আঁধি: প্রেম বনাম রাজনীতি

একজন সফল রাজনৈতিক নেত্রী এবং তার হারানো প্রেম- বলা যায় মোটা দাগে ‘আঁধি’ ছবির এটাই মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু এটাই সব নয়। রাজনীতির অন্ধকার দিক, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ব্যক্তিগত আবেগের টানাপোড়েন, সামাজিক পরিস্থিতি এসব কিছু মিলিয়ে অসাধারণ এক উচ্চতায় উঠে যায় ছবিটি। কাহিনী, সংলাপ, পরিচালনা এবং অভিনয় ছবিটিকে নিয়ে যায় ক্ল্যাসিকের মর্যাদায়। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের সঙ্গেও কিছু কিছু মিল থাকায় ছবিটি বিতর্কের মুখেও পড়ে। এ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন এবং সঞ্জীব কুমার।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Nov 2016, 09:02 AM
Updated : 6 Nov 2016, 09:02 AM

ছবিটি শুরু হয় বিভিন্ন দলের নির্বাচনী প্রচারণার দৃশ্যের মধ্য দিয়ে। চন্দর সেন একজন রাজনৈতিক নেতা। তিনি নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। তিনি বিরোধী দলীয় নেতা। বক্তব্য রাখছেন সরকারদলীয় জনপ্রিয় নেত্রী আরতি দেবীর বিরুদ্ধে। আরতি দেবীর প্রতিপক্ষ দুজন। চন্দরসেন ও গুলশান খান।

আরতিদেবী নির্বাচনী প্রচারণার কাজে মফস্বলের এক ছোট শহরে আসেন। দলীয় লোকজনসহ একটি হোটেলে ওঠেন তিনি। হোটেলের নিজস্ব কক্ষে ঢুকে অবাক হযে যান আরতি। কারণ ঘরটিতে চন্দনের আগরবাতি, সরাইতে পানি এসব দেখে তার মনে হয় সেখানে এমন কেউ আছেন যিনি তার পছন্দ-অপছন্দ বিষয়ে জানেন। এমনকি জন্মদিনে হলুদ গোলাপের তোড়া উপহার পেয়েও অবাক হন তিনি।

পরে বৃন্দা কাকা নামের এক বৃদ্ধ পরিচারকের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন এই হোটেলের ম্যানেজার হলেন তার পূবর্পরিচিত। ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে আসেন আরতি। তাদের কথোপকথনের ভিতর দিয়ে দর্শক বুঝতে পারে তাদের মধ্যে একসময় প্রবল ভালোবাসা ছিল। কিন্তু তাদের সম্পর্ক কি তা তখনও পরিষ্কার হয় না দর্শকের কাছে। এরপর টুকরো টুকরো ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে জানা যায় ম্যানেজার জেকে সাহেব আরতি দেবীর স্বামী। এই দম্পতি গত নয় বছর ধরে পৃথকভাবে বাস করছেন। তাদের একমাত্র সন্তান মনোরমা হোস্টেলে রয়েছে।

আরতি দেবীর বাবা ছিলেন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাবার আগ্রহ ও অনুপ্রেরণাতেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। আর রাজনীতির কাজে ব্যস্ততা থেকেই তার দাম্পত্য জীবন বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ তার স্বামীর ধারণা ছিল রাজনীতিতে শঠতা ও চতুরতাই এখন প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে আগের মতো ত্যাগ স্বীকার করার প্রবণতা নেতাদের মধ্যে আর নেই। তিনি ক্ষমতার এই দাবাখেলা পছন্দ করতেন না। তার মত ছিল রাজনীতিতে মানবসেবা উপেক্ষিত এবং ক্ষমতার নেশাই প্রধান। আদর্শগত এই দ্বন্দ্ব থেকেই দুজনের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং তারা পৃথক বসবাস শুরু করেন।

মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী আরতি দেবী এমন একজন রাজনীতিবিদ যিনি রাজনীতিতে কোনো ছলচাতুরী বা নীতিহীনতা পছন্দ করেন না। কিন্তু তার প্রতিপক্ষরা এমন নয়। এদিকে আরতি দেবীর এই সততা নিয়ে বিরক্ত তার দলের নেতাকর্মীরাও। কারণ তাদের ধারণা শঠে শঠাং পদ্ধতিই রাজনীতিতে চলে।

আরতিদেবী এক জনসভায় যোগ দিতে গিয়ে বিরোধীদলের গুন্ডাদের হামলায় আহত হন। কিন্তু এই ঘটনা তার পক্ষে জনতার সহানুভূতি সৃষ্টি করে।

রাজনৈতিক চাল পাল্টা চালের মধ্য দিয়ে কাহিনী এগিয়ে চলে। ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে জানা যায় কিভাবে ধনী ও রাজনৈতিক নেতা কে. বোসের একমাত্র সন্তান আরতির সঙ্গে এক বড় হোটেলের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার জেকের দেখা হয়। এই দেখার মাধ্যমেই তাদের প্রেমের সূচনা হয়।

তারা বিয়ে করেন আরতির বাবার অমত সত্বেও। বাবার কারণেই ভাঙন ধরে তাদের সম্পর্কে।

বহুদিন পর দেখা হওয়ায় তাদের মধ্যে আবার পুরানো ভালোবাসা ফিরে আসে। তাদের দাম্পত্যের মধুর দিনগুলোর স্মৃতি দুজনকেই আলোড়িত করতে থাকে প্রবল ভাবে।

এদিকে হোটেল ম্যানেজারের সঙ্গে আরতি দেবীর ঘনিষ্টতা নিয়ে শুরু হয় গুঞ্জন।  তারা দুজন চুপি চুপি দেখা করেন। এসব খবরে তার দলের কর্মীরা বিরক্ত হয়। অন্যদিকে বিরোধী দল তার চরিত্রের সমালোচনায় মুখর হযে ওঠে।

এমন পরিস্থিতিতে কাহিনীতে নাটকীয় মোড় নিয়ে আসে এক জনসভা। সেখানে আরতি দেবী বলেন তাদের দাম্পত্যের ইতিহাস। এবং কিভাবে তিনি রাজনীতির জন্য নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে বলি দিয়েছেন সেকথা খুলে বলেন।

জনতা আবেগআপ্লুত হয়ে পড়ে। আরতি রাজনীতি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন।

নির্বাচন শুরু হয়। প্রচণ্ড টেনশন চলে। তারপর বিভিন্ন এলাকা থেকে আরতির জয়ের খবর আসতে থাকে। আরতি দেবী বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। তিনি আবার ফিরে যান তার কর্মজীবনে।

ছবিতে আরতি দেবীর চরিত্রে সুচিত্রা সেন অনবদ্য অভিনয় করেন। তেমনি জেকে চরিত্রে সঞ্জীব কুমারও ছিলেন অসামান্য। ছবিটির পরিচালনা, সংগীত রচনা ও চিত্রনাট্যে ছিলেন গুলজার। আঁধি মুক্তি পায় ১৯৭৫ সালে। মুক্তির পরপরই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার স্বামী ফিরোজ গান্ধীর জীবনের সত্যি ঘটনার ভিত্তিতে এটি নির্মিত হয়েছে। পর্দায় সুচিত্রা সেনের মেকআপ এবং আরতি দেবীর চরিত্রের সঙ্গে সত্যিই ইন্দিরা গান্ধীর ব্যাপক সাদৃশ্য দর্শকদের চোখে পড়ে। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ছবিটি মুক্তির ২৬ সপ্তাহ পর এটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সেসসময় গুলজার অবশ্য বারে বারে বলেন যে, এই ছবির সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের কোনো মিল নেই। ছবিতে সেন্সর বোর্ডের নির্দেশে বেশ কিছু দৃশ্যে পরিবর্তন আনা হয়। তবে ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের পরাজয়ের পর নতুন সরকারের আমলে গুলজার স্বীকার করেন যে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর আদলেই আরতি দেবীর চরিত্রটি গড়ে তুলেছিলেন।

ফিল্মফেয়ার আসরে ছবিটি বেস্ট ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড জয় করে। এবং এ ছবির সুবাদে সঞ্জীব কুমার সেরা অভিনেতার পুরস্কার ঘরে তোলেন। সেরা অভিনেত্রী, সেরা পরিচালনা সহ পাঁচটি বিভাগে নমিনেশন পায় আঁধি।

ছবির সংগীত পরিচালনা করেন রাহুল দেব বর্মণ। কিশোর কুমার ও লতা মংগেশকারের কণ্ঠে ‘তেরে বিনা জিন্দেগিসে’, ‘তুম আ গায়ে হো’, ‘ইস মোড় সে’ গানগুলো চিরসবুজ প্রেমের গান হিসেবে গণ্য হয়। আঁধির গানগুলো এখনও বলিউডের সর্বকালের সেরা জনপ্রিয় গানের তালিকায় রয়েছে।

পরিচালকের মুন্সীয়ানা, অভিনয়, কাহিনী ও চিত্রনাট্যে অসাধারণ আঁধি তার বক্তব্যের জন্যও পায় ক্ল্যাসিকের মর্যাদা।

প্রেম ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব, একজন জননেত্রীর ব্যক্তিগত জীবন, আবেগের টানাপোড়েন, রাজনীতির ভিতরের চতুর খেলা, সততা ও দেশপ্রেম বনাম শঠতা ও ক্ষমতার লোভ এসবই আঁধিতে তুলে ধরা হয় এমন সুষমভাবে যে ছবিটি শিল্পোতীর্ণ হয়ে ওঠে।

অভিনেতা সঞ্জীব কুমারের জীবনের অন্যতম সেরা ছবি আঁধি বলিউডের ক্ল্যাসিক ছবির দর্শকদের কাছে আজও আদরণীয় হয়ে আছে এর অসামান্য নির্মাণের গুণে।