ওর বিশেষত্বগুলোই-নাড়াচাড়া করে চলি এখন

নাট্যব্যক্তিত্ব খালেদ খান-এর মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মরণে লিখেছেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও তার সহধর্মীনী মিতা হক।

মিতা হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Dec 2016, 05:00 PM
Updated : 20 Dec 2016, 10:57 AM

আমার সারা বাড়ি জুড়ে খালেদ খানের ছবি। ওর দিকে তাকালে, ওর ছবির দিকে তাকালে দিনের নানা সময়ের, নানা ঘটনার কথা মনে পড়ে। সব সময় যে মন খারাপ হয়, তানা। খুব হাঁসি, খুব পুরনো দিনের স্মৃতিতে ফিরে যাই। আমার বিয়ের পরে সাধারণত কখনই সন্ধ্যা বেলায় বাড়িতে আসতো না। কারন ওই সময়টায় অফিস থেকে সরাসরি রিহার্সলে চলে যেতো। কখনও যদি আমাকে নিতে হতো, বাসায় এসে নিয়ে যেতো। তখন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের মহড়া চলতো। প্রতিদিনই কোনো না কোনো নাটকের মহড়া চলতো।

বিয়ের পর থেকে যুবরাজ যেমন আমার গানের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ভীষণভাবে। আমিও ওর নাটকের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছি। অভিনয় হয়তো করিনি,কিন্তু  প্রতিটি নাটকের, প্রতিটি রিহার্সল, প্রতিটি শো, তারপরে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রায় সব সদস্যের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কটা ওর ছিলো। সেটা আমার সঙ্গে নিবিড় হয়ে যায়। আমার বাড়ি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের তরুণ সদস্যদের জন্য নিজের বাড়ি হয়ে গেলো। রিহার্সলের পর আমার বাড়িতে খেতে আসতো। আড্ডা দিতে আসত ওরা।

ওই সন্ধ্যাটাই আমার বেশি  মনে পড়ে। পরবর্তী জীবনে যুবরাজ চলে যাবার ১০টি কিংবা ১২টি বছর একটু নিঃসঙ্গ ছিলো। কারণ তার হাঁটা-চলায় অসুবিধা ছিলো। তার শারিরীক ক্ষমতা, চলবার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিলো। সে যেহেতু অনেক জায়গায় যেতে পারত না, তাই আমাদের বাড়িতে ওর খুব কাছের বন্ধুরা আসতো। তবে তার অফিস, কার্যক্ষেত্রে সে যথেষ্ট নিয়মিত ছিলো।

তার মৃত্যুর দু’দিন আগেও সে অফিস করেছে। এটা প্রমাণ করে যে, সে পুরোপুরি সুস্থ অবস্থায় চলে গেছে। কিন্তু তার একটা শারিরীক সমস্যা হয়েছিলো। যেটার জন্য আমরা অনেকদিন সবাই মিলে প্রচণ্ডভাবে কষ্টটার সঙ্গে বাস করেছি।

খালেদ খান সম্পর্কে ভাবতে গেলে আমি প্রথমে ভাবব অভিনয়ের কথা। সেটা মঞ্চ। কারণ আমি তাকে চিনেছি মঞ্চের অভিনেতা হিসেবে এবং ঐ একই সময় সে গান শিখত আমার বড় চাচা ওয়াহিদুল হকের কাছে। আমার সঙ্গে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনেই পরিচয়। আমাকে সে গানের মানুষ হিসেবে চেনে। তাকে চিনি নাটকের মানুষ হিসেবে এবং যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিলো সম্মেলনে ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই নাটকটির নাম ‘অচলায়তন’। এ নাটকে যুবরাজ  যে চরিত্রে অভিনয় করত  সেটিই হচ্ছে অন্যতম প্রধান চরিত্র ‘পঞ্চক’। পঞ্চকের একই সঙ্গে নৃত্য, গান এবং অভিনয় মঞ্চে ছিলো।

ঐ যে মঞ্চের একটা দাপট। মঞ্চের যে একটি ঋজু মানুষ। সেই মানুষটাকেই আমি প্রথমে স্থান দেই তার সব গুনাবলীর উপরে।

তারপর যখন তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক, বিয়ে, জীবনযাপন- তখন আস্তে আস্তে করে তার বাকী যে গুণগুলো, সেগুলোর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। যেমন সে অত্যন্ত ভালো গান গাইতো। এতো ভালো গান গাইতো, যেমন যুবরাজ যদি গানই গাইতো, তাহলেও আজকে যে যুবরাজ সবার মনে আছে, সবাই তাকে ভীষণভাবে মনে রেখেছে, কোনোদিন ভুলবেনা।গান গাইলেও তাকে কেউ কোনো দিন ভুলতো না।

তার পরিবারের সবাই গান, নাটক ইত্যাদি পরিবেশে বড় হয়েছে। ভীষণ রকমের সংগীতপ্রীতি, নাটক এবং আমার আর তার রাজনৈতিক বিশ্বাস, রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে আমরা এক জায়গায় ছিলাম। জীবনের যে বড় বড় বিষয়গুলো, কালচারাল ফিলিংস, পলিটিক্যাল সেন্স, তারপরে অর্থনৈতিক বিষয়, এই বড় বড় বিষয়গুলোতে আমাদের কখনও খুনসুটি হতো না। আমরা একদম এক রকম ছিলাম, এক রকম ভাবতাম, ভালোলাগাগুলো এক রকম ছিলো। শুধুমাত্র দৈনন্দিন  সংসারে যা কিছু খিটিমিটি হয়। তা তো হতোই। সেটা না হলে আর সংসার কীসের। সেটা হতো।

আরেকটি কথা আমি অবশ্যই বলব, ভাইবোনদের এতো ভালোবাসতে আমি খুব একটা দেখি না। ওরা নয় ভাইবোন। যুবরাজ সবার বড়। আমার যখন বিয়ে হয়, তখন ওর ছোটবোন অনেক ছোট, স্কুলে যায়। এই সবগুলো ভাইবোনকে নিয়ে আমরা আসলে একসঙ্গে জীবনটা কাটিয়েছি। যুবরাজ ওদের ছাড়া কখনই কোনো আনন্দ একা উপভোগ করতো না।

যুবরাজ খুব বাজার করতে ভালোবাসতো, ভীষণ মাছ খেতো। ভীষণ মাছ কিনতে ভালোবাসতো। মাছ কিনে এনে সব ভাই বোনকে দাওয়াত দিতো। একটি জমাটি মানুষ। একা থাকতে একদমই পছন্দ করতো না। ও একাকীত্ব একদম সহ্য করতে পারতো না। সব সময় তার সঙ্গে মানুষ থাকতে হতো। ওকে আমি কখনও বাড়িতে একা আসতে দেখিনি। শুধু মধ্যাহ্নের বিরতিতে অফিস থেকে যখন বাড়িতে আসতো, তখন একা আসতো।

অসম্ভব খাদ্যরসিক এবং খেতে ভালোবাসত, খাওয়াতে ভালোবাসত।  এই ব্যাপারে তার বৈশিষ্ট্য আর বলে শেষ করা যাবে না। সে আমার শাশুড়ীর রান্না ভীষণ পছন্দ করতো। আমার শাশুড়ী আর আমি সব সময় অস্থির থাকতাম যে সে কোন খাবারটা ঠিক বলবে। ফ্রিজে রাখা মাছ কখনও খেতো না। যুবরাজ মানুষকে খুব খাওয়াতো।

বঙ্গবন্ধু। তার আদর্শ ছিল বঙ্গবন্ধু। আসলে আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই ওই বঙ্গবন্ধুর প্রেম একেবারেই নিমজ্জিত। আমাদের দুজনের গল্প যদি হতো, সেখানে হয়তো সত্তর ভাগ কথাই হতো দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, সংস্কৃতি নিয়ে। তারপর হয়তো নিজেদের কথা হতো।

আমার খুব ভালো লাগতো, সারাজীবনই লেখাপড়ায় আমি ভালো ছিলাম। এটা সত্য কথা কিন্তু আমি কোনোদিনই ক্লাসে প্রথম হওয়ার মতো মেয়ে ছিলাম না। আমি সব সময়মোটামুটি গড়ের ছাত্রী ছিলাম। ওর প্রতি আমার মোহ ছিলো। যুবরাজ খুব ভালো ছাত্র ছিলো। স্কুল জীবনে নাকি প্রতিটি ক্লাসেই প্রথম হতো। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনে সে ভালো করেছে।

তার বাচিক অভিনয়, সে যে আবৃত্তি করতো, সে যে নাটক পাঠ করতো, সে যে বিজ্ঞাপনে কণ্ঠ দিতো- তার বাচনটা এতোই স্পেশালাইজড ছিল, সে কিন্তু উচ্চারণের ওপরেবহুকাল বহু বহু ছাত্রদের ক্লাস নিয়েছে। এগুলো তো তার স্বীকৃতি ছিলোই। আমি স্ত্রী হিসেবে এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে খুব মোহগ্রস্থ ছিলাম যে, কি করে এতো সুন্দর করে কথা বলে,সুন্দর উচ্চারণ, এতো কিছু ।

ওর  তারকাখ্যাতি নিয়ে সঠিক কিছু বলতে পারবো না। একদিকে আমি গান গাইছি, একদিকে যুবরাজ নাটক করে বেড়াচ্ছে। আমার গান সব সময় ওর শোনাও হয় না। ওর সবনাটক দেখারও আমার সময় হয় না। ওর তারকা খ্যাতিটাকে খুব যে গর্ব করতো, তা না। অসুস্থ হওয়ার আগে অভিনয়ের কারণে তার যে একটা দারুণ খ্যাতি কিংবা ভক্ত তৈরি হয়েছিলো সারাদেশে। তখন মানুষ ওটা যেভাবে গ্রহণ করে। সেভাবেই করতো। পরের দিকে যারা ওর ভক্ত ছিল, তাদের সঙ্গে ওর একটা ঘরোয়া সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো। যে-ইযুবরাজের আবৃত্তি পছন্দ করছে, তার কাছে চলে আসছে। যে-ই যুবরাজকে  দেখতে পেয়েছে, দুটো কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। সে-ই যুবরাজের সঙ্গে বাড়িতে চলে এসেছে। যুবরাজতাকে নিয়ে গ্রামে চলে গেছে। তারকাখ্যাতির বিষয়ে আমি কি বলব।

খালেদ খান গ্রামের জীবন এবং গ্রামের যে গান, গ্রামের যারা শিল্পী, তাদের  পছন্দ করতো। ছোট বেলা যে গ্রামটা ছেড়ে এসেছে এতোকাল শহরে এসে। শহরে থেকে, এতো বিদেশীনাটক করেও কিন্তু তার টানটা ছিল ঐ নিজের গ্রামে। সে গ্রামেই যেতো।

সে ভীষণ একাডেমিশিয়ান।

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে সে শেষ পর্যন্ত চাকরি করেছে। এই ইউনিভার্সিটির গঠনের সময় থেকেই এর সঙ্গে সে যুক্ত। তার  পরিকল্পনায় এই ইউনিভার্সিটির শিক্ষাক্রম ঠিকঠাক হয়েছে। যার জন্য এই ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষও তাকে মাথায় করে রেখেছিলো। সে চলে যাওয়ার দুই তিন দিন আগে তাকে ট্রেজারার পদ দেয়াহয়। সে চিঠিটা হাতে পায়।

সে একটা কথা বলতো, “জানো আমার না সেটিসফেকশন নাই আমার জীবন নিয়ে। সাধারণ চাকরীগুলো তার ভালো লাগতো না। বলতো, ছোটকাল থেকে আমার ইচ্ছা আমি আব্বার মতো শিক্ষক হবো।” আমার শশুর শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতার প্রতি যুবরাজের এতো আগ্রহ ছিলো যে, সব সময় বলতো, “কয় নম্বরের যেনো যে আমি মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাশপাইনি।”  তাও কী, সেই পরীক্ষার আগের দিন সে মঞ্চে শো করেছে। শো বাতিল করতে পারেনি।

নানাবিধ কারণে তার দুঃখ ছিলো যে, সে রেজাল্ট ভালো করতে পারে নাই এবং শিক্ষকতার পেশায় যেতে পারে নাই। সারা জীবন তার এ খেদ টা ছিলো। কিন্তু শেষের দিকে যখন সে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে জয়েন করলো। তখন তার এ খেদ পুরোপুরি চলে গেলো।

খালেদ খান কিন্তু নিজ দলের বাইরে অনেক নাটক নির্দেশনা দিয়েছে। তার নির্দেশিত নাটকগুলো অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। তার নির্দেশিত ‘কালসন্ধ্যা’ নাটক, যেটি মঞ্চস্থকরেছে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। ঐ নাটকটা দেখে আমার মনে হয়েছে, ওর ডাইমেনশন কী রকম। যুবরাজ কত কিছু ভাবতে পারে, ওর ভাবনার ক্ষমতার পরিধিটা ওর নির্দেশিতঐ নাটকটি দেখে বোঝা গেছে। সেই সৌভাগ্যটা ওর নাই, সে করতে পারল না। অভিনয়টা করতে গেলে, নির্দেশনা দিতে গেলে কিন্তু নিজেকে মুভ করতে হয়। ওর মুভমেন্টটাই তো বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। হুইল চেয়ারে ছিল শেষের ছয় বছর।

২০ ডিসেম্বর আমরা টাঙ্গাইলে চলে গেছি ওকে নিয়ে। ওকে বিদায় দিতে চলে গেছি। মানুষকে বিদায় দিতে হয়। কিন্তু যুবরাজের সব কাজ এখনও করার মতো। কোনো কাজই ফেলেরাখার মতো না। তার নির্দেশনার মতো করে নাটক নির্দেশনা দেয়া উচিত। তার মতো করে কথা বলতে পারা উচিত, চেষ্টা করা উচিত ছেলে মেয়েদের। তার মতো করে গানগাইতে পারা উচিত। তার মতো করে পরিবারের একটা মুরব্বি হওয়া উচিত। সব ভাইবোনকে নিয়ে, মাকে নিয়ে, বাবাকে নিয়ে একসাথে একপাতে খাওয়ার যে একটা মন ছিলো, তা প্রচণ্ড ভালোবাসতো।

তার মেয়ে। তার মেয়ের জন্য ঈদের সময় যখন কোনো কিছু কিনতে যেতো, বাড়িতে আসার পরে আমি দেখতাম তার মানিব্যাগে ফুটো। একটি টাকাও মানিব্যাগে থাকতো না।এটা নিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। আমি হয়তো একটা জামা কিনেছি দুই হাজার টাকা দিয়ে। তার মানিব্যাগে সব টাকা দিয়ে সে অনেকগুলো জামা কিনে ফেলেছে।

তার মেয়ের জন্মদিনে সে যা গিফট দিতো, যতো গিফট দিয়েছে জন্মদিনে, আমি সব সময় তার কাছে হেরে গেছি। ওর গিফটগুলো অসাধারণ। একবার দেখা গেলো জয়িতার জন্মদিনে সমস্ত ঘর খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা। বলল যে, “তুমি একটা একটা করে কাগজ তুলো” ,  সারা ঘর ভর্তি জয়িতার অসংখ্য ছবি ফ্রেম করা। অ্যালবামে যতো ছবি ছিলো জয়িতার, সব ছবি বাঁধাই করে দিনে দিনে, দিনে দিনে চমৎকার একটা উপহার তৈরি করেছে।

আমার যতো জন্মদিন গেছে, বিবাহ বার্ষিকী গেছে, প্রতিবার আমাকে সে সারপ্রাইজ দিয়েছে। চমকে দিয়েছে। ওর গিফট টা পেয়ে আমার মনে হতো আমি হলে কখনোই এ রকমভাবতে পারতাম না।

যুবরাজ আসলে এতোই ওর মতো যে, আমি আসলে মেলাতে পারি না। ওর বৈশিষ্ট্যগুলো, ওর বিশেষত্বগুলোই-নাড়াচাড়া করে চলি এখন।

অনুলিখন : সোহেল আহসান