তারেক মাসুদ: সেলুলয়েডের ফিতায় বাঁধা জীবন

তারেক মাসুদ- আধুনিক ভাষা ও সমকালীন বিষয়াবলীর জোরালো উপস্থাপনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ।ঠিক পাঁচ বছর আগে এই দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সেদিন সে মৃত্যুর মিছিলে আরও ছিলেন গুণী সাংবাদিক ও তারেক মাসুদের দীর্ঘ দিনের বন্ধু ও সহকর্মী মিশুক মুনীর।

প্রমা সঞ্চিতাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 August 2016, 12:06 PM
Updated : 13 August 2016, 12:08 PM

চিরকাল সিনেমার সঙ্গে জীবনকে বেঁধে রাখা এই নির্মাতার মৃত্যুটাও হয়েছিল সিনেমার কাজেই। নতুন ছবি ‘কাগজের ফুল’-এর শ্যুটিং শেষে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়েন তিনি।

তারেক মাসুদ ছিলেন একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক ও গীতিকার। বাংলাদেশে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রবক্তা। যদিও খুব কাজ তিনি করে যেতে পারেননি, কিন্তু দেশি বিকল্পধারা চলচ্চিত্রকে আন্তজার্তিক মানে নিয়ে যা্ওয়ার ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অপরিসীম। সেলুলয়েডে তার রেখে যাওয়া সৃষ্টি নিয়ে এবারের আয়োজন।

মাটির ময়না(২০০২)

তারেক মাসুদের অন্যতম সেরা কাজ বিবেচনা করা হয়ে থাকে এ ছবিটিকে। এটি তার প্রথম পূর্ণদৈঘ্য চলচ্চিত্র।

ষাটের দশকের উত্তাল সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগের সময়ের একটি পরিবার কিভাবে যুদ্ধ ও ধর্মের কারণে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়-- সেই গল্প নিয়েই বানানো হয়েছে সিনেমাটি।

অনেকের মতেই ছবির মূল চরিত্র মাদ্রাসায় পড়ুয়া ‘আনু’ চরিত্রের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে পরিচালকের নিজের ছেলেবেলার গল্প। মূলত স্বাধীনতা যদ্ধের প্রাক্কালে এক গোঁড়া মুসলিম লীগ সমর্থক বৃদ্ধের স্বাধীনতা বনাম ধর্মীয় মূল্যবোধের টানা-পোড়েন এ ছবির মূল পটভূমি। মাটির ময়নার জন্য তিনি ২০০২-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টর ফোর্টনাইট সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। সেবছর অস্কারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিল ছবিটি।

অর্ন্তযাত্রা (২০০৬)

তারেক মসিুদের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘অর্ন্তযাত্রা’। এক প্রবাসী বাঙ্গালী নারী ও তার ছেলের স্বদেশ যাত্রার গল্প এটি। এই সিনেমার মাধ্যমে প্রবাসী জীবনের দ্বন্দ্বিক সত্যের মূল খুঁজেতে দেখা গেছে পরিচালককে।

দীর্ঘদিনের প্রবাস জীবনে অভ্যস্ত মা-ছেলের স্বদেশ ভ্রমণ বা শেকড়ের সন্ধানকে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গেই তুলে ধরেছেন এ গুণী নির্মাতা। সিনেমাটি ২০০৬ সালের ঢাকা আর্ন্তজাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সেরা চলচ্চিত্র’ হিসেবে নির্বাচিত হয়। একই বছরে দিল্লিতে আয়োজিত ‘এশিয়ান সিনেফ্যান’ উৎসবে বিচারকের দৃষ্টিতে সেরার খেতাব অর্জন করে।

রান্ওয়ে (২০১০)

বাংলাদেশের ২০০৫-০৬ সালে চলমান মৌলবাদ ইস্যু নিয়ে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদ ছাড়াও তৈরী-পোশাক শিল্পের নারীশ্রমিক, ক্ষুদ্রঋণনির্ভর এনজিও কার্যক্রম এবং বিদেশে অভিবাসী শ্রমিকদের বঞ্চনার মতো বিষয় নিয়ে্ও তার বক্তব্য তুলে ধরেন তারেক মাসুদ।

২০১০ সালে যে কথা তারেক মাসুদ বলতে চেয়েছিলেন এ মুহূর্তে সেটাই সত্য হিসেবে দেখা দিয়েছে গুলশান হামলার বাস্তবতায়। সে দিক থেকে এই সিনেমার মাধ্যমে যে দূরদর্শিতার পরিচয় নির্মাতা দেখিয়েছিলেন, তা আজও অসামাণ্য বলেই মনে করেন অনেকে।

তারেক মাসুদের প্রামান্য ও তথ্যচিত্র:

মুক্তির গান(১৯৯৫) ও মুক্তির কথা(১৯৯৯)

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য এদেশে আসেন মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন। 'বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পীসংস্থা' নামের একটি দলের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরনার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করার দৃশ্যগুলোকে ক্যামারায় ধারণ করেন তিনি। কিন্তু আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রামাণ্যচিত্রটি শেষ করতে পারেননি তিনি।

১৯৯০ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে লেভিনের কাছ থেকে এই ফুটেজ সংগ্রহ করেন। প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ নিয়ে পরবর্তীতে নির্মিত হয় ‘মুক্তির গান(১৯৯৬)’ ও ‘মুক্তির কথা(১৯৯৯)’ প্রামান্যচিত্র দু’টি।

‘আদম সুরত’(১৯৮৯)

শিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে আহমদ ছফা রচিত একটি লেখা ১৯৮২ সালে তারেক মাসুদকে এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে অণুপ্রাণিত করে। এরপর টানা সাত বছরধরে শিল্পীর সান্নিধ্যে থেকে এ তথ্যচিত্রটি নির্মান করেন তারেক মাসুদ। ১৬ মিলিমিটার ক্যামেরায় ধারণকৃত ৫৪ মিনিটের এ তথ্যচিত্রটি দর্শকমহলে যথেষ্ঠ সমাদৃত হয়।

এছাড়া তিনি নির্মান করেছেন- ‘নারীর কথা’, ‘ইন দ্য নেইম অফ সেফ্‌টি’, ‘আ কাইন্ড অফ চাইল্ডহুড’, ‘ভয়েসেস অফ চিলড্রেন’ –এর মতো প্রামাণ্যচিত্রগুলি।

এছাড়াও বেশকিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন তারেক মাসুদ।

তার নির্মিত স্বল্পদৈঘ্য ছবিগুলো হলো- সোনার বেড়ি (১৯৮৫), সে(১৯৯৩), নরসুন্দর(২০০৯), শিশু কথা(১৯৯৭), নিরাপত্তার নামে(১৯৯৯), বিপন্ন বিস্ময়, নিরপরাধ ঘুম, ‘সুব্রত সেনগুপ্ত ও সমকালীন বঙসমাজ’ এবং ‘ইউনিসন’ (এনিমেশন)।

তারেক মাসুদ খুব বেশি কাজ করে যেতে পারেননি। কিন্তু প্রতিটি কাজেই রয়েছে তার নিজস্ব কিছু বক্তব্য। এ কারণে বাংলা চলচ্চিত্র চিরঋনী হয়ে থাকবে তার কাছে।