‘ওরা ১১ জন’ সিনেমা নয়, মুক্তিযুদ্ধের তথ্যচিত্র: মাসুদ পারভেজ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত স্বাধীনতা উত্তর কালের প্রথম সিনেমা ‘ওরা ১১ জন’ প্রযোজনা করেছিলেন অভিনেতা ও প্রযোজক মাসুদ পারভেজ, ঢাকাই সিনেমায় সোহেল রানা নামেই যিনি পরিচিত। সম্প্রতি গ্লিটজের সঙ্গে এক আড্ডায় ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমাকে ঘিরে নানান অজানা কথাই উঠে এলো।

তানজিল আহমেদ জনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2016, 07:33 AM
Updated : 16 Dec 2016, 03:40 PM

গ্লিটজ: ‘ওরা ১১ জন’ তৈরির পেছনে কোন ভাবনাটা কাজ করেছিল?

মাসুদ পারভেজ: অনেকেই তো ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে থাকেন। সেক্ষেত্রে ছবি তোলার নেপথ্যে বিভিন্ন কারণ হতে পারে। সেখানে হয়ত একটি উদ্দেশে হতে পারে তিনি মুহূর্তগুলোকে নিজের ক্যামেরায় ধারণ করে রাখতে চান। ঠিক তেমনি আমিও মূলত যুদ্ধের মুহূর্তগুলোকে ধারণ করে রাখার উদ্দেশ্যে সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলাম।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কিছু ঘটনা ঘটেছিলো। আমি চিন্তা করলাম আমাদের জীবনের সেই ছোট ঘটনাগুলোকে একসঙ্গে জুড়ে যদি একটি কিছু নির্মাণ করা যায় তাহলে খুব ভালোই হয়। এখানে কোনো সম্যসা থাকারও কথা নয়। তাই নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের সত্যি ঘটনাগুলোকে ডকুমেন্টেশন করতে গিয়ে ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমাটি নির্মাণ করা হলো।

গ্লিটজ: ওই সময়ে আপনি দৈনিক ইত্তেফাক-এর রূপবানীতে নিয়মিত সিনেমার উপর আর্টিকেল লিখতেন। কিন্তু তারপরেও কেন নিজে সিনেমার চিত্রনাট্য নিজে লিখলেননা?

মাসুদ পারভেজ: হ্যা, এটা ঠিক আমি গল্প লিখতাম। সিনেমার উপর অনেক পড়াশোনা করতাম। সে সময় আমার লেখা মাঝে মাঝে প্রতি বৃহস্পতিবার দৈনিক ইত্তেফাকের রূপবানীতেও প্রকাশিত হতো। এছাড়াও সেই সময় সিনেমা বিষয়ক ‘নূপুর’ নামে একটি মাসিক পত্রিকাও আমি প্রকাশ করতাম। আমি এর সম্পাদকও ছিলাম।

সেই সময় আমি একজনের লেখা খুবই পছন্দ করতাম। তিনি ‘মাসুম ইয়াহুদী’ ছদ্ম নামে খুব মজার গল্প লিখতেন। কিন্তু তার আসল নাম ছিলো আল মাসুদ। চাষী নজরুল ইসলাম-এর মাধ্যমে আমি তার সঙ্গে পরিচিত হই। তখন আমি আল মাসুদকে ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার গল্পগুলো শুনাই। তিনিই পরে আমার ছোট ছোট ঘটনার ফুলগুলোকে একসঙ্গে মালায় গেঁথে দিয়েছেন।

গ্লিটজ: ‘ওরা ১১ জন’- এই নামের নেপথ্যের কারন আসলে কী ছিলো?

মাসুদ পারভেজ: সিনেমার নাম শুধুমাত্র ‘ওরা’ হতে পারতো। আমার কাছে যে বিষয়টি মনে হলো, শব্দের মধ্যে একটি মিউজিক্যাল রিদম থাকা দরকার। এই সিনেমার জন্য যে কোনো নামের চেয়ে ‘ওরা ১১ জন’ নামের মধ্যে যে একটি মিউজিক্যাল রিদম রয়েছে, তা অন্য কোনো নামের ক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সিনেমার নাম ওরা ১৩ জন, ওরা ৭ জন, ওরা ৮ জন কিংবা ওরা ৯ জন সিনেমা যদি হয়, এখানে শব্দের মধ্যে কোন মিউজিক্যাল রিদম পাওয়া যায় না। কিন্তু ‘ওরা ১১ জন’য়ের ক্ষেত্রে একটি মিউজিক্যাল রিদম পাওয়া যাচ্ছে! শ্রুতিমধুরও লাগছে। ‘ওরা ১১ জন’ ছাড়া আর অন্য কোনো নামে কোনোভাবেই এটা মেলানো সম্ভব নয়।

গ্লিটজ: কিন্তু আমরা যে শুনেছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ১১টি সেক্টরের উপর ভিত্তি করে নাকি এই সিনেমার নামকরণ করা হয়?

মাসুদ পারভেজ: না, এটা মোটেই ঠিক নয়। একেবারেই মিথ্যা কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে ১১টি সেক্টর ছিলো তার উপর ভিত্তি করে আমার সিনেমার নাম ‘ওরা ১১ জন’ রাখবো- এত বড় চিন্তা আমি কখনোই করিনি। যিনি এমন কথা বলেছিলেন তিনি বতর্মানে আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। তিনি মারা গেছেন। কিন্তু তিনি সর্ম্পূণ মিথ্যা কথা বলে গিয়েছেন।

গ্লিটজ: আপনি কি মনে করেন ‘ওরা ১১ জন’ একট পরির্পূণ সিনেমা?

মাসুদ পারভেজ: ‘ওরা ১১ জন’ মোটেই একটি ভালো সিনেমা নয়। বরং ‘ওরা ১১ জন’ একটি ভালো ডকুমেন্টারি ফিল্ম। একজন নির্মাতা হিসেবে বলতে চাই আমার দৃষ্টিতে ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমা নয়। এটাকে মুক্তির যুদ্ধের একটি তথ্যচিত্র বলা যেতে পারে। 

গ্লিটজ: আপনি কেন ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমাকে যুদ্ধের সিনেমা বলতে চাইছেন না?

মাসুদ পারভেজ: এটা যুদ্ধের সিনেমা না। কারণ যুদ্ধের সিনেমা হতে হলে প্রতিটি দৃশ্যে যেসব উপকরণ প্রয়োজন আমরা সেই সব প্রয়োজনীয় সব উপকরণ তো পাইনি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু সহযোগিতা করা সম্ভব ছিলো সেইটুকু করা হয়েছে। আজকের তুলনায় বলতে গেলে আমাদের একশগুণ বেশি সহযোগিতা করা হয়েছে।

এছাড়াও একটি যুদ্ধের সিনেমা নির্মাণ করতে হলে একজন নির্মাতার প্রতিটি দৃশ্যে যে বক্তব্য দর্শককে বোঝানো প্রয়োজন, সেই সব জিনিসের কোনটাই এই সিনেমায় নেই। এখানে রয়েছে শুধুমাত্র কিছু ছবি। যেগুলো প্রমাণ করে যুদ্ধের সময় এমন ঘটনাগুলোই ঘটেছে। তাই এটা ফিল্ম, কিন্তু ডকুমেন্টরি ফিল্ম।

গ্লিটজ: সিনেমায় ছোট ছোট গল্পগুলোকে একসঙ্গে গাঁথার সময় কি কোন পরিবর্তন করা হয়েছিলো?

মাসুদ পারভেজ: আসলে সিনেমায় ১১ জনের প্রত্যেকের ছোটছোট ঘটনা গুলোর ভিত্তিতেই তাদেরকে কাস্টিং করা হয়েছিলো। তাই তাদের প্রত্যেকের গল্পগুলোকে সাজিয়ে লেখার সময় হয়ত কোনো কোনো আমি’র স্থলে তুমি কিংবা আপনি-এমন ছোটখাট পরিবর্তন হয়েছে সিনেমার গল্পের যে গতি কিংবা কাঠামো থাকে তা রক্ষা করার জন্য।

গ্লিটজ: সিনেমায় ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানটি নির্বাচনের বিষয়টি কীভাবে হয়েছিলো?

মাসুদ পারভেজ: একটি সিনেমায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক প্রয়োজন। আমরা মনে করি যদি এখানে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের বদলে যদি এই গানটি (এক সাগর রক্তের বিনিময়ে) ব্যবহার করা হয় তা অনেক বেশি শক্তিশালী হবে। 

গ্লিটজ: এই সিনেমার দৃশ্যধারণের সময়কার কিছু নেপথ্যের গল্প শুনতে চাই…

মাসুদ পারভেজ: সিনেমার দৃশ্যধারণের সময় অনেক সময়ই গল্প করতে গিয়ে অনেকেই কান্নাকাটি করেছেন। কোনো একজন তার ব্যক্তিগত জীবনের গল্প বলতে গিয়ে কান্না করেছেন।

তবে একটি দৃশ্যে ধারনের কথা এই মূহূর্তে মনে পড়ছ, একটি দৃশ্যে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ দিয়ে একটি ঘর ধ্বংস করার প্রয়োজন ছিলো। সেই দৃশ্যে ঘরটি প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া সময় সেখানে একশ একটি স্টেনগান ছিলো। কিন্তু দৃশ্যধারন শেষে যখন অস্ত্র গনণা শুরু হলো তখন একটি কম পাওয়া গেলো। একটি গান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন তো সবার মাথা গরম। আমার মাথা গরম, খসরুর মাথা গরম। অনেক খোঁজ করার পরে হঠাৎ একজন সেই স্টেনগানটির পাওয়ার খবর দিলেন।

আরেকটি ঘটনা হলো সাভারের জয়দেবপুর অতিক্রম করার পরে কালিয়াকৈর-এর কড্ডায় একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিজ ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ই সেই ব্রিজটি অর্ধেক ভাঙ্গা ছিলো। বতর্মানে সেই ব্রিজটি নেই। আমরা সিনেমার একটি যুদ্ধের দৃশ্যের জন্য সেই ব্রিজটিকে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ধ্বংস করে ফেলি।

গ্লিটজ: বঙ্গবন্ধু কী ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমাটি দেখেছিলেন?

মাসুদ পারভেজ: হ্যা, বঙ্গবন্ধু এই সিনেমাটি দেখেছিলেন। সিনেমাটি দেখে তিনি আমাকে বলেছিলেন, “ভালোই তো বানাইছিস…ফিল্মেই থাক।”

গ্লিটজ: তাহলে কি আমরা বলতে পারি বঙ্গবন্ধুর পরামর্শেই আপনি সিনেমার নায়ক হয়ে গেলেন?

মাসুদ পারভেজ: এটা আমার জন্য পরামর্শ নয় বরং এটা ছিলো আমার জন্য নির্দেশ। তারপরেই আমি সিনেমায় কাজ শুরু করলাম। আমার দ্বিতীয় সিনেমাতে আমি হিরো হয়ে গেলাম। দর্শকরা আমাকে প্রাণভরে ভালোবেসে গ্রহন করলেন। আমার প্রথম সিনেমার মাধ্যমে আমি ঢাকাই সিনেমার সুপারস্টার বনে গেলাম।

গ্লিটজ: ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমাটি মুক্তির পরে দর্শকের কাছ থেকে সাড়া কেমন পেয়েছিলেন?

মাসুদ পারভেজ: এই সিনেমাটি আমাকে বাংলাদেশের বিল গেইটস বানিয়ে দিয়েছিলো! আমার এই সিনেমাটি এতোই সাড়া ফেলেছিলো যে আমি সেসময় বিল গেইটস-এর মতোই বড়লোক হয়ে গিয়েছিলাম! সিনেমার বাজেট ছিলো মাত্র সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। কিন্তু আমি আয় করেছি প্রায় বিশ লাখ টাকার মতো!