‘আমরাতো কিছু পাওয়ার জন্য করিনি’

‘স্বাধীন!স্বাধীন! দিকে দিকে জাগছে বাঙালিরা। আজ রুখবে তাদের কারা? ’-

রুদ্র হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2017, 01:16 PM
Updated : 29 March 2017, 12:44 PM

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এমন জাগরণী গান দিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে শুরু হয় গ্লিটজের সঙ্গে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের দুই কণ্ঠসৈনিক শাহীন সামাদ ও তিমির নন্দীর সঙ্গে আলাপচারিতা।

গ্লিটজ: একটু পেছন ফিরে যাবো, স্বাধীনতার এতবছর পর ’৭১এর সেই উত্তাল দিনগুলি আপনাদের কাছে কীভাবে ধরা দেয়?

শাহীন সামাদ: ধরাতো দেয় সবসময়ই। সেই মুহূর্তগুলি তো আমরা ভুলি না। সেই একাত্তরেই আমরা ফিরে যাই। আমরা সরাসরিই অংশগ্রহণ করেছিলাম, কণ্ঠ দিয়েছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শরণার্থী ক্যাম্পে যারা ছিলেন তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলাম, গানের মধ্য দিয়ে তাদের শক্তি জুগিয়েছিলাম। বলতে গেলে তো অনেক পেছনেই ফিরে যেতে হয়। সেই একাত্তরের পঁচিশে মার্চে যখন জানলাম চারিদিকে আর্মি চলে এসেছে, চতুর্দিকে ট্যাঙ্ক নেমে গেছে, চারিদিকে কারফিউ, পাকবাহিনী চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে, হলগুলিতে তারা ঢুকে পড়ছে। হত্যাযজ্ঞ তখন শুরুই হয়ে গেলো তখন। কী যে অবস্থা, সারা ঢাকা থমথমে। কিন্তু আমি বলবো যে তিমির, আমরাতোউদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম সেইদিন, সেই যে সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময়টা।

তিমির নন্দী: বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণটা দিয়েছেন বটে, কিন্তু বাংলাদেশ বেতার যখন এটা সম্প্রচার শুরু করে তখন পাকিস্তান আর্মিরা এটা বন্ধ করে দেয়। তখন বেতারকর্মীরা বলে যে, যদি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করতে দেওয়া না হয়, তাহলে আমরা বেতারযন্ত্র বন্ধ করে দিবো। পরেরদিন সকালবেলা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তিনি কিন্তু বলে দিয়েছেন যেটা শাহীন আপা বলতে চেয়েছিলেন, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’। ওনার নির্দেশনা কিন্তু আমরা ৭মার্চেই পেয়ে গেছি। ওই ভাষণেই কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশনাটা পেয়ে গেছি। তারপরে তো ২৫ মার্চ কালরাত্রি। পরেরদিন সকালবেলা শাহীন আপা নিজেও দেখেছেন কীভাবে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।

ছবি: নয়ন কুমার

 

শাহীন সামাদ: আমাদের বাসাটা ছিলো লালবাগে। লালবাগের পাশেই তো পুলিশের ব্যারাক, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, হোস্টেল সবতো এখানেই। রাতের বেলা তো প্রচণ্ড গোলাগুলি। কল্পনাতীত। এটা আসলে সেইসময় যারা না ছিলো তাদের শত বলেও বোঝানো যাবে না।

তিমির নন্দী: আমি একটু যোগ করি, যারা প্রত্যক্ষদর্শী সেই সময়টায় ছিলেন, যারা দেখেছেন তারাই কিন্তু সেই সময়টার সাক্ষী। এখন নতুন প্রজন্মকে যতোই মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা যায়, তারা আমার কথা শুনছেন, ভিডিও দেখছেন, কোনো পত্রিকা বা বই মারফতে স্বাধীনতার ঘটনাগুলি জানতে পারছেন, এরকম যে, পাকিস্তানী আর্মি এভাবে করেছে,নির্বিচারে গণহত্যা করেছে। গণহত্যা যেটাকে বলে, যেটার জন্য আমরা স্ট্যান্ড করছি-পঁচিশে মার্চ কালরাত্রিকে বিশ্বগণহত্যা দিবস পালন করার জন্য প্রস্তাব রাখছি। তো, সামনাসামনি যে দেখেছে তার ফিলিংস এবং বই পড়ে যে জেনেছে তার ফিলিংস এক হবার নয়।

গ্লিটজ: প্রত্যক্ষে পাকিস্তানী হত্যাকাণ্ড ঘটনা দেখে আপনারা যুদ্ধে প্ররোচিত হয়েছিলেন। তো, আপনাদের দুজনের যুদ্ধে যাওয়ার পেছনে একটা বৈপরিত্য ছিলো। এরকম যে, আপনাকে(শাহীন সামাদ) মায়ের অবাধ্য হয়ে যুদ্ধে যেতে হয়েছিলো,অন্যদিকে আপনাকে(তিমির নন্দী) মা নিজেই যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন।

তিমির নন্দী: আমার ইচ্ছা ছিলো অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যাওয়ার। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই কখনো মায়ের অবাধ্য হইনি। মায়ের আদেশ অমান্য করিনি। কলকাতায় যাওয়ার পর আমি একদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় দেখতে পেলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা বাবার পায়ের কাছে অস্ত্র রেখে যুদ্ধে যাওয়ার আগে দোয়া চাইছে। আমিও ছবিটা দেখে মাকে বললাম মা যুদ্ধে যাবো। আমি নাছোড়বান্দা, কেননা আমি এভাবে বসে থাকবো না। মা বললেন, ঠিক আছে তুমি অনেকদিন ধরে রেডিও টেলিভিশনে গাইছো, তুমি যাও, সেখানে তোমার অনেক পরিচিতজন পাবে, তুমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাও।

শাহীন সামাদ:  ছায়ানটের শিক্ষার্থী ছিলাম বলেই মা অনেক ভয় পেতো, ভাবতো যে এই মেয়েতো যেকোনো দিন যেকোনো কিছু ঘটিয়ে ফেলবে। প্রেরণাটা কোথা থেকে এলো যদি বলি তাহলে বলবো, সেটা গান গাইতে গিয়েই। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলাম। ছায়ানট থেকে রাস্তায়, শহীদ মিনারে, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে, বাস্তুকলাবিদে প্রচুর অনুষ্ঠান করেছি। পরে তো ৭১ এলো। তখন সবে কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। পরে আমার বিয়ে হয়ে গেলো ১৭ এপ্রিল, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কলকাতা চলে যাবো, আমরা যা করবো গানের ভেতর দিয়েই করবো, আমরাতো আর বন্দুক দিয়ে করতে পারবো না। কলকাতায় গিয়ে শুনলাম যে, ১৪৪ নম্বর লেনিন সড়কে একটি সংগঠন হয়েছে যার প্রথমে নাম ছিলো সম্ভবত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক সমিতি, পরে ওটা চেঞ্জ হয়ে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা হয়। ১৪৪ নম্বরের বিপিন বন্দোপাধ্যায়, তিনি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবি ছিলেন, উনি ওনার বাসার নিচতলাটা আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। ওখানে যখন গেলাম তখন সবাইকেই দেখলাম। তখন আমার ভালো লাগলো যে, না আমি একা আসিনি। অনেকেই এসছেন। তবে একটা জিনিস বলবো, অনেকে মা বাবা ভাই বোনদের নিয়ে এসছিলেন, কিন্তু আমি আমার মা, ভাইদের বিপদের মুখে ফেলে আসছিলাম। কেননা আমাদের লালবাগের ৪৮নাম্বারে পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিলো। কেউ দরজা জানালা খুলতেই পারতো না।

ছবি: নয়ন কুমার

 

গ্লিটজ: তারপর কী হলো?

শাহীন সামাদ: ওই বাড়িতে গিয়ে দেখলাম সেখানে সানজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক আছেন, সৈয়দ হাসান ইমাম আছেন, মুস্তাফা মনোয়ার আছেন, আসাদুজ্জামান নূর আছেন, আলী যাকের আছেন এমন অনেকে, এমনকি ওখানকার বুদ্ধিজীবি মহল, সাহিত্য অঙ্গন বা সংস্কৃতি অঙ্গনের সবাই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ওনারাই কিন্তু আমাদের সব অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করতেন। আমাদের কাজটা ছিলো বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের, শরণার্থী ক্যাম্পে গান গেয়ে তাদের মনটাকে ভালো করা, তাদের চেতনাকে জাগ্রত করা, তাদের একটু আশার আলো দেয়া, তারা যেন কোনোভাবেই তাদের মনোবলটা না হারায়। তাছাড়া আমরা যারা আহত মুক্তিযোদ্ধা তাদের ক্যাম্পেও গেছি, তাদের কষ্টটা দেখেছি। আমরা বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রাম করে যে টাকাটা পেতাম, সেগুলো দিয়ে তাদের খাবার দাবার, শুকনো খাবার, কম্বল-টম্বল, হাড়িপাতিল যা দেওয়ার সবকিন্তু আমাদের সংগঠন থেকে দেওয়া হতো। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জায়গায় আমরা গান করেছি, শান্তিনিকেতনে তিনবার গিয়েছি এমনকি দিল্লিতেও গিয়েছি।

গ্লিটজ: স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে কী করে যুক্ত হলেন?

শাহীন সামাদ: আমাদের সংগঠনটা বেশ শক্তিশালী ছিলো। প্রথমদিকে আমরা ৮টি গান গেয়ে আসছিলাম। পরবর্তীতে যখন ডাকে তখন জাতীয় সংগীত, এবং পরেরবার যখন ডাকলো তখন আমরা পারি নাই, কালিগঞ্জ স্টুডিও থেকে ১৪টা গান রেকর্ড করে দিয়েছিলাম। সেগুলো ক্রমাগত রেডিওতে বাজতো। আমাদের একটা স্ক্রিপ্ট ছিলো রূপান্তরের গান।আমরা প্রথমদিকে ৪০জন ছিলাম, পরে ১১৭ জন হয়েছিলাম। এমন না যে সবাই গান করতো। অনেককেই তৈরি করে নিতে হয়েছিলো।

গ্লিটজ: তিমির দার কাছে জানতে চাইবো, তখন মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছিলেন, আপনারা কণ্ঠ দিয়ে গান করছিলেন, মনে হয়েছিলো কি না আপনারাও কণ্ঠসৈনিক?

তিমির নন্দী: তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাওয়াটা খুব ডিফিকাল্ট ছিলো। কেননা কেউ জানতো না যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কোথায়। জানা থাকলেও কেউ বলতো না যে কোথায়। আমার মেজভাই যখন কলকাতায় এসে বাংলাদেশ মিশনে চাকরি পেলেন তখন তিনি আমাকে জানালেন বালিগঞ্জে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, তুমি ওখানে খোঁজ করতেপারো। তারপর আমি খুঁজতে খুঁজতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পেলাম। শ্রদ্ধেয় শিল্পীদেরকে দেখলাম-সমর দাস, অজিত রায়, সুজেয় শ্যাম, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মকর্তা যারা ছিলেন-লাকী আখান্দসহ আরও অনেকে যারা ছিলেন তাদের সাথে দেখা হলো। গান যখন করি, তখন কিন্তু মনে হয়নি যে কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করছি। এ কারণেই আমি বলি যে, মা যখন বলেন, যে ‘তুমি অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করতে চাচ্ছো ঠিক আছে কিন্তু তুমি কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করো’, এই কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করার বিষয়টি আমার মাথায়ই ছিলো না। বুঝতেই পারছিলাম না কণ্ঠ দিয়ে কীভাবে যুদ্ধ করা যায়। কলম হাতে যুদ্ধ করা যায়, তুলি দিয়ে যুদ্ধ করা যায়, কিন্তু কণ্ঠ দিয়েও যে যুদ্ধ করা যায় তা অনেক পরে বুঝতে পেরেছি। কখনোই মনে হয়নি কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করছি। গান গাইতে হবে কারণ, দেশকে স্বাধীন করতে হবে। দেশ যে নয়মাসে স্বাধীন হবে সেটাতো আর আমরা জানতাম না। আমাদেরকে যেভাবে সমর দা, অজিত দা, শ্যাম দা ট্রেনিং দিয়ে সুরটাকে এগিয়ে নিয়েছেন সেভাবে আমরা গানটা গেয়েছি। তখন গানের যে স্কুলিং সেটা এখনও শুনলে বোঝা যায়, একটা মাইক্রোফোনে আমরা দশ বারোজন শিল্পী একসাথে ভয়েজ দিয়েছি। দু চারজন যন্ত্রী বাজিয়েছেন, যন্ত্রও ছিলো না, হারমোনিয়াম বাজিয়ে হয়েছে, টেবিল চাপড়িয়ে হয়েছে।

শাহীন সামাদ: ওটা বলো যে, একটা গান একজন ভুল করলে আবার সবাইকে গাইতে হতো..

ছবি: নয়ন কুমার

 

তিমির নন্দী: হ্যাঁ, এভাবেই আমরা গানগুলো গেয়েছি। একটাই উদ্দেশ্য, গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। আটকে পড়া বাঙালি যারা আছেন তাদেরকে উজ্জীবিত করতে হবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যদি বন্ধ হয়ে যেত, বা অধিবেশন শেষ হতো, মনে হতো কী যেন নেই। অথবা কোনো কারণে, তরঙ্গের কারণে যদি সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যেতো মনে হতো যে কী ব্যাপার কী হলো, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আছে মানে আমরা আছি, এরকম ব্যাপার। সেভাবেই, একটি বেতারযন্ত্র যে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের, বাংলার মানুষকে উজ্জীবিত করেছে তা আমার মনে হয়না পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন হয়েছে।

গ্লিটজ: আপনারা কি তখন অনুভব করতে পেরেছিলেন যে আপনাদের গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের কানে পৌঁছাচ্ছে, কোনো প্রতিক্রিয়া কি পাচ্ছিলেন?

তিমির নন্দী: হ্যাঁ, আমরা তা পাচ্ছিলাম, এবং আমরা এও জানতে পেরেছিলাম যে, আমাদের গান শুনে তারা আরও উজ্জীবিত হয়ে অপারেশনে নেমেছে, অপারেশন সাকসেস করে তারা ফিরেছে। এমন ঘটনাও আমরা শুনেছি। আর সেসময়টা সব শিল্পীই কোনো না কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমি ছিলাম শরণার্থী শিল্পী গোষ্টির সঙ্গে। স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র ছিলো জনাব এম এ মান্নানের নেতৃত্বে এবং তারই নেতৃত্বে ছিলো শরণার্থী শিল্পী গোষ্ঠি। যেখানে মামুনুর রশিদ ছিলেন, আমি ছিলাম, ফকির আলমগীর ছিলেন, মোহাম্মদ রফিকুল আলম, শুক্লা দে, দীপা খন্দকার, রেখা দাস ছিলেন। আমাদের স্ক্রিপ্ট ছিলো, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য। শাহীন আপা বললো না যে মাত্র ১৭জন ছিলো, আস্তে আস্তে তা বড় হয়েছে। তো, যারা অভিনয় করে, নাচ করে তাদেরও কিন্তু গাইতে হয়েছে। একটা উদাহরণ বলি, ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিবো রে’-আপেল মাহমুদের এ গানটাতে প্রকৌশলীরাও কণ্ঠ দিয়েছিলেন। এভাবেই গান হয়েছে। কোনো কোনো গান কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই তৈরি হয়েছে, কোনো কোনো গান খুব চিন্তা ভাবনা করে তৈরি হয়েছে। কীভাবে লিখলে, কীভাবে সুর করলে তা মানুষের মনে দাগ কাটবে। যার ফলে এখনো গানগুলি তেজদীপ্ত করে, উজ্জীবিত করে। এখনও আমাকে অনেকে ফোন করে বলেন, যে এখনও আপনাদের কণ্ঠে সেই তেজদীপ্ত সুরটা কীভাবে রইলো? এর কারণ হচ্ছে আমরা ফিরে যাই। আমরা একাত্তরে ফিরে যাই।গানগুলো যখন আমরা কন্ঠে তুলি তখন আমরা সেইদিনগুলিতে ফিরে যাই। এখনও আমাদের গায়কিতে সেই জিনিসটা প্রকাশ পায়। আমাদের বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা চেষ্টা করি সেই যে ভাবটা সেই যে অনুভূতিটা সেটাকে ফিরিয়ে আনতে।

শাহীন সামাদ: এ কথার সূত্র ধরে বলি, কিছুদিন আগে শিল্পকলা একাডেমিতে গান শেখানোর দায়িত্ব পড়েছে আমাদের দুজনের ওপরে। স্টুডেন্টদের কিন্তু সারা বাংলাদেশ থেকে ছেঁকে নিয়ে এসছে। ষাটজন। একুশের গান, স্বাধীনতার গান। যতোই বলি, এভাবে করো ওভাবে করো, এখানে জোর দিতে হবে ওখানে এই করতে হবে কিন্তু গাইতে গেলেই দেখা গেলো, একটু পরই মিইয়ে গেলো। কোনো স্পিরিটই নাই। গানগুলো ওরা তুলছে কিন্তু গানগুলোর মধ্যে যে শক্তিটা তা ওদের মধ্যে পাওয়া যায় না।

গ্লিটজ: তিমির দা এ প্রসঙ্গে কী বলবেন?

তিমির নন্দী: অনেকেই আমাকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেন, যে তরুণরা তো আপনাদের গান গাইছে। কেমন গাইছে? আমি অবশ্যই খুশি হই যখন তরুণরা আমাদের গানগুলো করেন। কখনো কখনো দেখা যায় যে, তাদের যে ফিলিংসটা, তারা গান শিখেছে বলে গাইছে। আমরা কিন্তু সেটা না। আমাদের লক্ষ্য ছিলো দেশটাকে স্বাধীন করতে হবে। আর ওরা একটা গান শিখেছে বলে গাইছে-এই হলো পার্থক্য।

গ্লিটজ: যেটা বলতে চাইছিলাম, তখন এমনটা মনে হয়েছে কিনা-সামগ্রিকভাবে আপনারাও মুক্তিযুদ্ধের একটা অনিবার্য অংশ হয়ে উঠেছেন...

তিমির নন্দী: আমরা যে কাজটা করেছি তা এতবছর পর বুঝতে পেরেছি যে আমরা কিছু একটা করেছি। আমরাতো কিছু পাওয়ার জন্য করিনি। দেশ পাওয়ার জন্য করেছি। স্বাধীন একটা দেশ পাবো, মানচিত্র পাবো সেই চাওয়া থেকে কাজ করেছি।

শাহীন সামাদ: হ্যাঁ, এতদিন পর বুঝতে পেরেছি যে কিছু একটা করেছিলাম আমরা।

গ্লিটজ: রাষ্ট্রের জায়গা থেকে আপনাদের কীভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে মনে করেন? মুক্তিযোদ্ধার মতো পূর্ণ সম্মান কি রাষ্ট্র আপনাদের দিতে পেরেছে ?

শাহীন সামাদ: বেসরকারিভাবে আমরা কিন্তু অনেক ভালোবাসা, সম্মান পেয়েছি। সরকারিভাবেও আমরা পেয়েছি। কিন্তু অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু আরও আগে থেকেই হওয়া উচিত ছিলো, করা উচিত ছিলো। আমি চুয়াল্লিশ বছর পর পেলাম, ও ৪২বছর পর পেলো, এতসময় লাগলো কেন? ১১টা সেক্টর ছিলো, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের কিন্তু সেভাবে কখনোই কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তবে এবার, গতবছর আমাদের শিল্পীদের সেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। সরকারের কাছে আমরা এ জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।

তিমির নন্দী: ব্যক্তিগতভাবে অনেকে আমাদের সম্মানিত করেছেন। বর্তমান সরকার, স্বাধীনতার পক্ষের সরকার আমাদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিলো এতে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দেয়া হচ্ছে।

শাহীন সামাদ: তুমি পাচ্ছো নাকি? আমি এখনও পাইনি, হা হা

তিমির নন্দী: আমি পাচ্ছি কিছুদিন হলো। তবে, আমার একটা চাওয়া ছিলো, সেটা হলো, আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশিদের ডেকে এনে সম্মাননা জানানো হয়েছ। আমাদেরও যদি তাদের সঙ্গে, তাদের মতো করেই এই সরকারই সম্মাননা জানাতো তাহলে খুব ভালো হতো। আমি একটা জিনিস চেয়েছিলাম, এটা একা একা বলে তো হবে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আমরা যারা আছি তাদের যদি একটা প্লট দিয়ে বাড়িঘর করে দিতেন সরকার, কিংবা সরকার কেন? এখানে অনেক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আছে। যারা কিন্তু সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েও আমাদের এটা করে দিতে পারেন। ব্যাংকারদের কলোনি আছে, সাংবাদিকদের কলোনি আছে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের থাকতে অসুবিধা কোথায়?  মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হলে সবাই হয়তো...

শাহীন সামাদ: সান্তনা পেতো...