দিলিপ কুমারেকে ট্র্যাজিডি কিং বানালো যে ছবি

দিলিপ কুমার। হিন্দি ছবির শতবর্ষের ইতিহাসে যে অভিনয় শিল্পীরা কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন তাদের অসামান্য প্রতিভায় দিলিপ কুমার তাদের মধ্যে আছেন প্রথম সারিতে। ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর এই মহান নায়কের জন্ম।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Dec 2016, 10:11 AM
Updated : 11 Dec 2016, 10:11 AM

সব মেজাজের ছবিতেই সাফল্যের পরিচয় দিলেও তার মূল খ্যাতি ট্র্যাজিডি অভিনয়ের জন্য। বলিউডে তাকে অভিহিত করা হয় ‘ট্র্যাজিডি কিং’ বিশেষণে। ১৯৫১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দিদার’ ছবির আকাশ ছোঁয়া সাফল্যই বলিউডে প্রথম তাকে ট্র্যাজিডি কিং হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ছবিটিতে তার সহশিল্পী ছিলেন নার্গিস, অশোক কুমার ও নিম্মি। নিতিন বোস পরিচালিত ছবিটির মূল সম্পদ ছিল দিলিপ কুমারের আবেগঘন অভিনয় এবং নওশাদের সুরে মোহাম্মদ রফির কণ্ঠে হৃদয়ছোঁয়া সংগীত।

ছবির কাহিনি শুরু হয় দুই শিশুর খেলার মধ্য দিয়ে। শামু ও মালা দু’জন খেলার সাথী। বিশাল ধনী জমিদার শেঠ দৌলতরামের মেয়ে মালা। আর গরীব বিধবা মায়ের ছেলে শামু। মালার বাবার নিষেধ সত্ত্বেও এই দুই শিশুসাথী পরষ্পরের সঙ্গ খুঁজে নেয়। একদিন ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে আহত হয় মালা। সকলে মনে করে শামুই তাকে ফেলে দিয়েছে ঘোড়া থেকে। কিন্তু মালা সেটা মনে করে না। মালার বাবার নির্দেশে ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয় শামু ও তার মাকে।

পাহাড়ি পথে মৃত্যু হয় মায়ের। কাছাকাছি গ্রামের এক সহৃদয় গৃহস্থের ঘরে আশ্রয় পায় শামু। রাতের বেলা সে পালিয়ে চলে যেতে চায় মালার কাছে। কিন্তু ঝড়ের মধ্যে দুর্ঘটনায় পড়ে সে অন্ধ হয়ে যায়। সেই গৃহস্থের বাড়িতেই বেড়ে ওঠে শামু। গৃহস্থের মেয়ে চম্পা ও ছেলে বল্লম তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়। অন্ধ শামু চমৎকার গান গায়। তার গানে ঝরে পড়ে শৈশবের সাথীকে হারানোর বেদনা। চম্পা ভালোবাসে শামুকে।

চৌদ্দ বছর পার হয়ে যায়। এদিকে মালাও বড় হয়। পারিবারিকভাবে তার সঙ্গে বিয়ে স্থির হয় কিশোর নামে এক ধনী যুবকের। তারা পরষ্পরকে ভালোবেসে ফেলে। কিশোর চোখের চিকিৎসক। ডা. কিশোর কিছুদিনের জন্য এক পাহাড়ি অঞ্চলে বেড়াতে যায়।

আশ্রয়দাতা গৃহস্থের মৃত্যুর পর অভাবে পড়ে চম্পা, বল্লম ও শামু। মহাজনের ঋণ শোধ করার জন্য অন্ধ কবি শামু গ্রামের হাটে গান গেয়ে পয়সা রোজগার করে। তার গান শুনে মুগ্ধ হয় ডা.কিশোর। সে তাকে পরীক্ষা করে দেখে। এবং জানায় অপারেশনের মাধ্যমে শামু দৃষ্টি ফিরে পেতে পারে। দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কিশোর চম্পার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারে সে শামুকে ভালোবাসে। কিশোরের ধারণা হয় হয়তো শামুও চম্পাকে ভালোবেসেই প্রেমের গান বাঁধে। কিশোরের কাছে শামু কবিরাজ নামেই পরিচিত হয়।

কিশোরের কাছে বেড়াতে আসে মালা ও তার বাবা। ডাক্তারকে গান শোনাতে এসে মালার সাথে নতুনভাবে পরিচয় হয শামুর। তার গানে মুগ্ধ হয় মালা। জরুরি খবর পেয়ে বাড়ি ফিরে যায় মালা, তার বাবা ও কিশোর। মালার বাবা কিশোরের জন্য একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু তার আগে চিকিৎসক হিসেবে নিজের সাফল্য প্রমাণ করতে চায় কিশোর। তাই সে কবিরাজকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসে চিকিৎসার জন্য। মালার বাড়িতেই কবিরাজের জায়গা হয়।

শামুর চোখে অপারেশন করে কিশোর। সে দৃষ্টি ফিরে পায়। সে ডাক্তারকে খুলে বলে তার শৈশবের প্রেম কাহিনী। শেঠ দৌলতরামের মেযে মালাকে সে ভালোবাসে এ কথা জানতে পেরে বিষ্ময়ে স্তব্ধ হযে যায় কিশোর্। সে শামুকে মালার পরিচয় জানিয়ে তার কাছে পৌঁছে দেয়। কিন্তু সে যে তারই বাগদত্তা একথা বলে না। অন্যদিকে মালাও জানে না কবিরাজ নামে পরিচিত এই গায়কই তার ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া সাথী শামু। বাড়িতে এক বড় জলসার আয়োজন করে মালা। কবিরাজের গানে মুগ্ধ হয় অতিথিরা।

এদিকে শামুকে খুঁজতে পথে বেরিয়ে পড়ে চম্পা। সে ঠিকানা খুঁজে পৌঁছে যায় মালার বাড়িতে। দেখা করে শামুর সাথে। কিন্তু শামু দুঃখের সঙ্গে জানায় সে তাকে নয় ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসে একমাত্র মালাকেই। গভীর দুঃখ নিয়ে ফিরে যায় চম্পা।

কিশোর, মালা ও শামু বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যায়। একদিন তিনজন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বেড়াতে বের হয়। সেসময় একটি ছোট শিশুকে ঘোড়া চালাতে দেখে কবিরাজ শৈশবের পরিচিত গানটি গেয়ে ওঠে। গান শুনে অস্থির হয়ে পড়ে মালা। পরে কিশোরকে সে বলে এই গান তার ছোটবেলার পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। যদিও কবিরাজকে সে আগে চিনতো না। কিন্তু এই গানের মধ্যে এমন কিছু আছে যা তাকে ছোটবেলার কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে।

মালাকে হারানোর আশংকায় কবিরাজের সঙ্গে তর্ক বিতর্কের এক পর্যায়ে তাকে আঘাত করে কিশোর। কিন্তু তারপরই সে অনুতপ্ত হয় বন্ধুকে আঘাত করেছে এ কথা ভেবে। এদিকে শেঠ দৌলতরাম কিশোর ও মালার বিয়ে দ্রুত দিয়ে দিতে চান। কিশোর শেঠকে বলে, কবিরাজ বলে সবাই যাকে ডাকে তার প্রকৃত নাম শামু। সে শৈশব থেকেই মালাকে পূজা করে। মালার প্রতি তার প্রেমের তুলনায় শামুর প্রেম অনেক বড় ও মহান। তাই মালার বিয়ে শামুর সঙ্গেই হওয়া উচিত।

মালাকে নিজের পরিচয় দেয়ার আগেই সে জানায় কিশোরকে সে ভালোবাসে এবং অচিরেই তাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে। একথা শুনে শামু আর মালাকে জানায় না তার আসল পরিচয়। শামু সিদ্ধান্ত নেয় মালা ও কিশোরকে সুখি করার জন্য সে নিজের ভালোবাসাকে উৎসর্গ করবে।

কিশোরকে শামু বলে তার বন্ধুত্ব ও মহত্বের কাছে তার ভালোবাসা পরাজিত হয়েছে। এদিকে শেঠ দৌলতরাম শামুকে ডেকে বলে তার মেয়ের জীবন থেকে সরে যেতে। বিনিময়ে তাকে দেয়া হবে অনেক টাকা। তিনি শামুর হাতে রিভালবার তুলে দিয়ে বলেন তাকে হত্যা করতে। কারণ জীবন থাকতে তিনি দেখতে পারবেন না যে তার মেয়ের বিয়ে হয়েছে ভিখারির সঙ্গে। বিপর্যস্ত শামু ঘরে ফেরে। মালা তাকে উপহার দেয় নতুন পোশাক। কারণ কিশোরের সঙ্গে তার বিয়ের দিন সে যেন সুন্দর পোশাক পরতে পারে। মালাকে শেষবারের মতো প্রাণভরে দেখে শামু। তারপর নিজে হাতে নষ্ট করে ফেলে চোখ। কিশোর তাকে পৌঁছে দেয় চম্পার কাছে। মালা জানতেও পারে না কবিরাজের আসল পরিচয় এবং তার ভালোবাসার কাহিনী।

আত্মত্যাগী কবি শামুর ভূমিকায় দর্শকের মন জয় করে নেন দিলিপ কুমার। মালার ভূমিকায় ছিলেন নার্গিস। ডা.কিশোরের চরিত্রে স্বচ্ছন্দ ছিলেন অশোক কুমার। চম্পা চরিত্রে ছিলেন ট্র্যাজিডি অভিনয়ে পারদর্শী নিম্মি।

এই ছবির ‘বাচপানকো দিন ভুলানা’ এবং অন্যান্য গান তুমুর জনপ্রিয়তা পায়। ছবিটি বিভিন্ন সময় তামিলসহ ভারতের বেশ কয়েকটি ভাষায় রিমেইক হয়। সবকটি রিমেইকই ব্যবসা সফল হয়েছে।

মেলোড্রামাটিক ছবিটি উচ্চকিত গল্প ও নাটকীয়তায় ভরপুর। তবে দিলিপ কুমারের অভিনয় প্রতিভার অসামান্য দলিল হিসেবেই ‘দিদার’ হিন্দি ছবির জগতে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। নওশাদের সংগীত পরিচালনা ছিল অনবদ্য। সেই সঙ্গে কবি শাকিল বাদাইউনির কথায় দুর্দান্ত গান উপহার দেন মোহাম্মদ রফি। প্লেব্যাকে আরও ছিলেন লতা মঙ্গেগেশকার, শামশাদ বেগম ও জি এম দুররানি। দিলিপ কুমার-রফি জুটিরও অনবদ্য নির্দশন এই ছবি।

ইউটিউব এবং বেশ কয়েকটি মুভি সাইটে ‘দিদার’ দেখতে পারেন পুরানো দিনের হিন্দি ছবির দর্শকরা। বিশেষ করে কিংবদন্তির মহা নায়ক দিলিপকুমারের জন্মদিনে দেখা যেতে পারে তাকে ট্র্যাজিদি কিং খেতাব এনে দেওয়া সিনেমা ‘দিদার’।