সোলসে কাটিয়েছি সোনালি দিন: তপন চৌধুরী

তপন চৌধুরী, চল্লিশ বছর আগে সোলস-এর হাত ধরে গানের জগতে যার পথচলার শুরু, দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন পর্দার আড়ালে। তার চিরসবুজ গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরলেও একযুগ ছিলেন নিরব। তবে সুদিন ফিরেছে আবারও। নতুন গান নিয়ে ফিরেছেন তিনি। তার গানের জগতে উঁকি দিতেই এক সকালে গ্লিটজ হাজির তার দিলু রোডের বাসভবনে। সেই আড্ডারই নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো এখানে।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 March 2017, 03:56 PM
Updated : 7 March 2017, 03:46 AM

গ্লিটজ: চল্লিশ বছর ধরে গানের জাদুতে সবাইকে ভুলিয়ে আসছেন। আমরা জানতে চাইবো, চল্লিশ বছর আগে আপনার গানের যাত্রাটা কীভাবে শুরু হয়েছিল?

তপন চৌধুরী: চল্লিশ বছর ধরে কাউকে ভুলিয়ে রাখতে পারিনি...(হাসি)। প্রথম যখন গান করতে আসি, তখন তো কাউকে ভোলাতে পারিনি, তখন সবে শুরু। গান করেছি, গান করছি, শুরু করেছি; তখন মানুষ আস্তে আস্তে গ্রহণ করেছে, পরবর্তী ‌পর্যায়ে। আর চল্লিশ বছরের ক্যারিয়ার বলবো, ভাল-খারাপ মিলিয়েই তো মানুষের সবকিছু। প্রথমদিকে নিজেদের গান ছিল না, মানুষের গান করতাম। আমাদের গান হলো, মানুষ গ্রহণ করলো। চল্লিশ বছর ধরে গান শুনছে মানুষ, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর নেই।

সোলস-এর সঙ্গে তপন চৌধুরী। ছবিটি শিল্পীর অনুমতিক্রমে তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সংগ্রহ করা

গ্লিটজ: সংগীতের প্রতি আপনার আগ্রহের শুরু করে থেকে?

তপন চৌধুরী: আসলে সংগীতে আমার পরিবার থেকেই মূল সহযোগিতা পাই। পরিবারের সবাই গান পছন্দ করে, সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকের সঙ্গে যুক্ত। আমার যারা গার্জিয়ান ছিল, তাদের ইন্সপিরেশন, আমার যারা কাকা, শুভানুধ্যায়ী, আমার যারা টিচার, আমার যারা গাইড- তাদের শুভেচ্ছা, তাদের সহযোগিতা, তাদের অনুপ্রেরণাতেই এই ‌পর্যায়ে আসতে পেরেছি।

এগুলো প্রথম দিকের কথা বলছি। পরবর্তী প‌র্যায়ে আমি এলাম সোলস-এ। সোলস-এ আমাকে নিয়ে এসেছেন সুব্রত বড়ুয়া রনি। তিনি তখন ‘সুরেলা’য় ছিলেন, ‘সুরেলা’য় পারকাশন বাজাতেন। পারকাশন বলতে কঙ্গো, বঙ্গো- এগুলোই প্রথম দিকে ছিল। পরবর্তীতে ড্রামস। এই করতে করতে উনিই আমাকে সোলস-এ নিয়ে আসলেন।

আমার মনে হয়, আমার গান-বাজনা এবং সিঙ্গার হওয়ার পেছনে মূল ইন্সপিরেশন সোলস এবং রনিদা। অন্যান্য যারা সোলস-এ ছিল, তারাও নিশ্চয়ই।

কিন্তু সবচেয়ে বেশি বলবো যে, মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, তাদের ইন্সপিরেশন পেয়েছি, সহযোগিতা পেয়েছি। এ পর্যন্ত আসার পেছনে পরিবার ছাড়া যাদের মূল ভূমিকা, তারা হলো- সোলস, আমার গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, ফিল্ম ডিরেক্টর (যাদের ছবিতে গান করেছি), আমার মিউজিশিয়ান ভাইয়েরা। এবং শেষমেশ আমার পরিবার, আমার সন্তান। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতে এবং আপনাদের সহযোগিতায় এ‌ পর্যন্ত আসতে পেরেছি।

গ্লিটজ: সংগীতের ক্ষেত্রে নিজের গুরু মনে করেন কাকে?

তপন চৌধুরী: প্রথম কথা, আমি গান শিখেছি ওস্তাদ প্রিয়দারঞ্জন সেন-এর কাছে। তিনি গত হয়েছেন, এখন আর নেই। আমার আরেকজন ওস্তাদ এখনও বেঁচে আছেন, তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় মিহির লালা। সঞ্জীব দে’র কাছে আমি কিছুদিন তালিম নিয়েছি। ওস্তাদ মিথুন দে’র সুযোগ্য সন্তান, ওস্তাদ সঞ্জীব দে, উনার কাছেও গান শিখেছি। আর সবার সহযোগিতা তো পেয়েছিই।

গ্লিটজ: সোলস-এ কাটানো দিনগুলি কেমন ছিল?

তপন চৌধুরী: সোনালি দিন! আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আমি আমার টিন-এজ, অর্থাৎ বারো-তেরো বছর বয়স থেকে এই দিকে এসেছি। একটা মানুষের টিন-এজ সময় স্বাভাবিকভাবে যেভাবে কাটে, ওই সময়টা আমি সোলস-এর সঙ্গে গানে গানে কাটিয়েছি। আমার জীবনের সেরা সময়টা আসলে সোলস-এর সাথে এবং পরবর্তী পর্যায়ে আমার সন্তানের সাথে কাটিয়েছি।

সোলস-এর সঙ্গে তপন চৌধুরী। ছবিটি শিল্পীর অনুমতিক্রমে তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সংগ্রহ করা

সোলস আমার জীবনের অনেকটা অংশ জুড়েই আছে। আমি ২২ বছর ধরে সোলস এর সাথে ছিলাম। অনেক কাজ করেছি, গান করেছি। সুখে-দুখে সমস্ত কিছুতেই ছিলাম।

গ্লিটজ: সোলস ছাড়লেন কেন?

তপন চৌধুরী: মূলত যে কারণে সোলস ছাড়লাম, সেটা হলো, তখন সোলস চিটাগং বেইজড ছিল। চিটাগঙে অনুষ্ঠান করার জন্য খালি যেতাম। প্র্যাকটিস করার সময় হলে চিটাগং যাওয়া হতো। আমি তখন নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছি, সলো ক্যারিয়ার, ফিল্মে প্লেব্যাকের ক্যারিয়ার, বিভিন্ন মাধ্যমে স্টেজ শো- সব কিছু মিলেই।

আরেকটি কারণ ছিল, বিদেশে অফার পেতাম বিভিন্ন জায়গায় গান গাওয়ার জন্য। আমার মনে হতো যে, আমি চলে যাচ্ছি, কিন্তু সোলস থেকে তো কেউ যাচ্ছে না। এখন যেমন অনেকেই যায় গিটার একটা হাতে নিয়ে, গ্রুপের জায়গায় সলোও কেউ শো করে আসে। ব্যান্ডের কারো যেতে আমি খুব কম দেখেছি। কারণ, এতোগুলো ভিসা পাওয়া, সেসবের পেছনে এতো এফর্ট দেওয়া, এতোগুলো মানুষের টিকিট দিয়ে ওখানে শো করা- এগুলোও খুব কঠিন ছিল। তারচেয়ে একা একটা গিটার হাতে নিয়ে চলে যাওয়া, ব্যান্ডের যে সিঙ্গার নাম করেছে, তার একার ভিসা পেতেও সুবিধা, যাওয়াটাও সুবিধা।

তো আমার মনে হলো যে, আমিতো ঠকাচ্ছি ওদেরকে। আমি ভিসা পাচ্ছি, আমি যেতে পারছি, আমাকে নিয়েও যাচ্ছে। এমনও হয়েছে, আমি একা গান করছি, অথচ পেছনে ব্যানার লাগিয়ে দিয়েছে, ‘সোলস অ্যান্ড তপন চৌধুরী’। কিন্তু আমিতো আলাদা গান করছি, সোলস তো করছে না।

আর তাছাড়া মানসিকতারও ব্যাপার আছে। আমরা যখন একসঙ্গে কাজ করতাম, যে মানুষগুলোর সঙ্গে কাজ করতাম, সেই মানুষগুলো একে একে চলে গেছে। দেখা গেল, মাত্র একজন দুইজন আছে। চিন্তা করলাম, কাজ করতে গেলে মানসিকতার মিলেরও তো একটা ব্যাপার থাকতে হবে।

এসব চিন্তা করেই, আমি নিজ থেকে বললাম যে আমি সময় দিতে পারছি না, আমাকে ছেড়ে দিলে খুব খুশি হব। এটাই।

কোনো ঝগড়াঝাঁটি না, অন্য কোনো কিছু না, নিজে থেকে বলে-কয়েই ব্যাস! তখন সলো ক্যারিয়ার গড়তে শুরু করলাম।

ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার, বাংলাদেশের খুব কম মিউজিশিয়ান আছেন, যারা একটা ব্যান্ডে কাজ করেছেন। আমার প্রথমও সোলস, শেষও সোলস। এরপর থেকে কোনো ব্যান্ড কিংবা আর কারো সঙ্গে কোনো কাজ করিনি। আমি মনে করেছি, সোলস-এর পরে আর কোথাও যাওয়া উচিৎ না। এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

গ্লিটজ: সলো ক্যারিয়ারে যাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাদেরকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

তপন চৌধুরী: আমার জীবনের সবচেয়ে সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের যত লেজেন্ডারি এবং বিখ্যাত সুরকার, গীতিকার আছেন, তাদের সবার সঙ্গে আমি কাজ করতে পেরেছি। শ্রদ্ধেয় সত্য সাহা, সমর দাস, আনোয়ার পারভেজ সাহেব, আলাউদ্দীন সাহেব, খন্দকার নূরুল আলম সাহেব, সুবল দাস- প্রত্যেকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এটা একটা বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার।

গ্লিটজ: আপনি হচ্ছেন সেই বিরল মানুষদের একজন....

তপন চৌধুরী: বিরল-টিরল কিছু না। আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ। সংগীতকে ভালোবেসেছি। এজন্য গান ছাড়া আর কিছু পারিও না, জীবনে আর কিছু করিওনি। আমি পড়াশোনা করেছি গ্রাফিক্স আর্টসে; পাশ করে চাকরি খুঁজছিলাম, হয়নি। আমি বিরল-টিরল কিছু না, খুব সাধারণ, কিন্তু সংগীতকে ভালোবেসেছি।

গ্লিটজ: আসলে বলতে চাইছিলাম যে, আপনি সেই অতি অল্পসংখ্যক মানুষদের একজন, যিনি ব্যান্ড সংগীত, সলো ক্যারিয়ার এবং ফিল্মে প্লেব্যাক করেছেন। একই মাধ্যম কিন্তু তিনটি আলাদা আলাদ প্রকাশ- এই তিনটি ক্ষেত্রকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করবেন কীভাবে?

তপন চৌধুরী: আসলে জীবনের প্রথম থেকেই আমার জ্ঞানে-ধ্যানে যেটা ছিল, সেটা হলো গানকে কাজ হিসেবে নেওয়া। সিনেমার গান করছি, টেলিভিশনে গান করছি, ব্যান্ডে গান করছি কিংবা সলো গান করছি- এগুলোকে আলাদা করে দেখিনি। গানকে গান হিসেবে দেখেছি। গানের মেলোডি, সংগীত, সুর-এগুলোকে আমার মতো করে একটু ভেবেছি, আর গানকে গান হিসেবেই চিন্তা করেছি।

আমরা সোলস-এ যারা গান করেছি, আমার মনে হয় আমরা এত সুন্দর সুরে ও কথায় গান করেছি... ব্যান্ডের গান এরকম হয় খুব কম। ‘নদীর শেষে পথ’, ‘চাঁদ এসে উঁকি’, ‘মনে কর এখন অনেক রাত’, ‘ভুলে গেছ তুমি’ কিংবা ‘কীর্তিনাশার তীরে বাঁইধাছিনু ঘর’, এই গানগুলোর সাবজেক্ট, লিরিক, সুর, কম্পোজিশন- একদম ব্যাতিক্রমী ছিল, এটা আমি বলবো। এটা আমার বলার অহঙ্কার আছে, অধিকার আছে।

এবং সেইসময়কার ফোক গানের মিশ্রণে, যেমন ‘কান্দো কেনে মন’, ‘আইচ্ছা পাগল মনরে বা’, ‘জ্বালায়া গেলা মনের আগুন’- অনেক গান আছে যেগুলোতে সোলস ফোক এবং মডার্নিটি মিক্স করেছে।

তো ওইজন্য বলি যে কোনো গানকেই আমি আলাদা ভাবছি না। গান গাই, তা সে যে মাধ্যমেই হোক না কেন। আমি রবীন্দ্রসংগীতও গাই, নজরুলসংগীতও করি, পঞ্চকবির গানও করি। সেমিক্লাসিকাল গানও... ট্রাই করি।

আরেকটা জিনিস হলো, আপনি যদি চর্চা করেন, যদি ভাবেন, গানকে আপনি কীভাবে উপস্থান করবেন, গান পুরোপুরি আপনার নিজের উপরই নির্ভর করবে। চাইলে অনেক কিছুই হয়।

গ্লিটজ: চর্চার ব্যাপারটা যখন আসলোই, জানতে চাই, আপনি কীভাবে প্রতিদিন গানের চর্চা করেন?

তপন চৌধুরী: আমি প্রতিদিন চর্চা করিনা- এটা একদম সত্যি কথা। তবে গান প্রতিদিন শুনি, হারমোনিয়াম নিয়ে বসি। প্রতিদিন না হলেও গান তো করি। সেটাও তো একধরণের চর্চা।

আর আমি আসলে খুব গান শুনি। ছোট-বড় সবার গানই শুনি।

গ্লিটজ: আপনার প্রিয় শিল্পী কে?

তপন চৌধুরী: আমার প্রিয় শিল্পীর তালিকা অনেক বড়। মান্না দে’র গান আমার ভীষণ পছন্দ, কথা-সুর সমস্ত কিছু মিলে। অজয় চক্রবর্তীর গান আমার ভাল লাগে। লতাজীর গান আমার জন্য অসম্ভব এক ইন্সপিরেশন। তার গান শুনলেই মনটা কীভাবে যেন উদাস হয়ে যায়। তারপর... হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ডেলিভারি, থ্রোয়িং, শ্যামল মিত্র তো আছেনই। অনেকেরই গান ভাল লাগে। হৈমন্তি শুক্লার গান ভাল লাগে।

বাংলাদেশে নিলুফার ইয়াসমীন আমার খুব প্রিয় শিল্পী। সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা- উনারা তো আছেনই। সুবীর নন্দীর গান আমার ভাল লাগে।

এখন যারা গান গায়, তাদের মধ্যে কুমার বিশ্বজিৎ-এর গান ভাল লাগে। ভাল লাগে শাকিলা জাফর, সামিনা চৌধুরীর গান।

মিতালী মুখার্জীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, সৌভাগ্য হয়েছে, একসঙ্গে গান করেছি একটা অ্যালবামে, ‘নিঃশ্বাসে তুমি, বিশ্বাসে তুমি’।

গ্লিটজ: মাঝখানে বেশ অনেকটা সময়ের জন্য দেশের বাইরে ছিলেন...

তপন চৌধুরী: অনেকটা সময় আসলে দেশের বাইরে ছিলাম না, অনেকদিন আমার কোনো সিডি, অর্থাৎ অ্যালবাম বের হয়নি, যে মাধ্যমটা দিয়ে আসলে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগটা হয়। আমি কিন্তু প্রতিবছরই চলে আসি এখানে। এখানে অর্ধেকটা সময় থাকি, দেশের বাইরে অর্ধেকটা।

তবে বারো বছরের একটা গ্যাপ হয়ে গেছে, সিডি-কাসেটের। সেটাও গুটিয়ে গেছে অলরেডি। সংগীতের চল্লিশ বছরের অনুষ্ঠানে একটা অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে; সেটা হলো ‘ফিরে এলাম’। অ্যালবামটির পাঁচটি গানে সুর করেছেন আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ, সুবীরদা (সুবীর নন্দী), দুটো গানের সুর করেছেন পুলক অধিকারী এবং আরেকটি সেজান মাহমুদ। গীতিকারেরা হলেন, মিলন খান, সাইফুল হোসেন, কবীর বকুল, সেজান মাহমুদ। আর দুটো পুরনো গান আমি ওখানে অ্যাড করেছি।

গ্লিটজ: তো এই একযুগের বিরতিটা কেন ছিল?

তপন চৌধুরী: অ্যাকচুয়েলি... এটা হয়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম ছোট্ট একটা ব্রেক নেব। কারণ একইরকম গান হচ্ছিল, আর আমার বাইরে যাওয়া-আসা, সবমিলিয়ে খুবই দৌড়াদৌড়ির মধ্যে ছিলাম। মেন্টাল স্ট্রেস ছিল, টেনশন ছিল। সবকিছু মিলিয়ে, ভাবছিলাম যে ছোট্ট একটা ব্রেক নিই। তো ওই ব্রেকটা এতবড় হবে- আমি নিজেও ভাবিনি! ব্রেকটা ইচ্ছাকৃত ছিল- এটা বলতে পারেন, তবে এটা অনেক অগোছালো হয়ে গেছে, লম্বা হয়ে গেছে।

তাছাড়া এরমধ্যে অডিও বাজারটাও নষ্ট হয়ে গেছে, পাইরেসি-টাইরেসি সবকিছু মিলে। এখন তো আপনারা সিডি-ক্যাসেটও পাননা, অনলাইনে গান শুনতে হয়। তো এখন এই অনলাইন সুবিধাটা আছে। আমার অনুষ্ঠানটা যারা অর্গানাইজ করেছে, বাংলা ঢোল- তাদের অনুপ্রেরণায় আবার আমি গান করেছি। তাদের সঙ্গে কাজ করে ভাল লেগেছে- এটুকু বললেও আসলে কম হয়ে যায়। যেরকম আয়োজন আর প্রফেশনালিজম নিয়ে তারা কাজ করেছেন- এটা থাকলে গানবাজনা করে আনন্দ পাওয়া যায়, ভাল লাগে।

গ্লিটজ: চল্লিশ বছরে বাংলাদেশের সংগীত জগতে যে বিবর্তন ঘটেছে- এটাকে আপনি কীভাবে দেখবেন? চারদশক আগের সংগীত আর এখনকার সংগীতের তুলনাটা যদি করেন...

তপন চৌধুরী: তুলনা তো অবশ্যই আছে। সময়ের সাথে সমস্ত কিছু বদলে যায়। ফ্যাশন বলেন, গান বলেন, সাহিত্য বলেন, শিল্পকর্ম বলেন, সবকিছুই তো চেঞ্জ হয় সময়ের সাথে সাথে। চল্লিশ বছর আগে যে কাপড়চোপড় পরে ছবি তুলেছি, সেটা দেখলে নিজের কাছেই এখন হাসি পায়। আবার মনে মনে চিন্তা করি, তখন তো এটাই ফ্যাশন ছিল। তো ফ্যাশন বলেন আর গানই বলেন, সময় গেলে সবই চেঞ্জ হয়।

সময় গেলে যে মাধ্যমে আপনি গান করছেন, তখনকার রেকর্ডিং, এখনকার রেকর্ডিং, তখনকার সুর, এখনকার সুর, তখনকার কম্পোজিশন, এখনকার কম্পোজিশন এগুলো তো চেঞ্জ হবেই।

কিন্তু যে গানটা চল্লিশ বছর পরও সবুজ, মানুষের মুখে মুখে ফিরছে... অনেকেই এগুলোকে বলেন পুরনো দিনের গান। আমি পুরনো দিনের গান বলি না, আমি বলি সোনালি দিনের গান। সোনালি দিনের গান বলেই এখনও সে গানগুলো করছেন আপনারা। স্টেজে যাবেন, দেখবেন পঞ্চাশ, চল্লিশ বছরের পুরনো গানগুলোই মানুষ শুনতে চাইবে।

এখন তো হাজার হাজার গান হচ্ছে। সব গান তো থাকে না। যেগুলি থাকে, সেগুলো হলো কালোত্তীর্ণ গান।

সুতরাং বিবর্তন হবেই। মিউজিকালি গানের কম্পোজিশন, ইন্স্ট্রুমেন্ট চেঞ্জ হবেই। কিন্তু গানের স্ট্রাকচারে কিন্তু সহজে চেঞ্জ হয় না। সেই স্ট্রাকচারকে ভেঙে নতুন কিছু করতে গিয়ে যদি মানুষের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যায়, সেটাই হলো সবচেয়ে বড় সফলতা।

যেমন, র‌্যাগে, ব্লুজ বা এখনকার হিপহপ- চেঞ্জ কিন্তু সবসময়ই হচ্ছে, কিন্তু স্ট্রাকচারালি বাংলাদেশের বাংলা গান কিন্তু এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে।

গ্লিটজ: তবে আপনাদের সময়ের ব্যান্ডের গানগুলোর কথায় গভীরতা থাকতো, সুরে মাধুর্য থাকতো। সেটা কি এখনকার ব্যান্ডের গানগুলোতে আপনি পান?

তপন চৌধুরী: পাইনা, তা বলবো না। তবে এখন তো ব্যাপক হয়ে গেছে। তখন তো ব্যান্ড ছিল হাতে গোনা কয়েকটা, এখন তো অনেক অনেক ব্যান্ড।

তবে আগে যেটা হতো, ফিল্ম বা ব্যান্ড, যেটারই গান হোক, গান তৈরির আগে চার-পাঁচজন আমরা একসঙ্গে বসতাম। গানের কথাটা কেমন, সুরটা এভাবে হলে কেমন হয়- এগুলো নিয়ে চার-পাঁচজনের ভাবনা একত্রিত হতো। সেই চার-পাঁচজনের ভাবনা আর একজনের ভাবনা কিন্তু এক না।

 

এখন কী হয়, প্রতিটি গান, এমনকি ব্যান্ডেরও, দেখা যায় সেল্ফ-প্রডিউসডস। দেখা গেল নিজেই লিখে, নিজেই সুর করে, নিজেই কম্পোজ করে... নিজেরই সমস্ত ভাবনা-চিন্তা... রিদমও করে সে! এখন, চার-পাঁচজন একসঙ্গে থাকলে একেক রকমের ভাবনা-চিন্তা আসে, দেখা গেল রিদমিস্ট সেখানে কিছু যোগ করে দিল অন্যভাবে। এভাবে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভাবনা গানে নতুন কিছু যোগ করে।

এখন একা আর কতো পারা যায়? সবাই তো সবকিছু করতে পারেনা। সবাই তো সুপার ট্যালেন্টেড নয়। সবাই আরডি বর্মণও নয়, এ আর রাহমানও নয়।

আমাদের এখনকার গানের ক্ষেত্রে দুঃখজনক হলেও ব্যাপারটা সত্যি, সবাই নিজেই সবকিছু করে ফেলে।

আগে জানেন, একটা ফিল্মের গানের ক্ষেত্রেও সবাই বসতো। বসে আলোচনা করে ঠিক করতো, কাকে দিয়ে গানটা গাওয়ানো যায়, কার গলায় গানটা ভাল আসবে।

তবে এরমধ্যেও অনেকেই সুন্দর কাজ করছেন। তবে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা হয়তো পাচ্ছেনা, ভাল গান হচ্ছে কিন্তু সবসময় মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছে না- এরকমও হচ্ছে।

গ্লিটজ: সোনালি দিনের গানের কথা যখন বললেনই, আপনার গাওয়া ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গানটি এখনও জনপ্রিয়। এই গানটির পেছনের গল্প শুনতে চাই।

তপন চৌধুরী: এই গানটির সুরকার হলেন... উনার কথা একটু আলাদা করে বলতেই হয়, কারণ তিনি ছিলেন খুব নিভৃতচারী মানুষ। তিনি হলেন জিলু খান। তার সহযোগী ছিলেন নকীব খান। আর লেখা হলো নকীব খানের; দুই ভাই মিলে কাজটি একসঙ্গে করেছেন।

এই গানটি বাংলাদেশের সংগীতের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আমি সৌভাগ্যবান যে এই গানটি গাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তারাই আমাকে নির্ধারণ করেছিলেন গানটা গাওয়ার জন্য। সেজন্য আমার মনে হয় আরকি, আমি একটা ইতিহাস তৈরির সাক্ষী হয়ে গেছি! যতোদিন বাংলাদেশে বাংলা গান আছে, এই গানটিও থেকেই যাবে।

কিছু গান আসলে থেকেই যাবে। যেমন ‘নীল মণিহার’, ‘রেললাইন বহে সমান্তরাল’- এই ধরণের গানগুলো। এগুলো কিন্তু কালজয়ী গান। যেমন ধরুন, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘আগে যদি জানিতাম’- এসব গান বাংলাদেশের অনেক গানের মধ্যে মানুষ এখনও শোনে এবং যেকোনো অনুষ্ঠানে গেলে আমাদের এখনও গাইতে হয়।

সোলস-এর সঙ্গে তপন চৌধুরী। ছবিটি শিল্পীর অনুমতিক্রমে তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সংগ্রহ করা

এই গান গাওয়া হয়েছিল সোলস-এর প্রথম ক্যাসেটে। এই গান বাজারে যাওয়ার পরেই মানুষ আমাদেরকে চিনেছে। এখনও যেকোনো অনুষ্ঠানে গেলে এই গানের রিকোয়েস্ট আসবেই।

গ্লিটজ: আপনার গাওয়া গানের মধ্যে কোনগুলি আপনার সবচেয়ে প্রিয়?

তপন চৌধুরী: অনেক গানই প্রিয়। তবে তার মধ্যেও, ফিল্মের একটা গান আছে আমার, ‘কোনো চাওয়া নাই, কোনো পাওয়া নাই’, আলাউদ্দীন আলি সাহেবের সুর, আমজাদ হোসেন সাহেবের লেখা। ‘হীরামতি’ ছবির গান। ‘কত কাঁদলাম, কত করে সাধলাম’, এটারও সুরকার গীতিকার আলাউদ্দিন আলি এবং আমজাদ হোসেন। তারপর ‘পাথরের পৃথীবিতে কাছে এলে হৃদয়ের’- বহুশ্রুত এবং জনপ্রিয় একটা গান। এটায় আনোয়ার পারভেজ সাহেবের সুর, গীতিকার হলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার।

গ্লিটজ: গান নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী? এটা কি অব্যাহত থাকবে নাকি আবারও বিরতি নেবেন?

তপন চৌধুরী: এটা তো অব্যাহত থাকবেই। অনেকেই বলে, (অ্যালবামের নাম নিয়ে) ‘ফিরে এলাম’ আবার কী? যেমন শ্রদ্ধেয় রুনা লায়লা বলছিলেন কিছুদিন আগে, ‘অ্যাই, তুমি তো এখানেই ছিলা। গেলা কবে আর ফিরলাই বা কবে?’

আসল ব্যাপারটা হলো, অ্যালবামের নাম স্পেসিফিক কোনো কিছুকে মিন করে না। অনেকদিন পর সিডি করছি, গানে ফিরে এলাম- এটা একটা অর্থ হতে পারে। তবে অ্যালবামে গান আছে একটা এই নামে, সেখান থেকেই অ্যালবামের নামও এটাই হয়েছে।

আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা হলো, যতদিন গলায় সুর আছে, গান করতে পারছি, ততদিন গান চালিযে যাবো। তবে জোর করে গান করবো না। গাইতে পারছি না কিন্তু স্টেজে গিয়ে কাশবো, কাঁদবো- এটা কখনও করবো না।