‘বঙ্গবন্ধু বললেন, তোরা আগে দখল কর রেডিও-টেলিভিশন’

একাত্তরে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের প্রতিষ্ঠাতা তিনি, পাকিস্তান সরকারের কব্জা থেকে টেলিভিশন আর বেতারের নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন ছাব্বিশে মার্চের আগেই। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হাসান ইমাম এসেছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর কার্যালয়ে। সেখানেই গ্লিটজ-এর মুখোমুখি হয়ে বর্ণময় জীবনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরলেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2017, 06:54 AM
Updated : 28 March 2017, 03:32 PM

গ্লিটজ: পাঁচ পুরুষের রাজনৈতিক ঐতিহ্য রয়েছে আপনার পরিবারে। শৈশব থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আপনার রাজনীতিতে প্রবেশ। ওই সময়ের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন কেমন ছিল?

হাসান ইমাম: আমার পরিবারের কথা এখানে কিছুটা না বললে, আমার জীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া কিংবা মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি পরিস্কার হবে না। এক যৌথ পরিবারে আমার ছোটবেলা কেটেছে, আমার নানাবাড়িতে। আমার দাদু যদিও রাজনীতি করতেন বাগেরহাটে, তিনি কৃষক-প্রজা পার্টি করতেন। কিন্তু সেখানে আমি বড় হইনি।

আমাদের পরিবারে কমিউনিস্ট পার্টি, মুসলিম লীগ, কংগ্রেস - সবই ছিল। যৌথ পরিবারের সবাই একই বাড়িতে থাকতেন, একই টেবিলে বসে আমরা খেতাম, কিন্তু তারা একেক ধারার রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন বেশ তুঙ্গে। বিয়াল্লিশে তো আপনারা জানেন যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন বেশ জোরদারভাবে শুরু হয়েছিল। আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস থ্রিতে, ছয় বছর বয়সে। কারণ তখন জেলা স্কুলগুলোতে ওয়ান-টু ছিল না। আমি স্পোর্টসে ভাল ছিলাম। আমি স্পোর্টসে পুরস্কার পেয়েছি, পুরস্কার দেওয়ার জন্য একটা টেবিলে সাজানো হয়েছে। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তখন বেল সাহেব, সস্ত্রীক তিনি এসেছেন। প্রধান শিক্ষক আছেন, অন্যান্য শিক্ষকেরাও আছেন, বর্ধমানের গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও আছেন। আমরা যারা পুরস্কার পেয়েছি, তারা মাঠে বসে আছি, দড়ি দিয়ে জায়গাটা ঘিরে রাখা হয়েছে। দড়ির ওপারে দর্শকরা আছেন। আমাদের ক্লাস টেনে পড়তেন ধীরেনদা; তিনি খুব ভাল স্পোর্টসম্যান ছিলেন, তিনি হান্ড্রেড মিটার্স-এ প্রথম হয়েছেন। তিনি আমাদের কানে কানে বলে গেলেন, ‘আমাকে প্রথম ডাকবে পুরস্কার নিতে। আমি বলবো, ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের হাত থেকে পুরস্কার নেব না। সঙ্গে সঙ্গে তোমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে বলবে ইংরেজের হাত থেকে পুরস্কার নেব না। তারপর আমার পেছন পেছন বেরিয়ে যাবে।’

ছবি: নয়ন কুমার

 

আমরা তাই করলাম। সেই বেল সাহেবের মুখ লাল হয়ে গেল, তার স্ত্রীও খেপে গেলেন এবং তারা বেরিয়ে ওখান থেকে চলে গেলেন। সব গন্ডোগোল হয়ে গেল। আমাদেরকে তো স্কুল থেকে বহিস্কার করবে। কিন্তু হয়তো পরে রাগ ঠান্ডা হলে ভেবেছে যে ঠিক হবে না, কারণ সবাই বাচ্চা বাচ্চা ছেলে। তো আমাদের আর বহিস্কার করেনি।

তো এই প্রথম আমি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে না বুঝেই জড়িত হয়ে গেলাম। তারপর ১৯৪৩-এ যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানরা হেরে গেল, জার্মানি এবং জাপানের সঙ্গে আইএনএ (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) গঠন করে যুক্ত হয়েছিলেন সুভাষ বসু। তার সঙ্গী-সাথিদের তখন বিচার হচ্ছিল দিল্লির রেডফোর্টে। সেই বিচারের বিরূদ্ধে সারা দেশ উত্তাল। তো যেদিন রশিদ আলির বিচার হচ্ছে, আমরা সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে নামলাম এর প্রতিবাদ করতে এবং ইংরেজ পুলিশের লাঠির বাড়ি খেলাম। 

তো এভাবেই ছোটবেলাটা আমার গড়ে উঠেছে। আমার বড় মামা শাহেদুল্লাহ ছিলেন বর্ধমান জেলার কংগ্রেস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। আমার মেঝো মামা কৃষক সমিতির সাধারন সম্পাদক, বঙ্কিম মুখার্জি ছিলেন এর সভাপতি; যাদের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন হয়েছিল। আমার নানা আবুল হাশেম সাহেব ছিলেন বঙ্গবন্ধুদের নেতা, বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার বাবা আবুল কাশেম সাহেব বেঙ্গল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, সুরেন ব্যানার্জীর সঙ্গে। তারও বাবা নবাব আব্দুল জব্বারও রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। তো এভাবে পাঁচ প্রজন্মের একটা ট্র্যাডিশন আমার ভেতরে কাজ করেছিল। 

যখন দেশভাগ হচ্ছে, ছেচল্লিশের নির্বাচন, সেই নির্বাচনে জিন্নাহ সাহেব বললেন, মুসলমানরা যদি মুসলিম লীগকে ভোট দেয়, তাহলে প্রমাণিত হবে ভারতের মুসলমানরা পাকিস্তান চায়। এটা ছিল ‘রেফারেন্ডাম ফর পাকিস্তান’ ভোট। তখন মুসলমানদের আলাদা কন্সটিটিউয়েন্সি, হিন্দুদের আলাদা কন্সটিটিউয়েন্সি, খৃষ্টানদের আলাদা কন্সটিটিউয়েন্সি, বৌদ্ধদেরও আলাদা কন্সটিটিউয়েন্সি। 

তো এভাবেই নির্বাচন হচ্ছে, মুসলমানেরাই ভোটার, মুসলমানেরাই প্রার্থী। সেই নির্বাচনে আজকের যে পাকিস্তান, সেখানে কোথাও মুসলিম লীগ জিততে পারলো না! তার মানে ভারতীয় মুসলামানেরা মুসলিম লীগকে ভোট দিল না, রেফারেন্ডামে জিন্নাহ সাহেব কিন্তু পরাজিতই হলেন। শুধুমাত্র বাংলায় মুসলমানেরা ভোট দিল মুসলিম লীগকে এবং সরকার গঠন করলো তারা। 

এই বাংলায় যে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করলো, তার দুটি ভাগ ছিল। একটি ছিলো অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল মুসলিম লীগ, যার নেতা ছিলেন সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম - এরা; বঙ্গবন্ধুরা যাদের শিষ্য ছিলেন। আরেকটি ছিল ঢাকার নবাব নাজিমউদ্দিন এবং দৈনিক আজাদের যিনি সম্পাদক ছিলেন, তাদের দল। এরা ছিলেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে।

ছবি: নয়ন কুমার

 

যখন দেশভাগ হচ্ছে, তখন কথা ছিল, একেকটি প্রদেশ হিসেবে সিদ্ধান্ত হবে যে তারা ভারতে থাকবে, না পাকিস্তানে যাবে। ভারতের মানুষের কিন্তু কোনো ভোট নেওয়া হয়নি দেশভাগের ব্যাপারে। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট - তারা একসাথে বসে দেশটাকে ভাগ করে দিল। এবং ভাগ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তারা সিদ্ধান্ত দিল যে পাঞ্জাব এবং বাংলা ভাগ হবে। 

এই পাঞ্জাব এবং বাংলা ভাগ হবে যখন তারা বললো, তখন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের যারা ছিলেন, তারা আর পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেন না, বঙ্গবন্ধুরা আবুল হাশেম-সোহারাওয়ার্দির নেতৃত্বে এই অংশে ছিলেন। এবং কংগ্রেসের যারা প্রগতিশীল ছিলেন, যেমন মানিকগঞ্জের কিরণ শঙ্কর রায়, বেঙ্গল কংগ্রেসের সভাপতি সরোদ বোস- এরাও দেশভাগ ভাবনায় সম্মত হলেন না। তখন মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম গ্রুপ এবং সরোদ বোস-কিরণ শঙ্কর রায়, এরা মিলে একটা আন্দোলন করলেন যে আমরা বাংলা ভাগ করতে দেবনা। তারা বললেন ‘বেঙ্গল ফর বেঙ্গলিজ; আমরা পাকিস্তানেও যাব না, ভারতেও থাকবো না, আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র হবো।’ কিন্তু এতো শেষ সময়ে তারা এই সিদ্ধান্ত নিলেন যে সেটা আর কার্যকর হলো না, বাংলা ভাগ হয়ে গেল। 

বাংলা ভাগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সোহরাওয়ার্দী এবং আবুশ হাশেম পূর্ব বাংলায় এলেন না। অথচ’ তাদের নেতৃত্বেই কিন্তু বাংলার জনগণ মুসলিম লীগকে ভোট দিয়েছিল। সোহরাওয়ার্দী তখন মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে মিলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যাতে বন্ধ হয় সেজন্য প্রার্থনাসভাগুলোতে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে লাগলেন। আর আবুল হাশেম বিরোধী দলীয় নেতা হয়ে থেকে গেলেন ভারতের পার্লামেন্টে। কিন্তু পঞ্চাশের রায়টে যখন রাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলো, তখন তারা ফিরে এলেন এখানে।

ছবি: নয়ন কুমার

 

তাদের শিষ্যরা কিন্তু ততোদিনে পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে সাম্প্রদায়িকতা বন্ধের আন্দোলন শুরু করে দিয়েছেন। এবং প্রথমে মুসলিম আওয়ামী লীগ, পরে আওয়ামি লীগ গঠন করে ফেলেছেন। সেখানে মওলানা ভাসানী আসাম মুসলিম লীগ থেকে এসে সভাপতি হয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব এসে এতে যুক্ত হলেন। আবুল হাশেম নেজামে ইসালামী নামে অন্য একটি দল গঠন করেন কিন্তু সে দলটি পরবর্তীতে আর টিকে থাকতে পারেনি। কিন্তু বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং নেজামে ইসলামী একসঙ্গে হয়ে করেছিল। এবং আবুল হাশেম ভাষা আন্দোলনের সময় এক বছরের জন্য জেলে ছিলেন।

এই ভাষা আন্দোলন আমাদের আরেকটি জাতীয়তাবাদের জন্ম দিল, সেটা হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধরেই আমরা তখন ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে এলাম সেটা পরে রূপ নিল স্বাধিকার আন্দোলনে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ছয়দফা দিলেন। 

এই ছয়দফা নিয়েই কিন্তু আমরা আন্দোলন শুরু করলাম, স্বায়ত্ত্বশাসনের মতো একটা ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সেটা মেনে নিল না। গুলি চালালো এবং আমাদের রক্ত দিতে হলো।

গ্লিটজ: ষাটের দশকের উত্তাল সময়টাতে আপনারা টগবগে তরুণ। সিনেমায় অভিনয় করছেন; আপনার আসলে রাজনীতিতে শুরুটা আগে, অভিনয়ে আসেন পরে। কিন্তু তখন আপনি পুরোদমে সিনেমায় অভিনয় করছেন। টিভিতে অভিনয় করছেন, বেতারে কণ্ঠ দিচ্ছেন এবং প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের হয়ে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনও চালিয়ে যাচ্ছেন। ওই দিনগুলির কথা জানতে চাই।

হাসান ইমাম: আমি ১৯৫৭ সালে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরলাম। আমি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়েছি। যাই হোক, দেশে ফিরে আমি চাকরিতে যোগ দিলাম দর্শনা সুগার মিলে, পরে আমি ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফ পাকিস্তানে ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় যারা অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বর্ধমানের লোক, তারা জানতেন আমি অভিনয় করি। কারণ সাতান্ন’র আগেই বর্ধমানে বেশ প্রখ্যাত অভিনেতা হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তো আমাকে তারা ডাকলো, আমি মঞ্চে এবং ছবিতে অভিনয় করা শুরু করলাম।

একষট্টিতে একটি বিরাট ঘটনা ঘটে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষ আমরা পালন করি। আমরা জাতীয় একটা কমিটি করলাম, কারণ পাকিস্তান সরকার তার আগেই রবীন্দ্র চর্চা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল এই পূর্ব বাংলায়। তো জাস্টিস মুর্শেদকে সভাপতি এবং অধ্যাপক সারোয়ার মুরশেদকে সম্পাদক করে জাতীয় কমিটি করা হলো, বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল  রপা- এরা সব সদস্য হলেন। সেই সময়ে আমরা তিনটি নাটক করি, ড্রামা সার্কেলের নেতৃত্বে- ‘রক্তকরবী’, ‘তাসের দেশ’, ‘রাজা ও রানি’। এই তিনটিতেই আমি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করি। নাটকের চরিত্রে গানও ছিল, সেই গানগুলোও আমি নিজেই স্টেজে গাই। আর আমি এমনিতে গানের আসরেও গান গেয়েছিলাম। আমি একটু আধটু গান করতাম তখন...

ছবি: নয়ন কুমার

 

গ্লিটজ: একটু আধটু নয়, আপনি অল ইন্ডিয়া ইয়ুথ ফেস্টিভালে রবীন্দ্রসংগীতে প্রথম হয়েছিলেন!

হাসান ইমাম: সে অনেক আগে। আমার তখন চৌদ্দ বছর বয়স। ইডেন গার্ডেনে হয়েছিল, কলকাতায়। 

যাই হোক, সেটা কথা নয়। এই যে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে আমরা যোগ দিলাম, এটাতে কিন্তু রাজনীতি এবং সংস্কৃতির আন্দোলন একইসাথে যুক্ত। কারণ রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হয় তো রাজনৈতিক কারণেই। সেই নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধেই কিন্তু আমরা এই আন্দোলন করলাম। 

এবং তারপরেই ছায়ানট গঠিত হলো, সত্যেন সেন উদিচী গঠন করলেন। সানজিদা খাতুন এবং ওয়াহিদুল হক-এর ছায়ানট হলো শুদ্ধ বাঙালিত্ব চর্চার কেন্দ্র আর উদিচী হয়ে উঠলো বিপ্লবের সংস্কৃতি। দেশভাগের আগে কমিউনিস্ট পার্টির যেরকম ছিল গণনাট্য সমিতি, সেটার আদলে সত্যেন সেন উদিচীকে গড়ে তুললেন। 

এই দুটোর সঙ্গেই আমি কিন্তু যুক্ত ছিলাম। পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে আমি আর গোলাম মোস্থফা আবৃত্তি করতাম। আবার উদিচীর সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। 

কিন্তু ছবিতে এলাম ১৯৬০-এ। চলচ্চিত্রে কাজ করছি তখন পেশাজীবি হিসেবে। ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে অভিনয়ই আমার পেশা তখন। কিন্তু যেহেতু আমার সংগঠন করার অভ্যাস ছিল, চলচ্চিত্রে যেয়েও শিল্পী সমিতি গঠন করি আমি, এফডিসির যে পরিচালক-প্রযোজক সমিতি- সেটা গঠন করি আমি। এভাবে সবাইকে নিয়ে সংগঠন গড়ে তোলা আমার একরকমের অভ্যাস ছিল।

সেকারণে যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো, বঙ্গবন্ধুর ডাকে, তখন আমরা একটা সংগঠন করলাম- বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ নামে। এটার আমি আহ্বায়ক, ওয়াহিদুল হক সাহেব ছিলেন যেটার যুগ্ম-আহ্বায়কদের একজন। আর আতিকুল ইসলাম, যিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমির রবীন্দ্র সংগীতের শিক্ষক ছিলেন, তিনি হলেন আরেক যুগ্ম-আহ্বায়ক। আর বেগম সুফিয়া কামাল ট্রেজারার। এইভাবে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ গঠন করে বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিলাম।

ছবি: নয়ন কুমার

 

আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পরে এমনই অসহযোগ আমরা (শুধু আমরা না, সারা দেশের মানুষ) করলাম যে, পাকিস্তান সরকার অচল হয়ে গেল। টেলিভিশন চালাতে পারেনা, কারণ টেলিভিশনে তখন রেকর্ডিং ছিল না, লাইভ প্রোগ্রাম হতো, কিন্তু আমরা কেউ যাই না। কর্মচারী, কর্মকর্তা, ঘোষক, সংবাদ পাঠক, শিল্পী, গানের শিল্পী, নাচের শিল্পী, অভিনয়শিল্পী- আমরা সবাই বর্জন করালাম বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের নেতৃত্বে। 

এবং আমরা তখন শহীদ মিনারে, শ্রমিক এলাকায়, ছাত্র এলাকায় নাটক করছি, বিপ্লবের নাটক! গণসংগীত করছি, প্রগতিশীল নাচের অনুষ্ঠান করছি। আমি একটা নাটক পরিচালনা করতাম পুলিশকে উৎসাহিত করার জন্য, পলিশ যাতে অন্যায় নির্দেশ না মেনে জনতার কাতারে এসে জনগণের কাজে যোগ দেয়। যেটা পঁচিশে মার্চে হলো! আমার পরিচালনায় এতে গোলাম মোস্তফা অভিনয় করতো, রাজু আহমেদ অভিনয় করেছিল।     

আটই মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে টেলিভিশন এবং বেতার পাকিস্তান সরকার আমাদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে আমরা মোস্তফা মনোয়ারের নেতৃত্বে টেলিভিনে এবং আশরাফ-উজ-জামানের নেতৃত্বে বেতারে একটি করে কমিটি গঠন করে দেওয়া হলো। আমরা আটই মার্চ থেকে পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত সরকারের প্রচারযন্ত্রকে ব্যবহার করলাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। 

গ্লিটজ: তাহলে কি এটা বলা যায় যে ছাব্বিশে মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা আসার আগেই পূর্ব বাংলার রেডিও এবং টেলিভিশন কেন্দ্র স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল?  

হাসান ইমাম: হ্যাঁ, এটা বলা যায়। রেডিও এবং টেলিভিশন পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রনে এসে গিয়েছিল। শুধু দুটো শর্ত আমাদের দেওয়া হয়েছিল, যেটা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমরা মেনে চলছিলাম। তারা বলেছিল যে তোমরা পাকিস্তানের ‘অখণ্ডতা’র বিরুদ্ধে আর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবে না। 

আমরা আবার বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম আমাদেরকে শর্ত দিচ্ছে, এ ব্যাপারে কী করবো। বঙ্গবন্ধু বললেন এই দুটো শর্ত মেনে নিতে। বললেন, ‘তোরা আগে দখল কর টেলিভিশন আর রেডিও’।

তো বেতার এবং টেলিভিশন আমাদের নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়েছিল। এই দুটি শর্ত বাদ দিয়ে আমরা আমাদের মনের মতো অনুষ্ঠান করছিলাম।

কিন্তু পঁচিশে মার্চে যখন গণহত্যা শুরু করলো ওরা, (আগ থেকেই এরা প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তাই পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত আমাদের আক্রমণ করে নাই) ওই রাতে আমরা অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় গেলাম, রাত এগারটায় ওরা অপরেশন সার্চলাইট শুরু করলো। এই যখন তারা গণহত্যা শুরু করলো, আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম। আবার আমরা একত্রিত হলাম মুজিব নগরে যেয়ে।

প্রথমে আমরা মাগুরা গেলাম। ওখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলাম। তারপরে আবার আমরা ভারতে চলে গেলাম। এরপর যখন মুজীব নগরে সরকার গঠন করা হলো, তখন আমরা সেখানে এসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গঠন করলাম। 

গ্লিটজ: ওই সময়ে চারদিকে যুদ্ধ চলছে, ভারতে আপনারা গেলেন কীভাবে?

হাসান ইমাম: পঁচিশে মার্চে যখন ক্র্যাক ডাউন হলো, আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম। আমি বাড়িতে আটকে গেছি। সাতাশে মার্চে দুই ঘন্টার জন্য কারফিউ তুলে নিল পাকিস্তান সরকার। সেই সময়ে আমি বাড়ি থেকে চলে গেলাম। গোলাম মোস্তফা তার পরিবার নিয়ে চলে আসছিল... সুবর্ণা তখন বাচ্চা, সুমিত, ওর ছেলে আর ভাবীকে নিয়ে চলে আসছিল, তখন আমার বাড়িতে সে এসে বললো এক বাঙালি সৈন্য তাকে খবর দেয়েছে চলে যেতে। সে বললো, ‘তুমি এখুনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাও, তোমার বাড়ির ঠিকানা খোঁজ করছে আর্মিরা, তোমাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে’।

 

তো তখন সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার ফুফুর বাড়ি ছিল শান্তিনগরে, সেখানে আমার পরিবারসহ গিয়ে উঠলাম। পরিবার মানে আমার মা, আমার স্ত্রী, মেয়ে এবং বড়ভাই। তারপরে ঢাকা থেকে বেরিয়ে গেলাম। সাভারের কাছে যে রাজফুলবেড়িয়ায় নানির বাড়ি ছিল, সেখানে গিয়ে উঠলাম। সেখানে ওয়াহিদুল হক সাহেব এলেন। গোলাম রাব্বানি বলে নাটকের একজন কর্মী ছিল যাকে আমি তৈরি করেছি, সে ওয়াহিদুল হক সাহেবকে নিয়ে এলেন, যেহেতু সে জানতো আমি কোথায় আছি। 

তারপর সেখান থেকে পাঁচজনে আমরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গেলাম। ওয়াহিদুল হক সাহেব, কমল সিদ্দিকী, লিটু বলে একজন ছিল, পরে ইউএনওতে চাকরি করেছিল, আর একজন ছাত্র- ইকবাল বাবু। তো আমরা পাঁচজন মিলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে মাগুরায় গেলাম, কারণ আমরা জানতাম, সেখানে একজন বাঙালি এসডিও (সাবি ডিভিশনাল অফিসার) স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে একটি গ্রুপ সংগঠিত করেছে। 

কমল সিদ্দিকী, যে পরে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হয়েছিল, সে ছিল নড়াইলের এসডিও। আর মাহবুব ছিল ঝিনাইদহের এসডিপিও। তারপর এখনকার যে বিদ্যুত উপদেষ্টা, তৌফিক এলাহী, ও ছিল মুজীব নগরের কাছের একটা যায়গা, নামটা ভুলে যাচ্ছি, ওখানকার এসডিপিও। তো এরা কয়েকজন মিলে একটা মুক্তিযুদ্ধ অর্গানাইজ করছিল, আমাদের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ ছিল, আমরা যেয়ে ওদের সঙ্গে যোগ দিলাম। 

আমাদেরকে ওরা পাঠালো ইন্ডিয়ায়। আমাকে বললো, আপনার সঙ্গে তো ওদের যোগাযোগ আছে, দেখেন তো কিছু অস্ত্র যোগাড় করতে পারেন কিনা! আর ওরা তখন এখানে দুই লাখ লোক নিয়ে যশোর ক্যান্টমেন্ট ঘিরে রেখেছে, লাঠি-সড়কি নিয়ে। 

তো পাকিস্তানি সেনাবাহিনি তখন খাওয়া-দাওয়া করতে পারছে না, কারণ খাবারের অভাব, পানির অভাব, সবকিছুর অভাব। তারা শেষ পর্যন্ত সাতদিন পরে খাবারের খোঁজে প্রাণের দায়ে অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। ওরা ভেবেছিল, এরা এতো লোক দিয়ে ঘিরে রেখেছে, নিশ্চয়ই ইান্ডিয়ান আর্মি পেছনে আছে, আমরা বেরোলেই এরা আমাদের মেরে ফেলবে। কিন্তু বেরিয়ে পড়ে এরা দেখে ইন্ডিয়ান আর্মি-টার্মি তো কিছু নাই! এরা তো লাঠি-সড়কি নিয়েই ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে রেখেছে!

যাই হোক, আমাদের তো পাঠালো, কিন্তু আমরা অস্ত্র জোগাড় করতে পারলাম না। তাজউদ্দীন সাহেব তখন দিল্লি চলে গিয়েছেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। উনি পাঁচ এপ্রিল ফিরলেন। তাজউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। দশ তারিখ সরকার গঠন হলো, সতের তারিখ হলো শপথ গ্রহণ। তখন আমরা তাজউদ্দীন ভাইয়ের কাছে গেলাম যাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গঠন করতে পারি।    

 

গ্লিটজ: স্বাধীন বাংলা বেতারে আপনি সালেহ আহমেদ নামে সংবাদ পাঠ করতেন। ওই সময়ে আমরা পড়েছি, পাকিস্তান সরকার আপনার মাথার মূল্য বেঁধে দিয়েছিল...

হাসান ইমাম: আমিও শুনেছি। কিন্তু কী মূল্য বেঁধেছিল, তা জানি না... (হাসি)। দেশে ফেরার পরে আমার বন্ধু গোলাম মোস্তফা আমাকে বলেছিল, মেজর সালেক বলে একজন ছিলেন যিনি পঁচিশে মার্চের পর থেকে দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তান সরকারের তরফ থেকে সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে। তিনি নাকি গোলাম মোস্তফাকে বলেছিলেন, ‘আপ হাসান ইমামকো ইধার লে আইয়ে, আপকো হাম ইন্ডিয়া ভেজ দেঙ্গে’! মোস্তফা ভাই পরে সেটা আমার কাছে গল্প করেছিলেন। (হাসি)

আমাকে তো আনতে পারেনি, কিন্তু বেচারা মেজর সালেক পরে পাকিস্তানের যে প্রেসিডেন্ট প্লেন ক্র্যাশে মারা গিয়েছিলেন, জিয়াউল হক, একই সঙ্গে সেই প্লেনে সেও মারা গিয়েছিল। কিন্তু বেঁচে থাকতে আমাকে আর ধরতে পারেনি।

গ্লিটজ: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দিনগুলির কথা জানতে চাই।

হাসান ইমাম: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একদম শুরু থেকে, এর প্রস্তুতি পর্বেই আমরা যুক্ত হই। এবং তাজউদ্দীন সাহেব মান্নান সাহেব নামের একজন ছিলেন আমাদের টাঙ্গাইলের, তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে আলোচনা করে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গঠন করলাম। আর যারা বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গঠন করেছিল সাতাশে মার্চে চট্টগ্রামে, ওরা আগরতলায় এসেছিল পরে, ওরাও আমাদের সঙ্গে যোগ দিল কলকাতায়। তারপর ঢাকা বেতার থেকে অনেকে গিয়েছিলেন, তারাও যুক্ত হলেন; রাজশাহী বেতার থেকে গিয়েছিলেন যারা, তারাও যুক্ত হলেন। 

আমরা যারা প্রথম দিকে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছিলাম, সরকার থেকে তাদের কিছু ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছিল। তাজউদ্দীন সাহেবের একটা ছদ্মনাম ছিল, মান্নান সাহেবের একটা ছদ্মনাম ছিল। আমার যেমন সালেহ আহমেদ, মান্নান সাহেবের তেমন আহমদ রফিক। তারপরে আলমগীর কবীরের একটা ছদ্মনাম ছিল।

তার কারণ ছিল, আমরা প্রকাশ্যে কিছু কাজ করছিলাম কলকাতা থেকে, আবার মুজীবনগর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র চালাচ্ছিলাম। অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের পর আমরা তো আর মুজীবনগরে ছিলাম না, আমরা কলকাতায় চলে এসেছিলাম। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সুচিত্রা সেন-এর পাশের বাড়িটাই পরে হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র। 

পাকিস্তান প্রচার করতো এগুলো সব ভারতই করাচ্ছে। সেকারণে আমাদের এই ছদ্মবেশ ধারণ করত হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু যখন প্রকাশ্যে এসে যায়, তখন আর আমরা ছদ্মনামটা গ্রহণ করিনি। সেকারণে আমি খবর পড়তাম সালেহ আহমেদ নামে আর কলকাতায় মিটিং মিছিল যেগুলো করতাম, সেগুলো ছিল স্বনামে।

গ্লিটজ: ওই সময়ে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ চলচ্চিত্রটি তৈরি করছিলেন জহির রায়হান....

 

হাসান ইমাম: না না না... এটা ভুল খবর। ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নয়, ছবিটা ছিল ‘স্টপ জেনোসাইড’। ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ তো জহির রায়হান এখানে আরম্ভ করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি। ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছবিটা সেসময়ে আমরা তৈরি করেছিলাম। আমরা একটা সমিতি তৈরি করেছিলাম, জহির রায়হান ছিলেন প্রেসিডেন্ট, আমি ছিলাম সহ-সম্পাদক, ‘বাংলাদেশ কলাকুশলী ও শিল্পী সমিতি’ নামে। 

এই সমিতির পক্ষ থেকে আমরা তখন ইস্ট ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন নামে পূর্ব অঞ্চলে যে সংগঠনটি ছিল ভারতের, তারা আমাদেরকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল। পরামাণিক নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন ওই সংগঠনের সেক্রেটারি, তিনি আমাদের ১৬ হাজার টাকা দিলেন। সেই টাকা দিয়ে জহির রায়হান ছবিটি তৈরি করেন। 

আরেকটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা দরকার ইস্ট ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের কাছে। আমি যেয়ে তাদেরকে ধরলাম, (আমার যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কিছু যোগাযোগ ছিল) আমরা তো একশ’ তেত্রিশটা পরিবার চলচ্চিত্রের, আমরা এখানে এসে খুবই অর্থকষ্টে আছি, আপনারা যদি কিছু আর্থিক সহায়তা করেন। পরামাণিক বাবু তখন আমাকে চিফ সেক্রেটারির কাছে নিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে কথা বলে আমি তাকে সম্মত করালাম। তারা দশ হাজার টাকা প্রতি মাসে দিতে রাজি হলেন, যে টাকাটা ভারতের চলচ্চিত্র-শিল্পীরা মিলে সরকারকে দিয়েছিল, সেই টাকা থেকে আমাদের দুর্দিনে সাহায্য করা হলো। 

ওই টাকা থেকে বিবাহিত যারা, তারা দু’শো টাকা করে মাসে আর অবিবাহিত যারা তারা একশ টাকা করে মাসে ভাতা পেত। এখন একশ-দু’শো টাকা শুনতে অনেক কম লাগে, কিন্তু সেইসময় এই টাকায় একটা পরিবারের মাসের খরচ চলে যেত।

গ্লিটজ: একাত্তরের পরেও কিন্তু আপনাদের লড়াই শেষ হয়ে যায়নি....

হাসান ইমাম: মুক্তিযুদ্ধের পরে যখন দেশে ফিরলাম, তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করলাম। বঙ্গবন্ধু তো খুব ঘনিষ্ঠভাবে আমাদের আদর করতেন। তিনি আমাদের বললেন শিল্পকলা একাডেমি গঠন করতে। আমাদের সাংস্কৃতিক বিপ্লব করতে হবে। ২৩ বছর ধরে পাকিস্তান যে অপপ্রচার করেছে, মানুষের মনে যে বিষবাষ্প ঢুকিয়েছে, সেটাকে পরিস্কার করে সবাইকে ‘সোনার মানুষ’ করতে হবে।

আমাকে বললেন, ‘তুই ইউসুফ আলির কাছে যা।’ ইউসুফ আলি সাহেব তখন শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রী। তিনি বললেন, ‘ওখানে আমার কথা বল। আমি বলেছি, তোরা শিল্পকলা একাডেমি গঠন কর।’

তখন আমি ইউসুফ আলি সাহেবের কাছে গেলাম। পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল যে জায়গাটাতে ছিল, সে জায়গায় শিল্পকলা একাডেমি গঠিত হলো।

তারপরে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমাদের এখানে ছেলে গড়তে হলে তো ভাল শিক্ষায়তন গড়তে হবে। আমরা তো সব স্বশিক্ষিত লোকজন। তিনি আমাকে আবার ইউসুফ আলি সাহেবের কাছে পাঠালেন, উনার কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে আমি দিল্লি চলে গেলাম। সেখানে আমি নুরুল আহসান সাহেবের সঙ্গে দেখা করলোম। তিনি ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর এডুকেশন মিনিস্টার। তার সঙ্গে বসে আমরা ৭২ টা স্কলারশিপ জোগাড় করলাম। ১৭ টা সংস্কৃতিতে এবং বাকিটা উচ্চশিক্ষায়। এই সংস্কৃতি স্কলারশিপে যাদেরকে পাঠালাম তখন, তারাই এখন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয় যে, সেসময় আমরা এটা চিন্তা করেছিলাম।

এভাবেই আমরা একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্ত ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সবকিছু উল্টে গেল। আবার সেই পাকিস্তানি চিন্তাধারায় সবকিছু ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেন জিয়াউর রহমান। তিনি তার সঙ্গে আবার জামাতিদের নিয়ে আসলেন, মুসলিম লীগারদের নিয়ে আসলেন। সরকার বদল করলেন। আমরা তখন আবার একটা বিপদের মুখে পড়লাম। 

আমরা তখন আবার সাংস্কৃতিক আন্দোলন করছি। উদিচীর মাহমুদ সেলিম তখন প্রথম একটি গীতিনাট্য, সেটাতেই প্রথম বঙ্গবন্ধুর কথা প্রথম উচ্চারণ করলো শিল্পীরা। সেটার নামটা ভুলে গেছি এখন। তো সেই নাটক নিয়ে সারা বাংলাদেশে তারা ঘুরে বেড়াতে আরম্ভ করলো। আমরা ছায়ানটের বৈশাখের অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়েছি। ছায়ানট, উদিচী ছাড়াও সৃজনী নামের একটা দল ছিল, তারাও সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে নাটক করে বেড়াতো।

তখন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গঠিত হলো। তখন গ্রুপ থিয়েটারের ছেলেরাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নাটক করছে। এভাবে আমরা একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলাম, যাতে সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী সরকার সরিয়ে নতুন এক সরকারের আসার পথ তৈরি করা যায়।

তো সেই সময়ে গোলাম আযমকে জিয়াউর রহমান দেশে আসার ভিসা দিয়েছিলেন, পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে সে এসেছিল। খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে এসে গোলাম আযম নিজ নামে পার্টির নেতা হলো, এর আগে সে আব্বাস আলিকে সামনে রেখে পেছন থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। যখন সে নিজেকে জামাতের আমির হিসেবে ঘোষণা করলো (আমাদের সংবিধানে আছে যে কোনো বিদেশি নাগরিক এখানে রাজনীতি করতে পারবে না), গোলাম আযম তো তখনও পাকিস্তানি নাগরিক। এই আমরা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করলাম। তখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহাদ চৌধুরি ছিল সভাপতি, সেও আরেকটা সংগঠন করলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি। তারপর ছাত্ররা এসে বললো, দুটো কেন্দ্র থেকে আন্দোলন করতে গেলে ভাগাভাগি হয়ে যাবে, আপনারা মিলে যান। এই মিলে যেয়ে আমরা জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়ন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করলাম। গোলাম আযমের নাগরিক আদলতে বিচার করলাম। সেই বিচার ছিল ঐতিহাসিক।

 

গ্লিটজ: স্বাধীনতার পর মঞ্চে কিংবা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ অনেক উঠে এলেও সিনেমায় কিন্তু সেভাবে আসেনি। আপনি যেটা বলছিলেন, পঁচাত্তরের পর বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলিয়ে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা চলছিল। সেই প্রয়াস কিন্তু এখনও বিরাজমান। এটাকে নতুন প্রজন্ম কতটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?

হাসান ইমাম: বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর তাকে ধরে নাট্যকর্মীরা নাটকের সেন্সর প্রথাটা তুলে দিয়েছিল। কিন্তু চলচ্চিত্রে তো সেন্সর প্রথা ওঠেনি। আর সেন্সর নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। তো সরকার যদি মুক্তিযুদ্ধের ছবি হোক- এটা না চায়, তাহলে তা করা খুব মুশকিল। নাটক করা যায়, কিন্তু চলচ্চিত্র করা মুশকিল। 

এমনও হয়েছিল, আমার মনে আছে, জিয়াউর রহমানের একটা মৌখিক নির্দেশে, তার ক্ষমতায় আসার আগে যত চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধুকে দেখানো হয়েছিল, বা তার কিথা ছিল, তার সব বাদ দিতে হয়েছিল। আমাদেরকে বাধ্য করা হয়েছিল। আমাদেরকে করতে হতো কি, যেসব দৃশ্যে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল, (বিশেষ করে কোর্ট-সিনগুলোতে যেখানে জাতির পিতার ছবি থাকা বাধ্যতামূলক) সেগুলোকে আলপিন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছবিগুলো তুলতে হতো। সেগুলো চিকচিক-ঝিকঝিক করতো যখন ছবি দেখানো হতো। আর সেটাতে আরও সুবিধা হয়েছিল! লোকে দেখলেই বলতে পারতো, ওই যে ওখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল! (হাসি)

এখন, চলচ্চিত্রে তো প্রচুর টাকা লগ্নি করতে হয়। একটা লোক যখন নিশ্চিতভাবে জানে যে সরকার এধরণের ছবি পছ্ন্দ করছে না, সেন্সর বোর্ডে যদি বাতিল করে দেয়, তাহলে আমার পুরো টাকাটা মার যাবে। এই অবস্থায় তো ছবি করা যায় না! 

ছবি করতে হলে স্বাধীনতা দরকার। মনের মতো ছবি করতে হলে একটা স্বাধীন পরিবেশের দরকার। সেজন্যই, মুক্তিযুদ্ধের পর কিছু ছবি হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ওরকম বৈরি পরিবেশে আর সেরকম ছবি হতে পারেনি। দুয়েকটা হয়েছিল, ‘কলমিলতা’ বলে একটা ছবি হয়েছিল জিয়াউর রহমানকে হাইলাইট করে। বাকিদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছবি তৈরি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। 

আবার যখন পরিবেশ ফিরে এলো, এখন আবার আমরা মুক্তিযুদ্ধের ছবি করতে পারছি। এখন যথেষ্ঠ ছবি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের উপরে। 

গ্লিটজ: চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের একজন আপনি। ওই সময়ের প্রতীভাবান অনেক নির্দেশকের সঙ্গে কাজ করেছেন আপনি। তাদের মধ্যে একজন খান আতাউর রহমান। যদিও, মুক্তিযুদ্ধে তার অবস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, আমরা আপনার মুখ থেকে সে ব্যাপারে শুনতে চাই।

হাসান ইমাম: খান আতাউর রহমান-এর সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তার একটি ছবিতে অভিনয় করে ১৯৬৫ সালে সারা পাকিস্তানে সাতচল্লিশ থেকে চৌষট্টি পর্যন্ত যত সিনেমা হয়েছিল, তার একটি কম্পিটিশনে আমি সেরা অভিনেতার পুরস্কার পাই। ছবিটা হলো ‘অনেকদিনের চেনা’। আরেকটি খান আতা’র ছবি, ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’, সেটা ছিল উর্দু ছবি, সেটি পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে যায় মস্কো ফেস্টিভালে। দেব আনন্দ সেটার জুরি বোর্ডের মেম্বার ছিলেন। দেব আনন্দ বেরিয়ে এসে বলেন, ‘ইউ হ্যাভ মিসড দ্য বাজ বাই ওয়ান ভোট’, মানে এক ভোটের জন্য আমি সেরার পুরস্কার পাইনি! 

সেইজন্য আমি কৃতজ্ঞ খাত আতা’র কাছে। তার পরিচালিত দুটি ছবিতেই আমার উল্লেখযোগ্য অভিনয় আছে। কিন্তু যেহেতু তিনি মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পক্ষে ছিলেন না, এবং পাকিস্তানের পক্ষে টেলিভিশনে কাজ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের ছেলেরা তার বাড়ি আক্রমণ করেছিল, তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। ফলে আমার সঙ্গে সম্পর্কটা আর সেরকম থাকেনি। 

তিনি খুব প্রতীভাবান লোক ছিলেন। কিন্তু আনফরচুনেটলি মুক্তিযুদ্ধ তো একটা মেরুকরণ করে দিয়েছে; তাতে আমরা যেদিকে গিয়েছি, তিনি তার উল্টোদিকে পড়ে গিয়েছিলেন। ফলে আমার সঙ্গে আর সেরকম সখ্যতা ছিল না। 

তবে তিনি অবশ্যই প্রতীভাবান লোক ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের উপরও অনেক ভাল ভাল গান লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের একটা ছবি, যেটার আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম, ‘আবার তোরা মানুষ হ’ তৈরি করেছিলেন। এ নামটা আমাদের পছন্দ হয়নি, আমরা আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু তিনি কোনোভাবে সেন্সর থেকে পাশ করিয়ে নিয়েছিলেন। এটাতে দেখানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ছেলেরা বখে গেছে এবং তাদেরকে আবার মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। আমরা যেন অমানুষ হয়ে গেছি মুক্তিযুদ্ধ করে! এই নামটিতেই আমার খুব আপত্তি ছিল, এখনও আছে। এখনও সরকাকে বলবো এই নামটি নিষিদ্ধ করার জন্য। কিন্তু ছবিটি ভাল হয়েছিল। ছবিটি খারাপ করেননি!

আরও মুক্তিযুদ্ধের উপর ছবি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের উপর তিনি খুব ভাল ভাল গান লিখেছেন। সেজন্য আজকালকার ছেলেরা মনে করে মুক্তিযুদ্ধে তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন, কিন্তু আসলে তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন না।

গ্লিটজ: মাঝখানে জোট সরকারের আমলে আপনাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল... ওই সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল?

হাসান ইমাম: আমাকে চারবার হত্যা করতে গেছে। চারবারই আমি বেঁচে গেছি। তো পঞ্চমবার বাঁচবো কিনা, সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম না বলেই দেশ থেকে চলে যেতে হয়েছিল। (হাসি)

আসলে আমি স্থায়ীভাবে দেশ থেকে চলে যাব, সেটা ভাবিনি। আসলে জোট সরকার যখন নির্বাচনে জয়যুক্ত হলো, আমাদের পক্ষের ইন্টালিজেন্সের লোক আমাকে এসে বললো, ‘আপনার উপর ওদের খুব রাগ আছে, আপনাকে রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করা হতে পারে। তো ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই আপনি বিদেশে চলে যান’।

আমার তখন কানের একটা অপারেশন করানোর জন্য কলকাতায় যাওয়ার কথা ছিল, তো আমি বাইরে চলে গেলাম। এরমধে ইনকিলাবে প্রথম দিনেই লিখলো, ‘হাসান ইমাম পালাইলেন’! (হাসি)

তারপরই যে লেখালেখি শুরু হলো, তাতে আর আমার দেশে ফেরা হলো না। তবে আমি সেসময় কিন্তু নিষ্ক্রিয় থাকিনি। আমি পশ্চিমবঙ্গে ভাষাশহীদ স্মারক সমিতি নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম, যেটাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সভাপতি ছিলেন। এটাতে আমি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও অনেক কবি-সাহিত্যিকরা যুক্ত হয়ে সারা পশ্চিবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালি সংস্কৃতি- এসব সম্পর্কে।

তারপরে আমি যখন লন্ডনে গেলাম, আমাদেরকে নিয়ে গেলেন আব্দুল গফফার চৌধুরি। বঙ্গবন্ধু হত্যার উপরে একটা নাটক লিখেছিলেন, ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’, ইংল্যান্ডে গিয়ে আমি সেটার পরিচালনা করলাম। আমার স্ত্রী (লায়লা হাসান) বেগম মুজীবের চরিত্রে অভিনয় করলেন। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে গিয়েছিলো এখান থেকে, সে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করলো। বাকি সব ওই লন্ডনের প্রবাসী বাঙালি, তাদেরকে তৈরি করে এটাতে অভিনয় করালাম। নিউইয়র্কেও এটা দুবার অভিনয় করালাম। 

তো এভাবেই, আমি যে সাত বছর নিষ্ফলা কাটিয়েছি, তা কিন্তু না। সেসময়ও খুব সক্রিয় ছিলাম। দুটো নাটক লিখলাম আমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর যে অত্যাচারের কাহিনি, সেটা নিয়ে একটি। আরেকটি আমার জীবনের অভিজ্ঞতার উপরে। এই দুটি নাটক নিউইয়র্কে আমি পরিচালনা করলাম। বাঙালিদের মধ্যে খুব আলোড়ন তুলেছিল।

এখানে তখন যে সরকার গঠিত হয়েছে, তার মধ্যে জামাত নিজে যুক্ত ছিল। জামাত যুক্ত থাকার ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, যেমন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জামাতের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এবং আব্দুল আলীমের মতো মুসলিম লীগার যারা, তারাও বিএনপি’র মন্ত্রী হয়েছিল। এইখানে স্বাধীনতা বিরোধীরা তখন মন্ত্রী হয়ে গেছে। এবং গণহত্যাকারীরা, যাদের পরে বিচার হয়েছে, ফাঁসিও হয়েছে অনেকের- তারা সব মন্ত্রী। তো তাদের শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের কীরকম অবস্থা হতে পারে, তা বুঝতেই পারছেন। বঙ্গবন্ধুর নামও উচ্চারণ করা যেত না। মিটিং-মিছিল করা যেত না। বহু ছেলে এদেশ থেকে পালিয়ে আবার ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমাকে একজন বলেছিল, শুধু কলকাতার আশেপাশেই প্রায় ১৬ হাজার ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের যুবক ছেলেরা আশ্রয় নিয়েছিল।

এখানে হিন্দুদের উপরে অত্যন্ত অত্যাচার করা হয়েছে, শুধু হিন্দু না, সংখ্যালঘুদের উপরে, আওয়ামী লীগের উপরে। যেরকম মুক্তিযুদ্ধের সময়ে করা হয়েছিল, বেছে বেছে আওয়ামী লীগ আর হিন্দুদের মেরে ফেলা।

এর থেকে যে আমরা উত্তরণ করতে পেরেছি, এটা আমাদের সৌভাগ্য।