লাকী আখান্দ: নতুন দেশের তারুণ্যের সুর

ডেকে ফেরানো যায় না অমৃতপথের যাত্রীকে; তবু মনে রয়ে যায় তার স্মৃতি। বাংলা গানের জগতে এমনই এক অবিস্মরণীয় নাম লাকী আখান্দ।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 April 2017, 02:47 PM
Updated : 22 April 2017, 04:50 PM

সত্তরের ও আশির দশকে বাংলাদেশের গানের জগতে সত্যিকারভাবে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে আসেন লাকী আখান্দ। সেই সময়ের অশান্ত তারুণ্যের প্রেম, বেদনা, হতাশা ও ভালোবাসাকে তিনি যেভাবে সুরে উপস্থাপন করেছিলেন, তা অনন্য।

এই নীল মনিহার, আগে যদি জানতাম, নীলা, আমায় ডেকো না এমনি অসংখ্য গান ও সুরের মায়াজাল তিনি সৃষ্টি করেছেন। ১৯৮০ সালে সালাহউদ্দীন জাকী পরিচালিত ‘ঘুড্ডি’ ছবির সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে তিনি পালটে দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রের গানের ধারা। ‘ঘুড্ডি’ ছবির ‘ঘুম ঘুম চোখে’, ‘সখী চল না’, ‘যেমন নদীর বুকে নাও ভাইসা চলে’ এবং  ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।  এই গানগুলোর কথা লিখেছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। কণ্ঠ দিয়েছিলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ, হ্যাপী আখান্দ, শিমূল ইউসুফ, লিনু বিল্লাহ। বিশেষ করে হ্যাপী আখান্দের কণ্ঠে আবার এলো যে সন্ধ্যা গানটি এখন পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রের চিরসবুজ গানের তালিকায় রয়েছে।

শুধু চলচ্চিত্রের গানে নয়, স্টেজ শো থেকে শুরু করে টিভি অনুষ্ঠান প্রতিটিতে তিনি শ্রোতাকে দিয়েছেন নতুনত্বের স্বাদ। বাংলা গানের ধারায় প্রথম আধুনিক মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করেন তিনি। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের সংগীতের ধারা ভেঙে তৈরি করেন ফিউশন।

লাকী আখান্দের জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৮ জুন ঢাকায়। পুরানো ঢাকার আগামসি লেনের বাড়িতে কেটেছে তার বাল্যকাল। সংস্কৃতিমনা পরিবারের ছেলে হিসেবে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই গানের জগতে প্রবেশ করেন তিনি। শিশুশিল্পী হিসেবে গান করেছেন বেতারে। টিভিতেও ছোটদের গানের অনুষ্ঠানে নিয়মিত শিল্পী ছিলেন তিনি। ১৪ বছর বয়সে এইচএমভি পাকিস্তানের সুরকার ছিলেন। ১৬ বছর বয়সে এইচএমভি ভারতের সংগীত পরিচালক হিসেবে পরিচিতি পান। লাকী আখান্দ ও তার ভাই হ্যাপী আখান্দ দুজনেই গিটারকে সঙ্গী করে তাদের কিশোরবেলা ও প্রথম তারুণ্যে মগ্ন ছিলেন। আগামসি লেনে তাদের পাশের বাড়িতেই ছিলেন আরেকটি সংস্কৃতিবান পরিবার। প্রতিবেশি শম্পা রেজা, রিনি রেজা, নিপা রেজা তিন বোনই ছিলেন অভিনয় ও সংগীতের জগতের অধিবাসী। দুই পরিবারের বন্ধুত্বও ছিল জমজমাট। বিশেষ করে প্রতিভাবান সংগীতশিল্পী শম্পারেজা, লাকী আখান্দ ও হ্যাপী আখান্দের বন্ধুত্ব ছিল সবচেয়ে গভীর। গানে গল্পে সৃজনশীলতায় কাটে তাদের তারুণ্যের সেই দিনগুলো।

আশির দশকে লাকী আখান্দ ও হ্যাপী আখান্দ জুটি দারুণ সব গান উপহার দেন শ্রোতাদের।

ছবি সৌজন্য: তোমার যত গান

আশির দশকে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন লাকী আখান্দ। গান লেখা, সুর দেওয়া ও কণ্ঠে ধারণ করা। সৃজনের বন্যায় ভাসিয়েছিলেন তার শ্রোতাদের। তবে লাকী আখান্দ মূলত ছিলেন সুরকার ও গীতিকার। আর সেই গানের শিল্পী ছিলেন হ্যাপী আখান্দ। আশির দশকে সুবর্ণা মুস্তাফা অভিনীত টিভি নাটকে লাকী আখান্দের গান এই নীল মনি দর্শক শ্রোতাদের মধ্যে দারুণ সাড়া জাগায়। ১৯৮৪ সালে আত্মপ্রকাশ করে লাকী আখন্দের প্রথম একক অ্যালবাম। অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়েছিল সারগামের ব্যানারে। এই অ্যালবামের ‘আমায় ডেকো না’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘মামনিয়া’ ‘এই নীল মনিহার’, ‘সুমনা নামের মেয়েটি’ ‘রূপসী নীল‘ গানগুলো ছিল দুর্দান্ত জনপ্রিয়। তিনি তার সংগীতায়োজনে ড্রাম, ব্যাঞ্জো, ইত্যাদি  যন্ত্র ব্যবহার করে পাশ্চাত্যের পপ মিউজিকের আমেজ নিয়ে আসেন।

১৯৮৭ সালে মৃত্যু হয় হ্যাপী আখান্দের। ছোটভাই এবং সংগীতের আশৈশব সঙ্গীর অকালমৃত্যুতে দারুণ মুষড়ে পড়েন লাকী আখান্দ। তিনি নিজেকে সংগীত জগত থেকে সরিয়ে নেন।

লাকী আখান্দ পরে থাকতেন বাংলামোটরে। তিনি ধীরে ধীরে শোক সামলে নিয়েছিলেন। তার কন্যাও একজন গুণী শিল্পী। বছরখানেক আগেও টিভিতে কয়েকটি অনুষ্ঠানে একসঙ্গে গান পরিবেশন করতে দেখা গেছে বাবা ও মেয়েকে। নব্বই দশকের শেষে আবার সংগীত ভুবনে ফিরে আসেন লাকী আখান্দ। ১৯৯৮ সালে গানের ভুবনে আসে তার নতুন দুটি অ্যালবাম। পরিচয় কবে হবে এবং বিতৃষ্ণা জীবনে আমার।

লাকী আখান্দ ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন ২০১৫ সাল থেকে।

মৃত্যু তাকে অন্য ভুবনে নিয়ে গেলেও বাংলা গানের জগতে তিনি অমর। লাকী আখান্দ চিরদিন বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের অগণিত ভক্ত-শ্রোতার হৃদয়ে।