‘আমরা যে তাদের জারজ বলছি,আমরা কে?’

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের একটি অনালোকিত অধ্যায় যুদ্ধশিশু। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যাদের নীরবে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়, জন্মপরিচয় গোপন রেখে যাদের অনেকেই বেড়ে ওঠেন এদেশেই। নিজভূমে আত্মপরিচয় সংকটে জীবনযাপন করা এইসব মানুষের সন্ধানে নেমেছিলেন প্রামান্যচিত্র নির্মাতা শবনম ফেরদৌসী।তিনজন যুদ্ধশিশুকে খুঁজে বের করে তাদের পরিণত বয়সের মুখ থেকে শুনেছেন যুদ্ধের আরেকটি পরিণতির গল্প। সে গল্পই তুলে এনেছেন তার নতুন প্রামান্যচিত্র ‘জন্মসাথী’তে। সম্প্রতি সেন্সর পেরিয়ে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। আসছে বছর সারাদেশে প্রদর্শিত হবে ‘জন্মসাথী’। তার আগে ‘জন্মসাথী’ ও সাম্প্রতিক প্রামান্যচিত্রের হালচাল নিয়ে গ্লিটজ মুখোমুখি হয়েছে নির্মাতা শবনম ফেরদৌসীর।

রুদ্র হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Dec 2016, 03:16 PM
Updated : 30 Dec 2016, 02:19 PM

গ্লিটজ: ‘একাত্তরের যুদ্ধশিশু’, ‘সুধীর বর্মণ মাছ খান না। তাঁর মা খান, স্ত্রী খান, মেয়ে খায়। তিনি খান না। কখনোই খেতে পারেন না, মাছে সুধীরের গন্ধ লাগে।’ মেছো বাঙালি বলে গালি দেওয়া, মাছ খেতে না পারা পাকিস্তানী সৈন্যের জিন বহন করছেন সুধীর কিংবা আরও অন্যরা। এমন স্বমিল আবিস্কার কেমন লেগেছে?

শবনম ফেরদৌসী: এ ছবির যে কটা চ্যালেঞ্জিং মোমেন্ট আছে তার মধ্যে এটা একটা। যেটার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। ও যখন দাওয়ায় বসে খেতে খেতে বলছিলো ‘গন্ধ লাগে’ তখন আমার গায়ে কাঁটা দিলো। তার মানে সে জিন বহন করে। খোট্টাদের দেশের, মাছ খায়না আমরা ওদের বলি না? ওরাও তো আমাদের গালি দিতো ‘মাছলি খাতা বাঙ্গাল’ বলে। সুধীর নিজেও জানেনা কেন সে মাছ খেতে পারেনা। তো ওই দৃশ্যটা একটা পাওয়া। আমারতো একবার মনেও হয়েছিলো আমার যদি তেমন বাজেট থাকতো আমি সরকারের সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তান গিয়ে ডিএনএ টেস্ট করিয়ে সুধীরের বাবাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো কিনা। মাইকেল মূর যেরকম ছবি বানায় কবর থেকে তুলে নিয়ে আসে। সে সাধ্য আমার ছিলো না আর উদ্দেশ্যও ঠিক তা নয়। কারন পাকিস্তানিদের বাচ্চা বলে আমরা যে যুদ্ধ শিশুদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিলাম, সেই শিশুরা বড় হয়ে কিন্তু বাবাকে খুঁজতে পাকিস্তান যায়নি। মাকে খুঁজতেই এদেশে এসেছে।

গ্লিটজ: আপনার ‘জন্মসাথী’দের খুঁজতে বের হওয়ার পেছনের গল্প টা শুনতে চাই

শবনম ফৌরদৌসীর ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত

শবনম ফেরদৌসী:
৭২ সালে জন্ম নেয়া আমার সবসময় মনে হতো, আমি যদি ওয়ারচাইল্ড হতাম তাহলে কী হতো? আজকে ফিল্ম বানানো? অসম্ভব। যেহেতু ৭২ সালেই সব ওয়ারচাইল্ড জন্ম নিয়েছে সুতরাং ওই সময়ের সব বাচ্চারাই আমার ইয়ারমেট। তাহলে কি আমার অজান্তে আমার কোন বন্ধু ওয়ারচাইল্ড ছিলো না? আমাদের মধ্যেই কি অনেকেই এমন ছিলো না যারা পালক সন্তান হয়ে কিংবা পিতৃপরিচয় গোপন করে আমাদের চারপাশে বেড়ে উঠেছে। এটা একটা বিশাল ধাঁধাঁ। এ ধাঁধাঁর মধ্যেই ছবিটা শুরু করেছিলাম ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। শেষ হয় গত বছর (২০১৫ সাল) ১৫ ডিসেম্বরে। একাত্তর টেলিভিশন ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের যৌথ প্রযোজনায় এবং ব্যক্তিগত কিছু অর্থযোগে এটি নির্মিত হয়।

গ্লিটজ: এ তথ্যচিত্র নির্মাণের পর এমন কিছু কী মনে হয়েছে ? গুরুত্বপূর্ণ কিছু কি বাদ পড়েছে বা সম্ভব হয়নি দেখানো?

শবনম ফেরদৌসী: যেমন রাজাকার বা যুদ্ধপরাধীদেরকে যদি দেখানো যেতো, তাদের ইন্টারভিউ করা যেতো, সাধারণ মানুষ যারা তাদের একঘরে করে রেখেছে তাদের পয়েন্ট অফ ভিউটাকে যদি সবার সামনে তুলে আনা যেতো, কিন্তু যখনই সুধীরদের ওখানে গেছি বা শামসুন্নাহাররের কাছে গিয়েছি, যখন মানুষ শুনেছে ক্যামেরা এনেছি তারা তখন দূরে সরে গেছে। সুধীরের ওখানে তো ওদের গ্রামেই শুটিং করেছি, কিন্তু ওরা তো ক্যামেরার সামনে বলবে না পাঞ্জাবির ছেলে, এমনিতে তো উঠতে বসতেই বলে। শামসুন্নাহারের বাড়িতে তো যেতেই পারিনি, মনোয়ারা ক্লার্ককে আরেকটু শুট করতে পারলে ভালো হতো। দীর্ঘদিন ধরে আমরা জানি যে ওয়ারচাইল্ডরা সবাই বিদেশে, কিন্তু আসলে তো তা নয়, অধিকাংশ যুদ্ধশিশু এখানে রয়ে গেছে। বেশিরভাগ যুদ্ধশিশুকে মায়েরা গোপন করে ফেলেছেন। মনোয়ারা ক্লার্কের চাইতেও আমার উদ্দেশ্য ছিলো এদেশেই যে যুদ্ধশিশুরা পিতৃপরিচয় গোপন করে বেড়ে উঠেছে তা প্রমান করা।

গ্লিটজ:যতদূর জানি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এমন কিছু মানুষের সন্ধান আপনি পেয়েছেন যারা যুদ্ধশিশু ছিলেন। তারা কেন অপ্রকাশিত থাকলো আপনার প্রামান্যচিত্রে?

নির্মাণসহযোগীদের সাথে পরিচালক শবনম ফেরদৌসী

শবনম ফেরদৌসী:
এমন দু একজনের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। একজন সামনেই আসেনি। সে প্রতিষ্ঠিত। সে কিছু বলতে চায়না কেননা তার মা এই বয়সে এসে এটা নিতে পারবে কি না, সে নিজে খুব অস্থির থাকে এ পরিচয় নিয়ে। প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু মায়ের কথা ভেবে তা আর করে না। সম্ভবত মা বেঁচে থাকতে এটা সে প্রকাশ করবে না। তো এমন যাদের সাথে পরিচয় হয়েছে তারা কেউই মাকে নতুন করে কষ্ট দিতে চায়না।

গ্লিটজ:আপনি যেহেতু পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন, সেই সূত্রেই বলা, এখনও কি পিতৃপরিচয়হীন শিশু জন্ম নিচ্ছে না? এ বিষয়টিও কি আপনার প্রামান্যচিত্রে উসকে দিতে পারতেন?

শবনম ফেরদৌসী: পিতৃপরিচয়হীন শিশু আগেও ছিলো এখনও আছে। আমরা যে তাদের জারজ বলছি, আমরা কে? আমাদের জাতিসত্বাটা কি? আপনি যদি অভিজিৎ সেনের ‘মৌসুমী সমুদ্র উপকূলে’ বইটা পড়েন আপনি দেখবেন- কে কীভাবে কত রকম জাত দ্বারা ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে আজ আমাদের পাঁচজন একসাথে বসলে আমরা পাঁচরকমের চেহারার মানুষ। ফলে এটা কি আমার বলার রাইট আছে কি না? এবং আর্যদের সময় থেকে এ অঞ্চলের মানুষ ধর্ষণের শিকার হয়ে আসছে। ফলে আমাদের একেকজনের একেক ধরনের রূপ, স্বভাব চরিত্রও এতো জটিল । তো শুধুমাত্র এ কারণে বা পলিটিক্যালিও যদি আমরা বলি পাকিস্তানিরা আমাদের নারীদের ইজ্জত হরণ করেছে, আমরা যে সেই কারনেই মেয়েগুলোকে একঘরে করে ফেললাম, নিতে চাইলাম না, সমাজচ্যুত করলাম তাহলে আমরাও কি পাকিস্তানীদের গীতটাই গাইলাম না? যে তোমরাও অপমান করতে চাইছো, আমরাও অপমানিত হইছি। একজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাকে যদি আমি হুইলচেয়ার দিয়ে ফুলের মালা দেই, সেটা এই মেয়েটাকে কেন আমি দেইনি? সতিত্বের ধারণা কি শুধু পাকিস্তানীদের? সতিত্বের ধারণা কি আমাদেরও না? আমরাও কি সে জায়গাটা ভীষণরকম হিউমিলেট করছি না? ওই যে সাড়ে তিন হাজার বলি পাঁচ হাজার বলি তারা যে বেঁচে গেছে তা মাতা মেরির কল্যানে। নইলে তাদের মুখেও লবন দিয়ে মেরে ফেলা হতো।

গ্লিটজ:প্রামান্যচিত্রটি প্রচারের পর সরকার বা এনজিও বা সামাজিক সংস্থাগুলোর কোন প্রতিক্রিয়া বা উদ্যোগ এসেছে কি?

শবনম ফৌরদৌসীর ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত

শবনম ফেরদৌসী:
সরকারের দুজন মন্ত্রী প্রামান্যচিত্রটি দেখে গেছেন। তারা এটি দেখে খুব আবেগাপ্লুতও হয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় এখন পর্যন্ত কোনো রি-অ্যাকশন দেখায়নি।  তারা এখন পর্যন্ত বীরাঙ্গনা নারীদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেয়া পর্যন্তই আছে।  তাদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু তারা হাতে এখনওটাকা পাননি। ম্যাক্সিমামই মারা গেছেন তারা। এর মধ্যে সুধীরের মা টেপরির অবস্থা খুব খারাপ। এ টাকা সে দেখে যেতে পারবে কিনা জানিনা। কিন্তু যুদ্ধশিশুদের ব্যাপারে তো আসলে কোন রকম কোন ব্যাপার নাই। যেটা সরকারের আগেও ছিলো না, এখনও নাই। কারন যু্দ্ধের যতোরকম আহত নিহতের তালিকা এর মধ্যে যুদ্ধশিশু পড়ছে না। যুদ্ধের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে এটাকে কখনো দেখা হয়না, গ্রহন করা হয় না। ফলে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে কোন উদ্যোগ এখন পর্যন্ত রাস্ট্রের কোথাও আমি দেখতে পাইনি। এখন পর্যন্ত সমাজকর্মীরাও কোন উদ্যোগ । আমাদের এখানে তো অনেক হিউম্যান রাইটস একটিভিস্ট আছেন, ছবিতো কম মানুষজন দেখেন নি কিন্তু কেউতো তাদের পাশে এসে দাঁড়ান নি। দু একজন সাধারণ মানুষ সীমিত পর্যায়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন। মানুষের হাতে তো টাকা এখন কম নেই। শামসুন্নাহারের গলগণ্ড হয়েছে। চিকিৎসা দরকার। কেউ একজন বলেনি তাকে আনো তার চিকিৎসা দরকার। যেখানে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসেনি সেখানে সরকারতো অনেক দূর।

গ্লিটজ:আপনি তো জন্মসাথীদের খুঁজছিলেন। প্রামান্যচিত্রে দেখা গেলো তিনজনকে পেলেন। খোঁজা কি শেষ?

জন্মসাথী যুদ্ধশিশু সুধীরের সঙ্গে নির্মাতা

শবনম ফেরদৌসী:
না, এ যাত্রাটা হয়তো ফিল্মে শেষ, কিন্তু আমি কি মনে মনে খুঁজি না? ১৪ জানুয়ারি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে যে পাঁচজন যুদ্ধশিশু ছিলো বা আমি ছাড়া ১২জন শিশু সেদিন জন্মেছিলো আমি তাদের এখনও খুঁজি। কেননা সুধীরকে আমি পেয়েছি দিনাজপুরের অজ পাড়া গাঁয়ে, শামসুন্নাহারকে পেয়েছি হবিগঞ্জে। তারাতো কেউ আমার হলি ফ্যামিলির সেই শিশুগুলো নয়। আমি এখনও আশাবাদী, বা অপেক্ষা করি, কেউ যদি ছবিটা দেখে এসে বলে আমিই তোমার সেই জন্মসাথী।

গ্লিটজ: জন্মসাথী প্রদর্শণের ব্যাপারে আপনার পরিকল্পনা কী?

শবনম ফেরদৌসী: পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ছবিটি চেয়ে নিয়ে গেছে। তারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছবিটি প্রদর্শনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন ফিডব্যাক পাইনি। নির্মাতা হিসেবে আমি কী করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও প্রদর্শনের ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেয়নি। চলতি মাসে চট্টগ্রামের চারটি সংগঠন এটি প্রদর্শন করেছে। আমিও গিয়েছি প্রদর্শনীতে। ছোট ছোট হলরুমগুলোতে জায়গা না পেয়ে অনেকেই ছবিটি দেখতে পায়নি। কিন্তু যারাই দেখেছে সবাই আবেগাপ্লুত হয়েছে। বলেছে এটা সারাদেশের মানুষের দেখা উচিত। সে অনুপ্রেরণা থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সারাদেশে ব্যাক্তি উদ্যোগেই ছবিটি প্রদর্শনের ব্যাবস্থা করবো। আমার দায়িত্ব ব্যাপারটাকে জানানো। আমার আগ্রহ তরুণদের দিকে। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের এ দিকটি অজানা। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে ছবিটি পৌঁছানো। প্রামান্যচিত্র নির্মাতার কাজ সত্য জানানো। আমি তাই করবো। নতুন বছরের শুরুতেই কুষ্টিয়া রংপুর গাইবান্ধা রাজশাহীতে দেখানোর পরিকল্পনা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগরেও হতে পারে। প্রতিমাসে কোথাও না কোথাও ছবিটি দেখানো হবে। তথ্য মন্ত্রনালয়ও হয়তো প্রতি জেলায় এটি দেখাবে।

গ্লিটজ: এ যাবত আপনার অন্যান্য নির্মাণগুলো সম্পর্কে জানতে চাই

শবনম ফৌরদৌসীর ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত

শবনম ফেরদৌসী:
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবি এটা আমার প্রথম। ইতিহাসভিত্তিক হিসেবে দ্বিতীয়, প্রথম কাজটি ছিলো ভাষা জয়িতা। ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমাদের দেশে প্রথম প্রামান্যচিত্র ছিলো এটি। এখানে বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনে যে নারীরা অংশ নিয়েছিলো তাদের ফোকাস করা হয়েছে। হিজড়াদের নিয়েও প্রথম প্রামান্যচিত্রটি আমার। ওটার নাম ছিলো ইচ্ছাবসন্ত। মাসুমা পিয়ার ওপর একটু খানি প্রাণের খোঁজে, অদ্বৈত মল্ল বর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘পোড়ামাটির গন্ধ’, ভিক্ষুকদের ওপর ‘এন্ড উই ক্রস দ্য সেম রোড’, বেঙ্গলের জন্য তিনটি ডকুমেন্টরি করি-ফরিদা জামান, অলোকেশ ঘোষ আর সৈয়দ জাহাঙ্গীরের উপর। এছাড়া প্রামাণ্যচিত্র ‘বিষকাব্য’ খুব প্রশংসিত হয়, রবীন্দ্রসংগীতের ওপর ভুবন ভরা সুর নামে একটি তথ্যচিত্র আছে আমার, ওটাও খুব জনপ্রিয় হয়েছে। এছাড়া অডিও ভিজুয়ালেও অনেক কাজ আছে আমার। এনজিওর জন্যও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। একাত্তর টেলিভিশনের ৪৫ টি প্রামান্যচিত্রই আমার তত্বাবধায়নে নির্মিত।

গ্লিটজ:প্রামান্যচিত্র সম্পর্কে তো আমাদের দর্শক একধরণের অন্ধকারেই আছে। প্রামান্যচিত্র নির্মাতাদের ফার্স্ট জেনারেশনের প্রতিনিধি হিসেবে আপনার মন্তব্য কি?

শবনম ফেরদৌসী: প্রামান্যচিত্র আন্দোলন যখন আমরা যখন আমরা শুরু করি ২০০৪ সালে, তখন আমাদের টার্গেট ছিলো এটিকে টেলিভিশনে প্রচার করা। ২০০৯ সালে আমি যমুনা টেলিভিশনে প্রথম প্রামান্যচিত্র বিভাগ স্টার্ট করি। তারপর ৭১ টেলিভিশনেও মোজাম্মেল বাবু আমাকে প্রামান্যচিত্র বিভাগ চালু করার সুযোগ দেন। তারপর থেকে ৭১টেলিভিশন নিয়মিত প্রামান্যচিত্র প্রডিউস করে। এটা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি এর জনপ্রিয়তা কতটুকু। দর্শক এখনো প্রামান্যচিত্রকে প্রোগ্রাম বলে, অথবা বলে শর্টফিল্ম। মোটরবাইকের নাম যেমন হোন্ডা হয়ে গেছে তেমনি প্রামান্যচিত্রের নাম হয়ে গেছে শর্ট ফিল্ম। ধারণাগত এই জায়গাটাতে এখনও আমরা আটকে আছি।দর্শকদের কথা বলার আগে আমিতো নির্মাতাদের কথা বলতে চাই, আমাদের এখানে কাহিনিচিত্র নির্মাতই বেশি। তারা কজন প্রামান্যচিত্র দেখেন? কজন আমাদের কাজ দেখেছেন? তাদের মধ্যেই তো প্রামান্যচিত্রের ব্যাপারে একধরণের অচ্ছুতভাব আছে। আমার সবচেয়ে অবাক লাগে পারসোনাল স্টোরি টেলিংয়ের ব্যাপারটা কেউ জানেই না। আমাদের জানার দৌড়টা খুব কম। শুধু প্রামান্য চিত্র কেন আমাদের মর্ডান ফিকশন যে কোথায় আছে তা কি আমাদের নির্মাতারা জানেন? যারা একটু জানেন বলে আমরা জানি, তারাতো এখনও ওজু, কুরোসাওয়াতেই পড়ে আছে। অবশ্যই যারা মাস্টার তাদের জায়গা দিতে হবে। এখনকার ফিল্ম কোন জায়গায় গেছে তাও কি খুব স্পষ্ট? ফলে মাইকেল মুর কিংবা আরও দু একজন ছাড়া সারা বিশ্বেই প্রামান্যচিত্রনির্মাতাদের ঘরানাটা খুব একটা জনপ্রিয় নয়। কিন্তু তারকভস্কি বলি, কিওরাস্তামি বলি এরা প্রত্যেকেই শুরুতে প্রামান্যচিত্র নির্মাতা ছিলেন।

গ্লিটজ: প্রামান্যচিত্রের এই পিছনে পড়ে থাকার জন্য কি প্রামান্যচিত্র নির্মাতাদের অন্তর্মুখীতাকে দায়ি করবো ?

শবনম ফৌরদৌসীর ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত

শবনম ফেরদৌসী:
তারকোভস্কি প্রামান্যচিত্র নির্মাণ ছেড়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে, তিনি আর মানুষের বেদনার ভার বহন করতে পারছেন না। প্রামান্যচিত্র নির্মাতাদেরকে তো ওই রিয়েল লাইফটার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। যারা প্রোটাগনিষ্ট তাদের যতো যন্ত্রণা পেইন, তাকে ধারণ করতে হয়, বহন করতে হয়, শেয়ার করতে হয়, ওটা খুব কষ্টের।ওটা একটা ট্রমা। আমিতো এখনও জন্মসাথীর ট্রমা থেকে বের হতে পারিনি। এরকম অনেকের ট্রমা থেকে আমরা বের হতে পারিনা। ডকুমেন্টরি ফিল্ম মেকার হচ্ছে ওয়ান কাইন্ড অফ সাইক্রিয়াটিস্ট। সে এত ধরনের মানুষকে জানে, এত ধরনের মানুষের ভেতর সে জার্নি করে, ফলে সে মানুষকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে। এজন্য আপনি দেখবেন যে কোন প্রামান্যচিত্র নির্মাতাই খুব লাউড না। খুবই ডাউন টু আর্থ হয় তারা। অনেক বেশি প্রচারমুখিও না তারা। এই জায়গাটা যদি আমি না রাখি, এই টোনটা যদি আমি না রাখি, বেশি প্রচারের মধ্যে যাওয়া তাই প্রামান্যচিত্র নির্মাতাদের জন্য সমস্যাও। প্রামান্যচিত্র নির্মাতা প্রচারের আলোয় মুখ চেনা হয়ে গেলে তাকে আর মানুষ কাছের ভাববে না। আপনি সাধারণ মানুষের কাছে যেতে পারবেন না। ফলে এই জীবনকে এত কাছ থেকে দেখতে যাওয়া আবার আপনি ফিল্ম মিডিয়াতেও কাজ করছেন যেখানে আপনার জন্য প্রচার প্রচারণারও একটা ব্যাপার আছে, দেখারও ব্যাপার আছে, সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের সাথে বোঝাপড়ার ব্যাপার আছে, ফান্ডিংয়ের ক্রাইসিস আছে, এজ এ ফিল্ম মেকার আপনার আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আছে সবমিলে না, প্রামান্য চিত্রনির্মাতা একজন একা মানুষ।

গ্লিটজ: তবু প্রামান্যচিত্রের তো একটা প্রচারের দরকার আছে। সেটার প্রক্রিয়াটা কীভাবে হবে?

জন্মসাথী যুদ্ধশিশু কামরুন্নেসার সাথে নির্মাতা

শবনম ফেরদৌসী:  টেলিভিশনগুলো আজকে ‘সুলতান সুলেমান’ (বিদেশি টিভি সিরিয়াল) নিয়ে মেতে আছে। যতোই চেষ্টা করেন, বাংলাদেশের মানুষ স্টার জলসা ও স্টার প্লাসই দেখবে। আমাদের দেশের ফিকশনগুলো মার খেয়ে গেছে। ওসবের ভেতর নিজের রিফ্লেকশন দেখতে পারেনা মানুষ। আমাদের টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের বুঝতে হবে, আমাদের দেশে নিউজ কেন এত জনপ্রিয়। কেননা মানুষ রিয়েলিটি দেখতে খুব ভালোবাসছে। তারা যদি রিয়েলিটি শো দেখতে চায়, রান্নার অনুষ্ঠান পছন্দ করে, ট্রাভেল শো দেখার জন্য উদগ্রীব থাকে তাহলে কেন প্রামান্যচিত্র গ্রহন করবে না। তারা ননফিকশানাল প্রোগ্রামগুলো গ্রহন করছে। তারমানে কি? মানুষ নিজেকেদেখতে চাইছে। ফলে আরেকটা ওয়ে হতে পারে প্রামান্যচিত্র। একাত্তর টেলিভিশন দিয়ে আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি। যা আমরা দেইনি মানুষকে তা নিয়ে কি করে বলি এটা মানুষ গ্রহন করবে না? এছাড়া, আরেকটা ওয়ে আছে। নির্মাতার কিন্তু দর্শকদের মুখোমুখি হতে হয়। সে জায়গা থেকে দর্শনীর বিনিময়ে ছোট ছোট হলে হোক, ওপেন এয়ার প্রদর্শনের আয়োজন করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে অনেকগুলো সিনেমা হল নির্মাণের পরিকল্পনা হচ্ছে। সেখানে প্রামান্যচিত্রগুলো প্রতি মাসে এক সপ্তাহ অন্তত দেখাতে হবে। আমার মনে হয়, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমি আশাবাদী। আমি যে এতগুলো প্রামান্যচিত্র বানিয়েছি তাতো দেশি প্রযোজকের টাকাতেই বানিয়েছি।

গ্লিটজ: নির্মাতা শবনম ফেরদৌসীর দর্শনটা জানতে চাই

শবনম ফেরদৌসী: মানুষ হিসেবে আমার জীবন দর্শন খুব সরল। জটিলতা পছন্দ করিনা। জটিলকে সহজ করে দেখতে হবে। এটা আমার লাইফ প্র্যাকটিস। এ বয়সে এসে আমার মনে হয়েছে পুরনো কথাগুলো খুব সত্য। মা যে খনার বচন বলতেন সেসব। চিরায়ত বাক্যগুলোর উপর আস্থা এসেছে আমার। সারাজীবন প্রথাকে ভাঙতে ভাঙতেএসেছি। কিন্তু পায়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে না। চিরন্তন যে ঐতিহ্য, মানুষের টিকে থাকার গল্প তাকে সাথে নিয়েই আমি এগুতে চাই। কুপমন্ডুকতা থেকে দূরে থাকতে চাই।  রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর কথা যদি বলেন, আমি অতি জাতীয়তাবাদ পছন্দ করি না। অতি জাতীয়তাবাদ মানুষকে কুপমন্ডুক করে তোলে। শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতই শুনবো হিন্দি গান শুনবো না তা হতে পারেনা। নিজের স্বকীয়তা রেখে সব দেখতে হবে, জানতে হবে, করতে হবে।