয়- বিশেষ করে শিলাইদহ, পতিসর, শাহাজাদপুরের বিষয়গুলোও তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।তার সাহিত্যের উৎকর্ষতা এবং  গ্রামীণ মানুষের উন্নয়ন চিন্তার বিষয় বিশেষভাবে উঠে এসেছে।