গ্লিটজ: ‘একাত্তরের যুদ্ধশিশু’, ‘সুধীর বর্মণ মাছ খান না। তাঁর মা খান, স্ত্রী খান, মেয়ে খায়। তিনি খান না। কখনোই খেতে পারেন না, মাছে সুধীরের গন্ধ লাগে।’ মেছো বাঙালি বলে গালি দেওয়া, মাছ খেতে না পারা পাকিস্তানী সৈন্যের জিন বহন করছেন সুধীর কিংবা আরও অন্যরা। এমন স্বমিল আবিস্কার কেমন লেগেছে?
শবনম ফেরদৌসী: এ ছবির যে কটা চ্যালেঞ্জিং মোমেন্ট আছে তার মধ্যে এটা একটা। যেটার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। ও যখন দাওয়ায় বসে খেতে খেতে বলছিলো ‘গন্ধ লাগে’ তখন আমার গায়ে কাঁটা দিলো। তার মানে সে জিন বহন করে। খোট্টাদের দেশের, মাছ খায়না আমরা ওদের বলি না? ওরাও তো আমাদের গালি দিতো ‘মাছলি খাতা বাঙ্গাল’ বলে। সুধীর নিজেও জানেনা কেন সে মাছ খেতে পারেনা। তো ওই দৃশ্যটা একটা পাওয়া। আমারতো একবার মনেও হয়েছিলো আমার যদি তেমন বাজেট থাকতো আমি সরকারের সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তান গিয়ে ডিএনএ টেস্ট করিয়ে সুধীরের বাবাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো কিনা। মাইকেল মূর যেরকম ছবি বানায় কবর থেকে তুলে নিয়ে আসে। সে সাধ্য আমার ছিলো না আর উদ্দেশ্যও ঠিক তা নয়। কারন পাকিস্তানিদের বাচ্চা বলে আমরা যে যুদ্ধ শিশুদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিলাম, সেই শিশুরা বড় হয়ে কিন্তু বাবাকে খুঁজতে পাকিস্তান যায়নি। মাকে খুঁজতেই এদেশে এসেছে।
গ্লিটজ: আপনার ‘জন্মসাথী’দের খুঁজতে বের হওয়ার পেছনের গল্প টা শুনতে চাই
গ্লিটজ: এ তথ্যচিত্র নির্মাণের পর এমন কিছু কী মনে হয়েছে ? গুরুত্বপূর্ণ কিছু কি বাদ পড়েছে বা সম্ভব হয়নি দেখানো?
শবনম ফেরদৌসী: যেমন রাজাকার বা যুদ্ধপরাধীদেরকে যদি দেখানো যেতো, তাদের ইন্টারভিউ করা যেতো, সাধারণ মানুষ যারা তাদের একঘরে করে রেখেছে তাদের পয়েন্ট অফ ভিউটাকে যদি সবার সামনে তুলে আনা যেতো, কিন্তু যখনই সুধীরদের ওখানে গেছি বা শামসুন্নাহাররের কাছে গিয়েছি, যখন মানুষ শুনেছে ক্যামেরা এনেছি তারা তখন দূরে সরে গেছে। সুধীরের ওখানে তো ওদের গ্রামেই শুটিং করেছি, কিন্তু ওরা তো ক্যামেরার সামনে বলবে না পাঞ্জাবির ছেলে, এমনিতে তো উঠতে বসতেই বলে। শামসুন্নাহারের বাড়িতে তো যেতেই পারিনি, মনোয়ারা ক্লার্ককে আরেকটু শুট করতে পারলে ভালো হতো। দীর্ঘদিন ধরে আমরা জানি যে ওয়ারচাইল্ডরা সবাই বিদেশে, কিন্তু আসলে তো তা নয়, অধিকাংশ যুদ্ধশিশু এখানে রয়ে গেছে। বেশিরভাগ যুদ্ধশিশুকে মায়েরা গোপন করে ফেলেছেন। মনোয়ারা ক্লার্কের চাইতেও আমার উদ্দেশ্য ছিলো এদেশেই যে যুদ্ধশিশুরা পিতৃপরিচয় গোপন করে বেড়ে উঠেছে তা প্রমান করা।
গ্লিটজ:যতদূর জানি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এমন কিছু মানুষের সন্ধান আপনি পেয়েছেন যারা যুদ্ধশিশু ছিলেন। তারা কেন অপ্রকাশিত থাকলো আপনার প্রামান্যচিত্রে?
গ্লিটজ:আপনি যেহেতু পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন, সেই সূত্রেই বলা, এখনও কি পিতৃপরিচয়হীন শিশু জন্ম নিচ্ছে না? এ বিষয়টিও কি আপনার প্রামান্যচিত্রে উসকে দিতে পারতেন?
শবনম ফেরদৌসী: পিতৃপরিচয়হীন শিশু আগেও ছিলো এখনও আছে। আমরা যে তাদের জারজ বলছি, আমরা কে? আমাদের জাতিসত্বাটা কি? আপনি যদি অভিজিৎ সেনের ‘মৌসুমী সমুদ্র উপকূলে’ বইটা পড়েন আপনি দেখবেন- কে কীভাবে কত রকম জাত দ্বারা ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে আজ আমাদের পাঁচজন একসাথে বসলে আমরা পাঁচরকমের চেহারার মানুষ। ফলে এটা কি আমার বলার রাইট আছে কি না? এবং আর্যদের সময় থেকে এ অঞ্চলের মানুষ ধর্ষণের শিকার হয়ে আসছে। ফলে আমাদের একেকজনের একেক ধরনের রূপ, স্বভাব চরিত্রও এতো জটিল । তো শুধুমাত্র এ কারণে বা পলিটিক্যালিও যদি আমরা বলি পাকিস্তানিরা আমাদের নারীদের ইজ্জত হরণ করেছে, আমরা যে সেই কারনেই মেয়েগুলোকে একঘরে করে ফেললাম, নিতে চাইলাম না, সমাজচ্যুত করলাম তাহলে আমরাও কি পাকিস্তানীদের গীতটাই গাইলাম না? যে তোমরাও অপমান করতে চাইছো, আমরাও অপমানিত হইছি। একজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাকে যদি আমি হুইলচেয়ার দিয়ে ফুলের মালা দেই, সেটা এই মেয়েটাকে কেন আমি দেইনি? সতিত্বের ধারণা কি শুধু পাকিস্তানীদের? সতিত্বের ধারণা কি আমাদেরও না? আমরাও কি সে জায়গাটা ভীষণরকম হিউমিলেট করছি না? ওই যে সাড়ে তিন হাজার বলি পাঁচ হাজার বলি তারা যে বেঁচে গেছে তা মাতা মেরির কল্যানে। নইলে তাদের মুখেও লবন দিয়ে মেরে ফেলা হতো।
গ্লিটজ:প্রামান্যচিত্রটি প্রচারের পর সরকার বা এনজিও বা সামাজিক সংস্থাগুলোর কোন প্রতিক্রিয়া বা উদ্যোগ এসেছে কি?
গ্লিটজ:আপনি তো জন্মসাথীদের খুঁজছিলেন। প্রামান্যচিত্রে দেখা গেলো তিনজনকে পেলেন। খোঁজা কি শেষ?
গ্লিটজ: জন্মসাথী প্রদর্শণের ব্যাপারে আপনার পরিকল্পনা কী?
শবনম ফেরদৌসী: পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ছবিটি চেয়ে নিয়ে গেছে। তারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছবিটি প্রদর্শনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন ফিডব্যাক পাইনি। নির্মাতা হিসেবে আমি কী করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও প্রদর্শনের ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেয়নি। চলতি মাসে চট্টগ্রামের চারটি সংগঠন এটি প্রদর্শন করেছে। আমিও গিয়েছি প্রদর্শনীতে। ছোট ছোট হলরুমগুলোতে জায়গা না পেয়ে অনেকেই ছবিটি দেখতে পায়নি। কিন্তু যারাই দেখেছে সবাই আবেগাপ্লুত হয়েছে। বলেছে এটা সারাদেশের মানুষের দেখা উচিত। সে অনুপ্রেরণা থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সারাদেশে ব্যাক্তি উদ্যোগেই ছবিটি প্রদর্শনের ব্যাবস্থা করবো। আমার দায়িত্ব ব্যাপারটাকে জানানো। আমার আগ্রহ তরুণদের দিকে। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের এ দিকটি অজানা। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে ছবিটি পৌঁছানো। প্রামান্যচিত্র নির্মাতার কাজ সত্য জানানো। আমি তাই করবো। নতুন বছরের শুরুতেই কুষ্টিয়া রংপুর গাইবান্ধা রাজশাহীতে দেখানোর পরিকল্পনা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগরেও হতে পারে। প্রতিমাসে কোথাও না কোথাও ছবিটি দেখানো হবে। তথ্য মন্ত্রনালয়ও হয়তো প্রতি জেলায় এটি দেখাবে।
গ্লিটজ: এ যাবত আপনার অন্যান্য নির্মাণগুলো সম্পর্কে জানতে চাই
গ্লিটজ:প্রামান্যচিত্র সম্পর্কে তো আমাদের দর্শক একধরণের অন্ধকারেই আছে। প্রামান্যচিত্র নির্মাতাদের ফার্স্ট জেনারেশনের প্রতিনিধি হিসেবে আপনার মন্তব্য কি?
শবনম ফেরদৌসী: প্রামান্যচিত্র আন্দোলন যখন আমরা যখন আমরা শুরু করি ২০০৪ সালে, তখন আমাদের টার্গেট ছিলো এটিকে টেলিভিশনে প্রচার করা। ২০০৯ সালে আমি যমুনা টেলিভিশনে প্রথম প্রামান্যচিত্র বিভাগ স্টার্ট করি। তারপর ৭১ টেলিভিশনেও মোজাম্মেল বাবু আমাকে প্রামান্যচিত্র বিভাগ চালু করার সুযোগ দেন। তারপর থেকে ৭১টেলিভিশন নিয়মিত প্রামান্যচিত্র প্রডিউস করে। এটা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি এর জনপ্রিয়তা কতটুকু। দর্শক এখনো প্রামান্যচিত্রকে প্রোগ্রাম বলে, অথবা বলে শর্টফিল্ম। মোটরবাইকের নাম যেমন হোন্ডা হয়ে গেছে তেমনি প্রামান্যচিত্রের নাম হয়ে গেছে শর্ট ফিল্ম। ধারণাগত এই জায়গাটাতে এখনও আমরা আটকে আছি।দর্শকদের কথা বলার আগে আমিতো নির্মাতাদের কথা বলতে চাই, আমাদের এখানে কাহিনিচিত্র নির্মাতই বেশি। তারা কজন প্রামান্যচিত্র দেখেন? কজন আমাদের কাজ দেখেছেন? তাদের মধ্যেই তো প্রামান্যচিত্রের ব্যাপারে একধরণের অচ্ছুতভাব আছে। আমার সবচেয়ে অবাক লাগে পারসোনাল স্টোরি টেলিংয়ের ব্যাপারটা কেউ জানেই না। আমাদের জানার দৌড়টা খুব কম। শুধু প্রামান্য চিত্র কেন আমাদের মর্ডান ফিকশন যে কোথায় আছে তা কি আমাদের নির্মাতারা জানেন? যারা একটু জানেন বলে আমরা জানি, তারাতো এখনও ওজু, কুরোসাওয়াতেই পড়ে আছে। অবশ্যই যারা মাস্টার তাদের জায়গা দিতে হবে। এখনকার ফিল্ম কোন জায়গায় গেছে তাও কি খুব স্পষ্ট? ফলে মাইকেল মুর কিংবা আরও দু একজন ছাড়া সারা বিশ্বেই প্রামান্যচিত্রনির্মাতাদের ঘরানাটা খুব একটা জনপ্রিয় নয়। কিন্তু তারকভস্কি বলি, কিওরাস্তামি বলি এরা প্রত্যেকেই শুরুতে প্রামান্যচিত্র নির্মাতা ছিলেন।
গ্লিটজ: প্রামান্যচিত্রের এই পিছনে পড়ে থাকার জন্য কি প্রামান্যচিত্র নির্মাতাদের অন্তর্মুখীতাকে দায়ি করবো ?
গ্লিটজ: তবু প্রামান্যচিত্রের তো একটা প্রচারের দরকার আছে। সেটার প্রক্রিয়াটা কীভাবে হবে?
গ্লিটজ: নির্মাতা শবনম ফেরদৌসীর দর্শনটা জানতে চাই
শবনম ফেরদৌসী: মানুষ হিসেবে আমার জীবন দর্শন খুব সরল। জটিলতা পছন্দ করিনা। জটিলকে সহজ করে দেখতে হবে। এটা আমার লাইফ প্র্যাকটিস। এ বয়সে এসে আমার মনে হয়েছে পুরনো কথাগুলো খুব সত্য। মা যে খনার বচন বলতেন সেসব। চিরায়ত বাক্যগুলোর উপর আস্থা এসেছে আমার। সারাজীবন প্রথাকে ভাঙতে ভাঙতেএসেছি। কিন্তু পায়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে না। চিরন্তন যে ঐতিহ্য, মানুষের টিকে থাকার গল্প তাকে সাথে নিয়েই আমি এগুতে চাই। কুপমন্ডুকতা থেকে দূরে থাকতে চাই। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর কথা যদি বলেন, আমি অতি জাতীয়তাবাদ পছন্দ করি না। অতি জাতীয়তাবাদ মানুষকে কুপমন্ডুক করে তোলে। শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতই শুনবো হিন্দি গান শুনবো না তা হতে পারেনা। নিজের স্বকীয়তা রেখে সব দেখতে হবে, জানতে হবে, করতে হবে।