বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট : পুরোনো গল্পে নতুন চমক

বইয়ের পাতা থেকে গল্প যখন বড় পর্দায় আসে, তখনই তা কেমন হবে, সেটা নিযে জল্পনা কল্পনার শেষ থাকে না। সেই একই উত্তেজনা কাজ করে অ্যানিমেশন থেকে লাইভ অ্যাকশনে কোনো সিনেমা তৈরি হলেও। তবে ডিজনির সদ্য মুক্তি পাওয়া লাইভ অ্যাকশন সিনেমা ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’ ঘিরে ছিল অন্যরকম এক উন্মাদনা।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2017, 01:23 PM
Updated : 19 March 2017, 01:42 PM

এই উন্মাদনার সবটুকুই ছিল সিনেমার প্রধান নারী চরিত্র বিউটির ভূমিকায় এমা ওয়াটসনকে নেওয়ায়। ‘হ্যারি পটার’-এর কাল থেকেই ব্রিটিশ এই অভিনেত্রী তৈরি করেছেন নিজস্ব এক ভক্তশ্রেণি। এই সিনেমার জন্য তিনি ফিরিয়ে দেন ‘লা লা ল্যান্ড’-এর মতো সিনেমাকেও। আর তাই বাস্তব জীবনের এমার মতোই বই পড়ুয়া এক সুন্দরীর ভূমিকায় পর্দায় তাকে কেমন মানাবে- তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন সবাই।

লাইভ অ্যাকশন সিনেমার বেলায় মূল অ্যানিমেশনের আমেজ নষ্ট হওয়ার ভয় সবসময়ই রয়ে যায়। বিশেষ করে সেই অ্যানিমেশন যদি হয় ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’-এর মতো ক্লাসিক! তাই এমাকে নিয়ে আশার পারদ উঁচুতে থাকলেও শঙ্কার খাদটাও কম গভীর ছিল না।

তবে এমা ওয়াটসন শঙ্কার সেই খাদ পার হয়েছেন সাবলিল পদাঙ্কেই। অভিনয় ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’ একটি মিউজিক্যাল হওয়ায় এমার সংগীত প্রতিভারও পরিচয় মিলেছে এতে। কেবল সুন্দরী এক ডিজনি প্রিন্সেস হিসেবেই নয় এমাকে এই সিনেমায় পাওয়া গেছে ব্যক্তিত্বপূর্ণ বুদ্ধিমতি এক নারীর চরিত্রে।

এমা ওয়াটসনের কাছ থেকে এই চরিত্রে সু অভিনয়টা ছিল প্রত্যাশিতই। কিন্তু দর্শকদের জন্য চমক হিসেবে ছিল বিস্ট-এর চরিত্রে ড্যান স্টিভেন্স-এর অভিনয়।

ড্যান স্টিভেন্স-এর জন্য কাজটা সহজ ছিল না মোটেই। প্রথম দৃশ্যেই তাকে দেখানো হয়েছে হৃদয়হীণ এক নিষ্ঠুর যু্বরাজের ভূমিকায়; সেখান থেকে ভয়ঙ্কর দর্শন এক পশুর চেহারা নিয়েও দর্শকের কাছে কেবল অভিনয়ের জোরে নিজের চরিত্রকে করে তুলেছেন প্রিয়। সত্যি বলতে, সিনেমার নিরিখে, এমা ওয়াটসনের বিউটির চাইতে ক্ষেত্রবিশেষে বিস্টকেই সফলভাবে বিকশিত চরিত্রে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন ‘ডাউনটাউন অ্যাবি’ খ্যাত এই অভিনেতা।

নির্মাণের দিক থেকে ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’-এর পরিচালক বিল কনডন কোনো ঝুঁকি নেননি। ডিজনির আগের লাইভ অ্যাকশন ছবি ‘সিন্ডারেলা’ কিংবা ‘দ্য জঙ্গল বুক’-এর মতো মূল গল্প থেকে সরে এসে নয়, বরং মূলের অনুকরণ করেই নতুন সিনেমাটি তৈরি করেছেন তিনি। আর তাই ১৯৯১ সালের মূল ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’-এর অনেক দৃশ্যের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় নতুন সিনেমার সিংহভাগ।

এই মিল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিনেমাটিকে সফল করে তুলতে সাহায্য করেছে, তবে ক্ষেত্রবিশেষে অত্যধিক অনুসরণ প্রতীয়মান হয়েছে ক্ষতিকর হিসেবেও। বিশেষ করে গ্যাস্টনকে উদ্দেশ্য করে শুড়িখানায় লাফোর গাওয়া গানটির দৈর্ঘ একটা পর্যায়ে গিয়ে বিরক্তিকরই ঠেকেছে।

তবে মূল চলচ্চিত্র থেকে ব্যাতিক্রমী কিছুই যে একেবারে করেনি নির্মাতারা তা নয়। সিনেমার এক পর্যায়ে দেখা যায় বেল-এর ছোটবেলা; প্লেগ আক্রান্ত প্যারিস ছেড়ে কীভাবে কূপমণ্ডুক এক গ্রামে এসে বাসা বাধতে হয় বেল ও তার বাবা মরিসকে, দেখানো হয় তাও। একমনকী ‘ডেইজ ইন দ্য সান’ গানটির সময়ে একঝলকের জন্য দেখানো হয় ‘বিস্ট’ যুবরাজের ছেলেবেলাও; মায়ের অভাব এবং স্বেচ্ছাচারী বাবার সান্নিধ্য কীভাবে এক কোমল শিশুকে তার নিষ্ঠুর এক তরুণে রূপান্তরিত করে, দৃশ্যটিতে ব্যাখ্যা মেলে তারও। এই ছোট্ট দুটি গল্প সিনেমার মূল দুই চরিত্রকে দর্শকদের চোখে বিকশিত হতে সাহায্য করেছে দারুণ। আর সে জন্য চিত্রনাট্যকার স্টিফেন শাবোস্কি এবং ইভান স্পিলিওটোপিউলাস আলাদা করে ধন্যবাদ পেতেই পারেন!

মূল গল্প থেকে আরও একটি জায়গায় সরে যান পরিচালক; আর সেখানেই সিনেমাটি নিয়ে তৈরি হয় সবচেয়ে বড় বিতর্কের। সিনেমা একটি চরিত্র, লাফোকে দেখানো হয়েছে সমকামী হিসেবে যে কীনা ভিলেন গ্যাস্টনকে মনে মনে কামনা করে। সরাসরি কোনো সমকামীতা না দেখালেও এক পুরুষের অন্য আরেক পুরুষের প্রতি আসক্তি মেনে নিতে পারেননি অনেকেই; যে কারণে অনেক স্থানে সিনেমাটিকে নিষিদ্ধও করা হয়েছে।

তবে হাস্য কৌতুকের আড়ালে সমাকামীতাকে খুবই হালকাভাবে তুলে আনায় বিষয়টি ঠিক কীভাবে ‘কোমলমতি দর্শকদের জন্য ক্ষতিকর’- সেটা বোঝা যায়নি। বরঞ্চ জশ গ্যাড-এর প্রাণবন্ত অভিনয়ে পুরো বিষয়টি বেশ উপভোগ্যই ঠেকেছে শেষ পর্যন্ত।

এমা থম্পসন, ইওয়ান ম্যাকগ্রেগর, ইয়ান ম্যাকক্যালেন এবং স্ট্যানলি টুচ্চিদের মতো শক্তিমান অভিনেতারা পার্শ্বচরিত্রে থাকায় প্রাণ পেয়েছে ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’। তবে সবচেয়ে ভাল লাগবে বেল-এর বাবা মরিস-এর চরিত্রে কেভিন ক্লাইন-এর অভিনয়। গ্যাস্টনের চরিত্রে লুক ইভান্সের হামবড়া মেলোড্রামাও ছির যথাযথ।

নির্মাণশৈলীতে ভুল একেবারে হাতে গোনা। বিল কনডন প্রমাণ করেছেন তার পরিচয় ‘টোয়াইলাইট’-এর মতো সিনেমা নয়, বরঞ্চ ‘ড্রিমগার্লস’, ‘গডস অ্যান্ড মনস্টারস’-এর মতো সমালোচক-প্রিয় সিনেমা। কোরিওগ্রাফিও ছিল দারুণ, ঠিক যেমনটি একটি মিউজিকাল লাইভ অ্যাকশন সিনেমায় হওয়া দরকার।

মূল ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’-এর জন্য ১৯৯১ সালে অস্কার জিতেছিলেন সংগীত পরিচালক অ্যালেন মেনকেন। এবারও সুরের জাদুতে দর্শকদের ভুলিয়েছেন তিনি। তবে সেলিন ডিওন আর পিবো ব্রাইসন-এর থিমসং-এর তুলনায় জন লেজেন্ড আর আরিয়ানা গ্রান্ডে’র নতুন গানটি যে ছিল নেহাতই সাদামাটা, এ কথা বলতেই হচ্ছে।

‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’ দেখতে গিয়ে সময়টা কাটবে ভালোই। ডিজনির সর্বকালের সেরা ধ্রুপদ গল্পটি পর্দায় আবার কীভাবে মূর্ত হলো, সেটা দেখতে বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্সে তাই একটা ঢুঁ মেরে আসাই যায়!