বিশ্ববরেণ্য নির্মাতাদের চোখে সত্যজিৎ

চলচ্চিত্র বিশ্বের মহারথী স্ট্যানলি কুবরিক, আকিরা কুরোসাওয়া, ইঙ্গমার বার্গম্যান কিংবা মার্টিন স্করসেসিকে যেভাবে দেখা হয় ঠিক ততটা সম্মান কি দেওয়া হয় বাঙালি নির্মাতা সত্যজিতকে? অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই এমন প্রশ্ন করে থাকেন অনেকে। আদতে চলচ্চিত্রে বিশ্ববরেণ্য এ নির্মাতাদের কাছে সত্যজিৎ ছিলেন প্রায় আরাধ্য।

প্রমা সঞ্চিতাঅত্রিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2017, 12:26 PM
Updated : 2 May 2017, 02:30 PM

আজ থেকে ঠিক ৯৬ বছর আগে কলকাতার এক খ্যাতিমান পরিবারে জন্ম নেন সত্যজিৎ রায়। বাবা সুকুমার রায় ছিলেন সুলেখক আর দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীও ছিলেন নন্দিত কথা সাহিত্যিক । সেদিক দিয়ে বলতে হয় পারিবারিকভাবে শিল্পচর্চার মধ্যেই বড় হন তিনি। কিন্তু প্রতিভা ও কর্মের বিচারে তিনি আটকে থাকেননি বাংলায়। নিজস্ব নির্মাণশৈলী ও গল্প বলার ধরণের জন্য তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো পশ্চিমেও। শেষ বয়েসে এসে চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য অস্কার পুরস্কারে সম্মানিত হন তিনি। ভারতীয় পরিচালক হিসেবে তিনিই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করেন সত্যজিৎ। এরপরই দেশে-বিদেশে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। ‘কান চলচ্চিত্র উৎসব’য়ে ‘বেস্ট হিউম্যান রিপ্রেজেন্টেশন’ বিভাগে সেরা ছবি হিসেবে নির্বাচিত হয় ছবিটি। বিশ্ব-চলচ্চিত্রে যা আজও মূল্যায়িত হয়ে আছে মানবজীবন চরিত্রায়নে, এর বিশেষ মুন্সিয়ানার কারণে। বলা যায় সত্যজিতের এ ছবিটি দিয়েই ভারতীয় সংস্কৃতিকে চিনেছে গোটা বিশ্ব। বিশ্বখ্যাত নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়া, মার্টিন স্করসেসি, ওয়েস এন্ডারসন, এলিয়া কাজান, জেমস আইভরি থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র সমালোচক দারিয়াস কুপার, পলিন কাওয়েল সহ সত্যজিত প্রেমে মগ্ন ছিলেন অনেকেই।

সত্যজিৎ-কে নিয়ে জাপানি নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়ার মন্তব্য বেশ আকর্ষণীয়। তিনি বলেন,“চলচ্চিত্রে মানব জাতির যে অভিনব উপস্থাপন সত্যজিৎ দেখিয়েছেন তা এক কথায় অনবদ্য। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি একজন বড় মাপের মানুষ। তার ছবি না দেখার অর্থ হলো পৃথিবীতে বাস করেও চাঁদ কিংবা সূর্যের উপস্থিতি সম্পর্কে অবহিত না থাকা!” সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’কে বহমান এক নদীর সঙ্গে তুলনা করে ‘রশোমন’ নির্মাতা বলেন,“এটি এমনই এক ছবি যা দেখলে এক অদ্ভূত প্রশান্তি ও ব্যাপকতার মধ্যে হারিয়ে যেতে হবে। এমন ছিমছাম পদ্ধতিতে বিশালতাকে ধরতে পারা কেবল সত্যজিতের পক্ষেই সম্ভব।”  

মার্কিন নির্মাতা মার্টিন স্করসেসি’র মতে সত্যজিৎ হলেন পশ্চিমার চোখে ভারত ও ভারতীয় সংস্কৃতির রূপকার। বিশ্বের দরবারে ভারতীয় গ্রামীণ জীবন এতটা মূর্ত হয়ে হয়ে ওঠেনি সত্যজিতের আগে।‘পথের পাঁচালী’ দেখার প্রথম অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন,“আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন টেলিভিশনে প্রথম তার ছবি দেখি। সেটি ছিলো ইংরেজিতে ডাবিং করা ‘পথের পাঁচালী’। এতটাই মুগ্ধ হয়ে ছবিটি দেখছিলাম যে ছবির ভাষা কী কিংবা অভিনেতা-অভিনেত্রী কারা তার চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিলো দৃশ্যায়নের অপূর্ব কৌশল ও গল্প বলার মোহনীয় কায়দাটি।”

এ ছবিটি দেখার সময় ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ নির্মাতা স্করসেসি’র বয়স ছিলো মাত্র ১৪। তিনি বলেন,“ভারতীয়দের জীবনধারা বরাবর ‘কলোনিয়াল’ দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েই দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম আমরা। একজন ভারতীয়ের দৃষ্টি দিয়ে তাদের জীবনকে দেখার সুযোগ আমার আগে ঘটেনি। ‘পথের পাঁচালী’র প্রতিটি চরিত্রের পোশাক, কথা বলার ধরণ, বিশেষ করে গ্রাম বাংলার দৃশ্যায়ন- এক কথায় সব কিছুই আমার খুব ভালো লেগেছিলো। সত্যজিৎ-কে ধন্যবাদ জানাই এ জন্য যে তিনিই আমাদের সামনে প্রথম ভারতীয়দের জীবনকে তুলে ধরেছেন।”

চলচ্চিত্র বিশ্লেষক ডারিয়াস কুপারের মতে, ভারতীয় সংস্কৃতির এমন গভীরে আর কারও পক্ষে যাওয়া খুবই কঠিন যতটা নিখুঁতভাবে সত্যজিৎ গিয়েছিলেন। পরিচালক জেমস আইভরি ও চলচ্চিত্র সমালোচক পলিন কাওয়েল সত্যজিতের ছবিকে পশ্চিমাদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা বলে অবহিত করেন। তাদের মতে, এমন বিস্ময়করভাবে প্রাচ্যকে আবিষ্কার করার অভিজ্ঞতা সত্যজিৎ ছাড়া আর কেউ দিতে পারেননি। গতানুগতিক মারপিট ও নাচ-গান নির্ভর ভারতীয় ছবির বাইরে এমন করে ভারতীয় জীবনকে তুলে আনতে সক্ষম হননি উপমহাদেশের অন্য কোনো নির্মাতা।

১৯৯২ সালে অস্কার পুরস্কার পেয়ে আপ্লুত সত্যজিৎ বলেছিলেন, ছবি তৈরির অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন মার্কিন সিনেমা দেখেই। তার ছবিতে নিওরিয়ালিজম’য়ের ব্যাপক প্রভাব সেই কথারই প্রমাণ দেয়। আর্ট ফিল্ম বা চলচ্চিত্রের শিল্পীত চর্চা সত্যজিতের হাত ধরেই এই উপমহাদেশে এসেছে। উপনিবেশিক ধারায়, হলিউডের অনুকরণে তৈরি বাণিজ্যিক ছবির বিপরীতে সত্যজিতের ‘জলসাঘর’,‘অপরাজিত’,‘দেবী’,‘চারুলতা’ কিংবা ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে পাওয়া যাবে ভিন্ন গল্পের আস্বাদ। একান্ত নিজস্ব ঢঙে সত্যজিৎ বলে গেছেন আমাদের জীবনেরই গল্প।